বছর ঘুরে ‘লকডাউন’ এর স্মৃতি উস্কে আজও বাংলা ওড়িশার সীমান্ত দাঁতনে পড়ে রয়েছে পরিযায়ীদের কয়েক হাজার ‘বাহন’।
ফের লকডাউন! উসকে দিচ্ছে ২০২০’র লকডাউনের নানা স্মৃতি। গত বছর লকডাউনে ভিন রাজ্য বা জেলা ফেরত পরিযায়ী শ্রমিকদের কষ্টের স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করছে। জীবিকা হারিয়ে নতুন জীবনের তাগিদে কোনোমতে বাড়ি ফিরেছিলেন তাঁরা। কর্মহীন শ্রমিকদের পকেটে ছিলো না টাকা, ছিলো না খাবারের সংস্থান। তাই ট্রেনের ওপর ভরসা না করে, নিরুপায় শ্রমিকরা সাইকেলে, বাইকে, পায়ে হেঁটেই বাড়ি ফিরেছিলেন। সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজও ভাসছে চোখের সামনে। পশ্চিম মেদিনীপুরের হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু সহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে ওড়িশা পেরিয়ে বাংলায় পৌঁছেছিলেন। পুলিশ, প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে চেকিং পয়েন্ট করা হয়েছিল বাংলা-ওড়িশা সীমান্তে দাঁতনের সোনাকোনিয়ায়। সেখানে ভিন রাজ্য থেকে ফেরা মানুষজনের করোনা পরীক্ষা করা থেকে শুরু করে ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা করা, দূরের জেলা মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বর্ধমান বা অন্যান্য জেলার শ্রমিকদের সরকারি গাড়িতে করে নিজের জেলায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল প্রশাসন। আর, তাতেই কয়েকশো কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে আসা ক্লান্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকেই দ্রুত বাড়ি ফেরার তাগিদে নিজেদের সাইকেল, মোটর সাইকেলের মায়া কাটিয়ে, সরকারি গাড়িতে করেই বাড়ি ফিরে যান। “বাহন” গুলি পড়ে থাকে বাংলা-ওড়িশা সীমান্ত দাঁতনেই। পরিযায়ী শ্রমিকদের সেই সব সাইকেল আজও পড়ে রয়েছে বাংলা-ওড়িশা সীমান্তের দাঁতনে। দাঁতনের সাস্তানগরে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে ‘গৌরী ফিলিং স্টেশন’ পেট্রল পাম্পের পিছনে পড়ে থাকা প্রায় হাজার খানেক সাইকেল ও বেশ কিছু বাইক এবার সযত্নে গুছিয়ে রাখার এবং ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিল খড়্গপুর মহকুমা প্রশাসন। মহকুমাশাসক আজমল হোসেন জানান, ‘আমরা খবর পেয়েছি। তাই, এই বিষয়ে দাঁতন- ১ এর বিডিও এবং দাঁতন থানার ওসি’র কাছে আবেদন জানিয়েছি, এই বিষয়ে একটা তালিকা তৈরি করতে। তারপর তা যেন সযত্নে তুলে রাখা হয়। আমি জানি না, সেই সময় কোনো টোকেন সিস্টেম ছিল কিনা, যদি থাকে তবে তা যদি পৌঁছে দেওয়া যায় ওই পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে, সেই উদ্যোগ নেওয়ার জন্যও বলেছি। এই মুহূর্তে ব্লক প্রশাসন ত্রাণ শিবির নিয়ে একটু ব্যস্ত আছেন, ব্যস্ততা একটু কেটে গেলেই এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেই সময় সরকারি ব্যবস্থাপনায় করোনা পরীক্ষা করিয়ে, সাইকেল রেখেই বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকেরা। পড়ে ছিল সাইকেল, বাইকগুলি। অনেকে পরে এসে, পুলিশের কাছ থেকে কয়েকটি বাইক ফেরত নিয়ে গেলেও, কেউই আসেননি সাইকেল ফেরত নিতে। গত এক বছর ধরে সেই সাইকেলগুলি একই অবস্থায় পড়ে রয়েছে রোদ, জল সহ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সহ্য করেও। সাইকেলগুলি যে পরিযায়ী শ্রমিকদের ছেড়ে যাওয়া সেকথা স্বীকার করছেন পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকরাও। দাঁতনের এক বাসিন্দা শান্তিগোপাল বেরা বলেন, ‘এখানে একবছর ধরে এই হাজার খানেক সাইকেল পড়ে আছে, অযত্নে ও অনাদরে। প্রশাসনের কাছে আবেদন জানাবো, বেঁচে থাকার তাগিদে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে যেন তাঁদের সাইকেলগুলি ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।’ অপর একজন বাসিন্দা প্রজ্ঞা প্রসূন ঘোষ বললেন, ‘ভয়ঙ্কর মহামারীর হাত থেকে বাঁচতে, ২২ মার্চ ২০২০’র পর বাড়ি ফিরে এসেছিলেন ভিন রাজ্যে কর্মরত শ্রমিকরা। তারপর, এখানে তাঁদের চেকিং ও করোনা পরীক্ষা হওয়ার পর যে যার জেলায় ফিরে যান, সরকারি বাস বা গাড়িতে করে। বাধ্য হয়েই সাইকেলগুলি নিয়ে যেতে পারেননি তাঁরা। কিন্তু এই সাইকেল আজও সেইসব ভয়ঙ্কর দিনের স্মৃতি মনে করায়। কিভাবে মানুষ ঘরে ফেরার টানে বাহনগুলি ছেড়ে গেছে। ঈশ্বরের কাছে তাঁদের সকলের সুস্থতা কামনা করি এবং তাঁরা যদি সাইকেলগুলি আজ নিয়ে যেতে চান, নিশ্চয়ই প্রশাসনের তরফে তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করা হবে বলে মনে করি।’ সেদিনের সেই স্মৃতি এবার সযত্নে ‘সংরক্ষণ’ করে রাখার উদ্যোগ নিচ্ছে প্রশাসন।