Written By আশিস চট্টোপাধ্যায়
আর তিনদিন বাদেই এই সময়ে সংসদে বাজেট পেশ করে ফেলেছেন নির্মলা সীতারামন । মঙ্গলবার, ২ জুলাই এই প্রবন্ধ যখন লিখছি, দেশের প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শোনবার অপেক্ষায় সারা দেশ । ভোটের আগে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির অসুস্থতার কারণে পীযূষ গয়াল অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট পেশ করেছিলেন ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে । তখন ভোটের বাধ্যবাধকতা ছিল, দরকার ছিল জনপ্রিয় ঘোষণার । সেই তাগিদে আয়কর ছাড় সহ কয়েকটি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন পীযূষ গয়াল । এখন ভোট নেই, সঙ্গে বাড়তি ফ্যাক্টর হলে, ভারতের অর্থনীতি গভীর সংকটে । তাই কী ভাবে দুইয়ে-দুইয়ে চারের হিসাব মেলান সীতারামনজি, সেটাই দেখতে চাইছেন দেশবাসী ।
প্রত্যক্ষ করে সংস্কার ?
আয়করে কিছু ছাড়ের কথা আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল । তাতে মধ্যবিত্তের একটা অংশের কর কিছুটা কমেছিল, এটা ঠিক । কিন্তু আয়করে সামগ্রিক সংস্কারের কথা তখন আলোচনায় আসেনি, আসবার কথাও নয় । পূর্ণাঙ্গ বাজেটেও সে প্রশ্ন কী এড়িয়ে যাওয়া হবে ? আমাদের দেশে সর্বোচ্চ আয়করের হার ৩০ শতাংশ । অথচ দেশে অতি বড়লোকদের হাতে জমেছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ । অনেকেই মনে করেন, মধ্যবিত্তদের করে সুবিধা আরেকটু বাড়িয়ে বড়লোক এবং অতি বড়লোকদের করের হার বাড়ানো উচিত । দেখা যাক, কী ভাবছেন অর্থমন্ত্রী।
বৃদ্ধির হার শ্লথ
চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, ৫.৭ শতাংশ । এই গতি অব্যাহত রয়েছে বলেই মনে করা যেতে পারে । কয়েকটি আর্থিক লক্ষণ বেশ স্পষ্ট । সদ্য শেষ হওয়া মাসে, অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুন মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় জিএসটি আদায় ১ লক্ষ কোটি টাকা কম হয়েছে । পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে মনে করছেন অনেক অর্থনীতিবিদরাই । অবশ্য জিএসটি ফাঁকির বিষয়টিও গুরুত্বের দাবি রাখে । নানা পণ্য, যা মধ্যবিত্ত তথা উচ্চবিত্তরা কেনে, যেমন গাড়ি, তার বিক্রি বিগত কয়েক মাসে সরাসরি কমে গেছে । সম্প্রতি প্রকাশিত সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি বা সিএমআইই-র রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, জিডিপি বৃদ্ধির হার এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে আরও কমে হয়েছে ৫.৪ শতাংশ । এই সময়ে নতুন শিল্পে সবথেকে কম বিনিয়োগ হয়েছে। জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকের তুলনায় এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে নতুন শিল্পে বিনিয়োগ কমেছে ৮১ শতাংশ । গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই হ্রাসের হার ৮৭ শতাংশ । এক কথায় বলা যেতে পারে, এই ছবি বড় দুর্যোগের আভাস দিচ্ছে । অনেক অর্থনীতিবিদই মনে করছেন, চাহিদার অভাবই শিল্পে বিনিয়োগ কমাচ্ছে । চাহিদা কম হওয়ার মূল কারণ, বিশাল কর্মহীনতা । পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্য, শিক্ষাখাতে খরচের বহর । ফলে অন্যান্য পণ্য কেনাকাটা কমছে । এই পরিস্থিতি স্পষ্ট দেখিয়ে দিচ্ছে, সুদের হার কমিয়ে বিনিয়োগ বাড়ছে না । এটা অতীতেও দেখা গেছে । রয়ে গেছে নোটবাতিল ও তড়িঘড়ি জিএসটি চালু করার নেতিবাচক প্রভাবও । তাই বিকল্প রাস্তার সন্ধান করতে হবে ।
ব্যাঙ্কগুলি ভুগছে নগদের স্বল্পতায়
ব্যাঙ্কগুলি ভুগছে বিপুল পরিমাণ নন্-পারফর্মিং অ্যাসেটের সমস্যায় । নন্-পারফর্মিং অ্যাসেটের বেশির ভাগটাই সোজাসাপটা চুরি । অতি উচ্চপদস্থ ব্যাঙ্ক কর্মী, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের যোগসাজসে এহেন চুরি গত কয়েক বছরে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে । এই টাকা চোট যাওয়ার ফলে ব্যাঙ্কে নগদের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে । কর্পোরেটরা এবং ব্যাঙ্কশিল্প সরকারকে চাপ দিচ্ছে স্বল্প সঞ্চয়ের সুদ কমাতে, যাতে পোস্ট-অফিসে না রেখে মানুষ ব্যাঙ্কে টাকা রাখে। গতকাল থেকে স্বল্পসঞ্চয়ে ০.১ শতাংশ সুদ কমানো হয়েছে । তবে সুদ কমলেই ব্যাঙ্কে টাকা আসবে, এমনটা না-ও হতে পারে । যাদের হাতে টাকা আছে, তারা সেই টাকায় সোনা, জমি বা বাড়ি কিনে টাকাটা সুরক্ষিত রাখতে পারে । সেক্ষেত্রে চলতি পণ্যের চাহিদাও বাড়বে না, ব্যাঙ্কের নগদ ঘাটতিও কমবে না ।
সংকট-মুক্তি কোন পথে ?
অর্থনীতির পড়ুয়ারা অনেকেই মনে করছেন, কর্মহীনতার সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করাই পরিত্রাণের পথ । বেসরকারি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ যখন হচ্ছে না, সরকারি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের মাধ্যমেই এই কাজ শুরু করতে হবে । উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, পরিকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ালে কর্মহীনতা কমবে, পণ্যের চাহিদা বাড়বে, আর তা হলে বেসরকারি বিনিয়োগেও গতি আসতে পারে । কিন্তু সরকার বিনিয়োগের টাকা পাবে কোথা থেকে ? জিএসটি-র আদায় কমে যাওয়ায় এমনিই কেন্দ্রের ভাড়ে মা ভবানী । তাই কেন্দ্রের হাতে বাড়তি টাকা জোগাতে বড়লোকেদের পকেটে হাত দেওয়া ছাড়া রাস্তা নেই। আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন নির্মলা । সাহসিনী বলেই তাঁর খ্যাতি । পারবেন কী তিনি বড়লোকেদের চটাবার সাহস দেখাতে ?