Written By অনিরুদ্ধ সরকার
একটা শহর কিনা আস্ত গোলাপী রং- এ মোড়া! চারিদিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার পালা। যোধপুর, উদয়পুর, জয়সলমের,বিকানের সব ঘুরে ফিরতি পথে জয়পুরে থামলাম।রাজস্থানের জয়পুর 'পিঙ্ক সিটি ' বা 'গোলাপী শহর' নামেই অধিক জনপ্রিয়।
কেন শহরের নাম হল 'পিঙ্ক সিটি'? আর কেন ই বা শহরের দুর্গ, প্রাসাদ বাড়ি-ঘরের রঙ হল পিঙ্ক? গোলাপী শহর তৈরির ইতিহাস
বেশ পুরানো। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিককার ঘটনা।তখন জয়পুরের রাজা রাম সিং।তার রাজত্বকালে প্রিন্স অব ওয়েলস জয়পুর ভ্রমনে আসেন।রাজপুত সংস্কৃতিতে 'গোলাপী রং' হল আতিথেয়তার প্রতীক। রাজা রাম সিং এর খেয়াল হল প্রিন্সকে অভ্যর্থনা জানাতে শহরকে গোলাপী রং এ মুড়ে ফেলবেন।ব্যাস! রাজার খেয়াল! যেমন ভাবনা তেমন কাজ।আর সেই থেকে শহরের বাড়িঘর গোলাপী রং করার যে রেওয়াজ শুরু হয়েছিল আজও তা একই রয়েছে। শহর জুড়ে গোলাপী রং এর আধিপত্য।
জয়পুরের নামককরণ হয়েছে রাজা জয় সিং এর নামানুসারে।জয় সিং অম্বরের রাজা হন মাত্র তেরো বছর বয়সে।তখন দিল্লির সিংহাসনে মোঘল সম্রাট অউরংজেব।জয় সিং এর সাথে সাক্ষাত করে অউরংজেব যার পর নাই খুশী হন।জয় সিংকে উপাধি দেন 'সোয়াই'।যার অর্থ এক চতুর্থাংশের বেশী।যিনি সাধারনের চেয়ে সব দিক থেকে অধিক গুনসম্পন্ন তিনিই পেতেন এই 'সোয়াই' উপাধি।রাজা জয় সিংও পেলেন 'সোয়াই' উপাধি।
বীর, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান রাজা জয় সিং অম্বর পাহাড় থেকে তার নতুন রাজধানী স্থানান্তরিত করলেন সমতল জয়পুরে।নতুন রাজধানী গড়ে উঠল এক তরুণ বাঙালি স্থপতির হাত ধরে।নাম বিদ্যাধর ভট্টাচার্য।ভারতের প্রথম পরিকল্পিত এই শহরটিতে তৈরি হয় আটখানি প্রবেশদ্বার।
সিটি প্যালেস :
জয়পুরের প্রথম গন্তব্য সিটি প্যালেস।শহরের কেন্দ্রে এই সিটি প্যালেস।সিটি প্যালেস দেখার জন্য হাতে ঘন্টা তিন- চার সময় রাখবেন।একে প্যালেস না বলে আস্ত একটা শহর বলা যেতে পারে।সিটি প্যালেসের মূল অংশ দুটো, চন্দ্রমহল আর মোবারক মহল। এই প্রাসাদের একটা অংশ এখন রাজা সোয়াই দ্বিতীয় মান সিং এর জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দুর্গের সাতটি তোরণদ্বারের কারুকাজ অসাধারণ। দেওয়ান-ই-খাস এ এক সময় হত রাজপরিবারের নানান অনুষ্ঠান। এখানে দু'টি রুপোর বিশাল আকৃতির জলাধার রয়েছে।ইংল্যান্ডে সপ্তম এডওয়ার্ডের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সময় জয়পুরের মহারাজা এই ঘড়া দুটিতে করে গঙ্গাজল নিয়ে যান।
দেওয়ান-ই-আম এ রয়েছে বেশ কিছু অসাধারণ তৈলচিত্র।এখানকার মিউজিয়ামে রয়েছে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য পুঁথি। যার মধ্যে আকবরের সভাসদ আবুল ফজলের লেখা মহাভারতের ফার্সি অনুবাদটির দেখা মেলে।আর বিভিন্ন কক্ষে ছড়িয়ে রয়েছে নানান বিস্ময়। অস্ত্রাগারে রয়েছে মান সিং এর প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের তরবারি।
জয়পুর মানমন্দির:
মহারাজা মান সিং এর জ্যোর্তিবিজ্ঞানে প্রবল উৎসাহ ছিল।তার রাজসভায় এসেছিলেন পর্তুগালের বিখ্যাত জ্যোর্তিবিদ সেভিয়ার ডিসিলভা।কিন্তু তার কাছ থেকে রাজা জ্যোর্তিবিজ্ঞান সংক্রান্ত যেসব তথ্যগুলি পেয়েছিলেন, নিজে পরীক্ষা করে দেখলেন সেগুলি ভুল।জেদী রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন সঠিক জ্যোর্তিবিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য মানমন্দির স্থাপন করবেন। করলেন ও। শুধু নিজ রাজ্য জয়পুরই নয়, মানমন্দির নির্মান করালেন ভারতের আরও চার জায়গায় দিল্লী,কাশী, মথুরা এবং উজ্জয়িনীতে।এর মধ্যে জয়পুরের মানমন্দিরটি সবচেয়ে বড়।জয়পুর যন্তর মন্তরে রয়েছে একাধিক রাশি গননার যন্ত্র।আর এই জয়পুর জন্তর মন্তর পৃথিবীর বৃহত্তম পাথরের তৈরি মান মন্দির।আর সবচেয়ে আশ্চর্যের হল এখানকার 'সূর্যঘড়ি'টি।
হাওয়া মহল:
পরবর্তী গন্তব্য হাওয়া মহল ।পিরামিড আকৃতির তিনশো ষাটটি জানালা বিশিষ্ট এই মহলটির ছবি দেখা যায় একাধিক বিজ্ঞাপনে।প্রতিটি জানালায় জাফরির কাজগুলির দিকে মুগ্ধ হয়ে কেবল তাকিয়ে থাকতে হয়। এই প্রাসাদ নির্মান করিয়েছিলেন রাজা সোয়াই প্রতাপ সিং।
রাজা প্রতাপ সিং ক্ষেত্রি মহলের স্থাপত্যকলায় মুগ্ধ হয়ে লাল-গোলাপি পাথরের হাওয়া মহল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন, নকশার দায়িত্ব পড়ে লাল চন্দ উস্তাদের হাতে। রাজপুত নারীরা রাস্তার একাধিক উৎসব উপভোগ করার সুযোগ পেতেন এই মহলে থাকার সুবাদে।হাওয়া মহলের ছোট ছোট জানালা দিয়ে রাজপুত রমনীরা উপভোগ করতেন জয়পুরের বিভিন্ন পূজা-পার্বণ, একাধিক আনন্দউৎসব। বাইরের পথচলতি প্রজারা কেউই রাজঅন্তঃপুরের রমনীদের দেখতে পেত না।আর মহলটির জানালাগুলি এমনভাবে নির্মান করেছিলেন শিল্পীরা যে প্রচুর হাওয়া প্রবেশ করত মহলে।গ্রীষ্মকালে প্রাসাদকক্ষগুলি এসির মত ঠান্ডা থাকত।
জলমহল:
জয়পুরের প্রাণকেন্দ্র মান সাগর লেকের ঠিক মাঝখানে দেখা মেলে দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ জল মহলের।প্রাসাদটি এক সময় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যেতে বসে।রাজপুত রাজাদের তৈরী করে যাওয়া এই জল মহলকে রাজা দ্বিতীয় জয় সিং পুনরুদ্ধার করে সংস্কার করেন। মান সাগর লেক যখন জলে পূর্ণ থাকে তখন এই পাঁচ তলা ভবনের চার তলাই থাকে জলের নিচে,একেবারে ওপরের পঞ্চম তলা দেখতে পাওয়া যায়। রাজপুত স্থাপত্যশৈলীর এক আশ্চর্য নিদর্শন এই জল মহল।
জয়গড় ফোর্ট:
জয়পুরের আশেপাশে সময় করে দেখে নেওয়া যায় পাহাড়ের ওপর জয়গড় ফোর্ট।ঐতিহাসিকদের মতে এই দুর্গ নাকি ছিল অপ্রতিরোধ্য, কখনো কারো দ্বারা বিজিত হয় নি। ভারতের সর্ববৃহৎ কামান 'জয়বান' রয়েছে এখানে।প্রতি বছর দশেরার সময় রাজপরিবারের লোকেরা শ্রদ্ধা সহকারে এই কামানের পূজো করে।
নাহারগড় ফোর্ট:
জয়গড় ফোর্ট ছাড়াও নাহারগড় ফোর্টটিও অসাধারণ। শহর থেকে সাতকিমি দূরে।
এই কেল্লার অন্দরমহল আজও রহস্যে ঘেরা। শোনা যায় , এই কেল্লা যখনই সংস্কার করতে যাওয়া হয়, তখনই কোনও না কোনও দুর্ঘটনা ঘটে। সংস্কার করতে আসা লোকজনের মৃত্যুর খবরও সামনে এসেছে। কারন আজও অজানা!
লোকবিশ্বাস, এই কেল্লার ভেতরে নাকি আজও রাজা মান সিং চলা ফেরা করেন। মিলেছে রাজার পদচিহ্ন!
জয়পুরের আশেপাশে :
জয়পুর শহরের মাঝে রামনিবাস উদ্যান ও আ্যালবার্ট মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখুন। এটি রাজস্থানের সবচেয়ে প্রাচীন যাদুঘর। রাম নিবাস উদ্যানের ভেতরে এই মিউজিয়াম।প্রিন্স অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড এই যাদুঘরের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। রাজস্থানের লোক সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ থাকলে অবশ্যয় এখানে কিছুটা সময় কাটাবেন।ভালো লাগবে।
শহর থেকে প্রায় ন'কিমি দূরে সিসোদিয়া রানিবাগ। রাজা জয় সিং তার প্রিয় রানি শিশোদিয়ার জন্য এই মহল বানিয়ে দেন।
আর হাতে যদি সময় থাকে তো জয়পুরে রয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম সিনেমা হল 'রাজমন্দির'।সেখানে বসে একটি সিনেমাও দেখে নিতে পারেন।
কীভাবে যাবেন:
বিমান - জয়পুর শহর থেকে বিমান বন্দর ১২ কিমি।
ট্রেন - হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে জয়পুর যাওয়ার একাধিক ট্রেন রয়েছে।যোধপুর এক্সপ্রেস, আজমের এক্সপ্রেস, অনন্যা এক্সপ্রেস, প্রতাপ এক্সপ্রেস সহ রয়েছে একগুচ্ছ ট্রেন।এছাড়া দিল্লি হয়েও জয়পুর যাওয়া যায়।দিল্লি থেকে ঘন্টা চারেকের দূরত্বে জয়পুর।
সড়কপথ - জয়পুর যাওয়ার জন্য সরকারি কিম্বা বেসরকারি বাস চলছে রাজস্থানের নানা প্রান্ত থেকে। এছাড়া অন্যান্য রাজ্য থেকেও বাস চলছে।দিল্লী থেকে বাসে জয়পুর সময় লাগে কমবেশী সাত ঘন্টা। জয়পুরের বাসস্টান্ডের নাম সিন্ধি ক্যাম্প।
একনজরে জয়পুর থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সড়কদূরত্ব - দিল্লি ২৫৮কিমি, আগ্রা ২৩০কিমি, আজমের ১৩৩কিমি , পুষ্কর ১৪৫কিমি,যোধপুর ৩৩৫ কিমি, বিকানের ৩২০কিমি,উদয়পুর ৪০৭কিমি, জয়সলমের ৬২২কিমি, ইন্দোর ৫৮০কিমি।
কোথায় থাকবেন :
RTDC র হোটেল ছাড়াও রয়েছে একাধিক ছোটো বড় হোটেল আই সি টি রাজপুতনা, রামবাগ প্যালেস,রয়্যাল হেরিটেজ হ্যাভেলি,দি ললিত হোটেল,
জয়পুর ম্যারিয়ট হোটেল। তবে একটু খোঁজ করলে নাম মাত্র ভাড়ায় বড় বড় হাভেলির রুম ভাড়া পাওয়া যায়
হোটেল ভাড়া ৮০০-৫০০০ এর মধ্যে।
কখন যাবেন:
জয়পুরের আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক থাকে অক্টোবর থেকে মার্চ মাস অবধি। গ্রীষ্মকালে ভুল করেও যাবেন না।প্রচন্ড গরম।জয়পুরে শীতকাল বেশ চমৎকার। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সবচেয়ে ভালো সময় জয়পুর ভ্রমনের জন্য। এই সময়ের মধ্যে গেলে আপনি বেশ কিছু উৎসবেও যোগ দিতে পারবেন। যেমন জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভাল বা সাহিত্য সম্মেলন। মার্চে পাবেন জয়পুরের বিখ্যাত হাতি উৎসব বা এলিফ্যান্ট ফেস্টিভাল।
খাওয়া-দাওয়া:
রাজস্থানের খাবারে রাজপুত ও মোঘল রন্ধন প্রনালির বেশ প্রভাব লক্ষ করা যায়। এখানকার কিছু বিখ্যাত খাবার হল ডাল কচুরি, টিকি, কিমা বাটি, চুরমা, লাল মাস, মিরচো বাদাস, জঙ্গলি মাস, পনীর আফতাব, সুলা বিরিয়ানি ইত্যাদি। 'ডাল বাটটি' আর 'চুরমা' জয়পুরের দুটি বিখ্যাত খাবার।জয়পুর এলে অবশ্যয় এই দুটি খাবার খাবেন।'ডাল বাটটি' হল ছোলা বা মুগ ডালের সাথে মশলাদার সবজীর পুর দেয়া শক্ত একরকম পাউরুটি।পাউরুটিটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,এটি কয়েকদিন আগে থেকে বানিয়ে রাখা হয়।এটা রাজস্থানের মরুভূমি অঞ্চলের খাবার।আর 'চুরমা' হল একপ্রকার লাড্ডু ।ময়দা,প্রচুর ঘি আর চিনি দিয়ে বানা
6th March, 2021 11:13 pm
6th March, 2021 10:38 pm
6th March, 2021 07:54 pm
6th March, 2021 07:25 pm