Written By নীলার্ণব চক্রবর্তী
আকাশে সরসরে পেঁজা-তুলো মেঘের সোনামনা খেলাটা তখনও স্বপ্ন। তখন শুধুই আকাশ ভরা মা-তারার অঙ্গ-রঙা মেঘমালা। ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত রুগির হাগুপটির ন্যায় আকাশ ঢালছে। ঢালছেই। চারপাশে জলের জগৎ। ফুটপাতে পা পাতলে জল জয় করে পেতে হচ্ছে জন্মভূমি। ফলে ইটালিয়ান সেলুনওলারা কপালে হাতুড়ি ঠুকছেন। তাদের মুখগুলি অন্ধকারের সান্দ্র তরলে পুরোটা চোবানো।
ইটালিয়ান সেলুন দেখতে ইতালি যেতে হবে না। এই শহরের ফুটপাতে ফুটফুটে সৌন্দর্য হয়ে দীর্ঘকাল ধরেই তারা রয়েছে। ইটের ওপরে (ইট ছাড়াও মাটিতে নানা কিছু সিট হয়ে থাকে, আবার অনেক ইটালিয়ান তো চেয়ারে উঠছে) বসিয়ে চুল (মাথা, বগলের) ও দাড়ি কাটা হয় বলে এর নাম ইটালিয়ান সেলুন। কে বা কারা এ নাম দিয়েছে, জানা নেই। তবে, ইষদুষ্ণ ব্যঙ্গ লবঙ্গের স্বাদের মতো মেশানো রয়েছে এই নামে। বড়লোক-হাফ বড়লোক-মেজোলোক ও ফান্টুস ছোটলোকদের কেউ সাতমহলা সেলুনে এসির সুবাসে দাড়ি-চুল কাটার পর গা চটকানো খেতে খেতে ফুটপাতিয়া সেলুনকে গালির বন্যা দিতে দিতে এই নামটা নিশ্চই দিয়েছে। কিন্তু সে জানতই না— জিসকো রাখে সাঁইয়া মার সকে না কোই। যারা দিন আনা দিন খায়, তাঁদের জন্য ইটালিয়ান সেলুনই চুল কাটানোর উৎকৃষ্ট ও একমাত্র ঠিকানা।
কলকাতার ফুটে কত ইটালিয়ান আছে, তা গুনে ওঠা সম্ভব হয়নি। এর একটা সেনসাস হতেই পারে। তবে, আমার মনে হয়েছে, ওই আকাশ যেমন তারায় ভরা, তেমনই কলকাতার ফুটপাতগুলি ইটালিয়ান-খচিত। অধিকাংশই বিহারের, কিছু ইউপি, কিছু ওড়িশা, কিছু এ রাজ্যের লোকজন সেই কবে, যেন শুরুর সে দিনটিতে এ শহরে এসে হরেক ব্যবসার মতোই ফুটপাতে গুছিয়ে একটু স্থান করে প্রতিষ্ঠা করেছে ইটালিয়ান ঈশ্বরকে।
তো, শুরুতে ছিলাম যেখানে, সেই বর্ষায় ফিরি। বর্ষা মানেই ইটালিয়ানদের আর্তনাদের সিজন। এক দারুণ সময়। গাল-ভরা সাবানে ব্লেড-ভরা রেজারের এক টান পড়েছে কি পড়েনি, শুরু: রিম ঝিম ঝিম ঝিম...রিম...। আর ফুটপাতে বৃষ্টির নূপূর বেজে ওঠা মাত্র পাশে গুটিয়ে রাখা দাদাজিকে যুগকা ছাতা খাটিয়ে বাকি দাড়িটা কাটার চেষ্টাও। কিন্তু বৃষ্টি ততক্ষণে মুষল, ফলে হাফ-দাড়ি শেভের পরই কাপড় দিয়ে সাবান মুছিয়ে-টুছিয়ে কাস্টমারকে সায়োনারা জানাতেই হচ্ছে। ওই হাফ-শেভের শ্রম তো মায়ের ভোগে। কাস্টমার রণচণ্ডী হলেও, অবস্থা নাচার। তাই ইটালীয় মালমেটিরিয়াল জলদি গুছিয়ে নাপিতবাবাজি কাছের শেডের নীচে গুটিসুটি। কাস্টমারটি ততক্ষণে আগলা জনম মে তু শালা শুয়ার হোগা বলে যেন বৃষ্টির ফাঁক গলে-গলে ভ্যানিস। এমনই চলছে যুগে যুগে, বর্ষাকাল বা অকাল বর্ষায়।
আসলে, এইসব কথা ৮ আনা বাংলায় ৮ আনা ভোজপুরি মিশিয়ে আমায় জানালেন শিয়ালদায় সরস্বতী প্রেসের সামনে গাছের নীচের বেদিতে বসা প্রবীণ ক্ষুরকার অর্জুন শর্মা। তখন একটা বাচ্চার মাথা ন্যাড়া করছিলেন। পাশেই ছাতুর দোকান। যেখান থেকে তাল তাল ছাতু বিক্রি হচ্ছে— মুফতে লঙ্কা। বর্ষা ছাড়া অন্য সময়ের দুপুরগুলিতে বেশ ভিড় হয় অর্জুন শর্মার ইটালিয়ানে। অনেকেই অপেক্ষা করতে ছাতুর দলা চিবোন। আমাকে তিনি ছাতু অফার করলেন। ঠিক তখনই আকাশে ভেসে এল কিউমুলোনিম্বাস মেঘের একটা বড় দলা। চারপাশে ঝুপ করে নামল অন্ধকারও। বুঝাতা কি এইসন বারখা হোই, সব খতম হো যাই। আকাশে চোখ বুলিয়ে স্বগতোক্তি শর্মাজির।
বছর পঁচিশ এখানে চুল-দাড়ি কাটছেন। বিহারের নওয়াদা জেলার বাসিন্দা। পোস্ট: বাহাদুরপুর। গ্রাম: করিগাঁও। পারিবারিক পেশা ক্ষৌরকর্ম হলেও চাকরির আশায় ‘কলকাত্তায়’ এসে হাজির হন। এ শহর তাঁর কাছে আগমার্কা অচেনা। কিন্তু কয়েক জন জানল-সুনল লোগ ছিল এখানে। তাঁদের একজনকে ধরে চাকরিও জোটালেন ডালহৌসিতে এক অফিসে। কিন্তু সেখানে তালা ঝুলল কয়েক বছর যেতে না যেতে। তখনও শরীরে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ, মনও মায়াবী। উপার্জনে অর্জুনের লক্ষ্য স্থির। একদিন ফুটপাতের এই এক চিলতে জায়গাও তাই মিলল। সেই থেকে চুল-দাড়ি বানিয়ে যাচ্ছেন এখানেই— অনর্গল। জানালেন, চুল দাড়ি নিয়ে তার ৩০ টাকা রেট। চুল ১৫, দাড়ি ১৫। নো ডিজাইনের চুল কাটাকাটি। কেউ এমন আবদার করলেই অর্ধচন্দ্র।
কথায় কথায় ফ্যামিলি-টকও: দুটো ছেলে। বড় ছেলেটার বয়স ১৮-১৯। পড়াশুনো করছে— এই ইটালিয়ান-অর্থে। পড়া শেষে চাকরি করতে চায় সে। উ ই কাম না করি, উ নোকরি করি। অর্জুনের গলায় আত্মবিশ্বাস।
শিয়ালদা থেকে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছলাম মহাজাতি সদনের সামনে। খবর ছিল, এখানে কাছে-পিঠে ইটালিয়ান-দঙ্গল বসে ভোর থেকে সন্ধে। একটু খোঁজ করতে পেয়েও গেলাম। মহাজাতি সদনের উলটো দিকে বাল মুকুন্দ মক্কর রোডে। ডানদিকের ফুটপাতে সেলুনের সারি। তবে, এখানে অনেক ইটালিয়ান চেয়ারে উন্নীত। দুটি ধরন এর। প্রথম: দেওয়ালে আয়না ঝোলানো, সামনে চেয়ার। দ্বিতীয়: শুধুই চেয়ার, দেওয়াল নেই, ফলে নেই আয়নাও ।
আলাপ ভগবৎ শর্মার সঙ্গে। বয়স ৪৫। চেহারা দোহারা। ১৯৮২তে কলকাতায় এসেছেন। প্রথমে যন্ত্রটন্ত্র বাক্সে পুরে চুল-কাটা পথে পথে ফেরি করতেন। তারপর বিহারের এই বাসিন্দা এই ফুট-স্থান পেলেন। প্রথমে মাটিতে বসেই চলত হস্তশিল্প। ক্রমে চেয়ার হল, সামনের দেওয়ালে ঝোলানো হল আয়নক, এবং মাথার ওপরে উঠল ঢাকনি। ভগবৎ বলছিলেন, যদি কম বরখা হোই তো মাথা তোপলা সে কাম চল যাই, লেকিন বেশি হোকলা সে বাচল মুশকিল হো যাই। আপনার তো ব্যবসা ভালই, বলতে উত্তর: রওনা লাগোতা কি গাঁহক বা লোগ, লেকিন ইয়ে গপ মারত বা লোগ। হঠাৎই পাশ থেকে একজন গপ-কারী বলে উঠলেন, দাদা, অমিতজির স্টাইলে চুল কাটতে ভগবৎ ওস্তাদ। এ তল্লাটে ওর খুব নাম। অমিতজি মানে বুঝলেন তো অমিতাভ বচ্চন। ওকে তো সবাই ভগবৎ বচ্চন নামেই ডাকে।
আমি ভগবতের দিকে তাকাতেই, উনি লাজুক হলেন। যথাসম্ভব বাংলায় বললেন: ঝুট বলব না দাদা, তখন শোলে রিলিজ করল। আমি প্রথম আমিতজিকে সিনেমায় দেখলাম। তখনই ঠিক করে নিলাম, এই ভদ্দরলোকের স্টাইলে কেশ কাটতে হবে। তারপর উনকর ছবি জোগাড় করে নিলাম। কাগজে বেরিয়ে ছিল, পোস্টারে ছিল। কেটে নিলাম। তারপর হাত পাকালাম। আবহি কেশকে এইসন ডিজাইন বানায়ন, কি অমিতাভ বচ্চন লাগব। কান এঁটো করে হাসতে থাকলেন ভগবৎ।
বচ্চন নয়, সলমন খানের কথা মনে এল এ জে সি বোস রোডের ফুটপাতে সারিবদ্ধ ইটালিয়ানদের একজনের গল্পে। শিয়ালদা ফ্লাইওভার শেষে বাসস্ট্যান্ডের পিছনে এদের পরপর দেখা যাবে। টিপিকাল ইটালিয়ান ঘরানা (তবে ইটের সিট রূপান্তরিত হয়ে ব্যাটারির বডি হয়েছে)। বিহারের গয়া জেলার কিষাণ ঠাকুর আমায় সেই সলমন মনে-পড়ানো গল্পটি শোনান: তখনও এই বাসস্ট্যান্ড হয়নি। আমরা একটু ওদিকে বসতাম। একদিন কী হল একটা বাস ব্রেকফেল করে একেবারে ফুটপাতে উঠে এল। আমার দুই ভাই আমার পাশেই বসত। তার পাশে বসত আমার বাবা। বাসটা দুই ভাইকে ধাক্কা দিয়ে ওই থানায় (মুচিপাড়া এক্সসাইজ ব্যারাক) ঢুকে গেল। হাড়গোড় সব ভেঙে গেল ভাইদের। লেগেছিল মাথাতেও। মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হল। তিন-চার মাস হাসপাতালে ছিল ওরা। কিন্তু তাও একজন ঠিক মতো হাঁটতে পারে না। আরেক জনের মাথাটা একটু কেমন হয়ে গেছে। ওরা গাঁও চলে গেল। বাবারও চোট লাগল, তবে কম চোট। আমার কানের পাশ দিয়ে বাসটা চলে গেল, একটুর জন্য বেঁচে গেলাম।
সেসময় যেন এক দমকা দখিনা হাওয়ায় আমি হাজির হলাম গিয়ে দক্ষিণ কলকাতার ফুটে। যে কলকাতায় আকাশকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেওয়া আঠাআঠা অট্টালিকা। তাতেই ফুটে-ফুটে ছড়ানো-ছিটোনো ইটালীয় ইতিকথা।
ক্যালকাটা গার্লস স্কুলের সামনে ঊনকোটি চৌষট্টি চুল-দাড়ি ছাঁটার আয়োজন সহ ধপধপে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে এক কাকভুষণ্ডীর দেখা মিলল। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে যিনি চুল কাটছেন ফুটপাতে। উপেন্দ্র ঠাকুর। কত উত্থানপতনের কথা যে তাঁর তিনের নামতার মতো মুখস্ত, ইয়ত্তা নেই। সত্তরোর্ধ উপেন্দ্রর বাড়ি বিহারের মধুবনীতে। সেখানে তার নাতিপুতি ছেলে-বউয়ে ভরা সংসার। নিজে পড়ালেখা শিখতে পারেননি বলে ভিতরে দুঃখ ছিল, তাই ছেলেকে পড়িয়েছেন। বি-কম পাশ করে ছেলে এখন ব্যবসাদার। উপেন্দ্র এখন গাছের গায়ে আয়না ফিট করে কেশ কাটার কাজ করেন। মাথার ওপর কালো রঙের ভারি প্লাস্টিকের ঢাকনাও। প্রায় নিখুঁত বাংলায় বললেন: সেটা সাতাত্তর সাল হবে। তখন মাটিতে বসে কাটি। কী হল একদিন, একটা ছেলে এল আমার কাছে দাড়ি বানাতে। তার চাপ দাড়ি। কালো কুচকুচ। কেশ খুব ভাল ছিল। খুব তার গ্লেজ, আর খুব ঘন! আমাকে বলল, দাড়িটা পুরো নামিয়ে দিতে। শুনেই মন খারাপ হয়ে গেল। এত ভাল দাড়ি পুরো কাটতে বলছে। আমি বললাম, পুরো কেন কাটবেন, ট্রিম করে নিন না। ভাল লাগবে। তো উনি সে সব করাবেন না, পুরোটাই কাটাবেন। আমি আর কী করব, পুরো দাড়িটাই কাটতে লাগলাম। দাড়ি কাটার পর ও আমায় গোঁফ পুরো কাটতে বলল। কেটে দিলাম। এবার দুটো জুলপিও পুরো কাটতে বলল। আমি তো অবাক। তখন বড় আয়না ছিল না আমার। দাড়ি-চুল কাটা হয়ে গেলে, ছোট আয়না বার করে দেখিয়ে দিতাম। দাড়ি-গোঁফ-জুলপি কাটার পর, সামনে আয়না ধরতেই, ছেলেটা বলল— ধরে থাকতে। তারপর দুটো নকল লম্বা জুলপি লাগিয়ে নিল দুদিকে। আমি— হাঁ। এ তো ছদ্মবেশ নিচ্ছে। কপালে লাল তিলকও দিয়ে নিল। তারপর জানতে চাইল, কেমন লাগছে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, বলল, ওর সঙ্গে একটু আড়ালে যেতে। সামনে একটা দেওয়ালের পিছনে যেতেই ছেলেটা পকেট থেকে একটা কালো জিনিস বার করে আমার হাত টেনে নিয়ে রেখে দিল। আমি দেখে বোবা হয়ে গেছি। ছেলেটা বলল, এটাকে রিভলভার বলে। এটা দিয়ে গুলি ছোটে। এখনও মনে আছে, ছেলেটা বলল, ওদের রিভলশনে কাজে লাগবে। বলল, ছদ্মবেশের কথা কাউকে না বলতে। বললে রিভলশন হবে না। আমাকেও ওরা বাঁচতে দেবে না। তারপর অস্ত্রটা নিয়ে সামনে হাঁটা দিল। আর কোনও দিন ওর দেখা পাইনি। আচ্ছা রিভলশন মানে জানেন নাকি দাদা?
বুঝতে পারলাম রেভোলিউশনের কথা বলছেন উনি। কিন্তু এ সব বোঝানো তো ঝক্কি! মাথা নেড়ে না বলে সেখান থেকে ফেটে গেলাম।
একটু এগিয়ে গিয়েই বিজন সেতু। একডালিয়া রোডের ফুটপাতে পরপর ইটালিয়ান। মাধব, মহেশ ঠাকুররা জনা আটেক চুল-কাটিয়ে এখানে বসেন। টানটান চেহারায় বুড়ো বয়স লুকিয়ে রাখা মহেশ ঠাকুর বললেন, কিতনা দিন সে হাজামত বানাবত বানি ইয়াদ নাহি খে। (তারপর আমার অনুরোধে বাংলা ভাষায়) তখন ওই ব্রিজ ছিল না। এত দোকানপাটও ছিল না। মনে আছে, হাওড়া থেকে বালিগঞ্জ এলাম বাসে। ১৩ আনায় দাড়ি কেটেছি। আবহি হাম ১০টাকায় দাড়ি কাটছি।
বিহারি ছাড়া বাকি প্রদেশের যাঁরা এই পেশায় পেষাই হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে এক বঙ্গতনয়ের কথা এবার বলবো। এবং এই লেখাটিতেও দি এন্ড টাঙাবো।
একডালিয়ার ইটালিয়ান ঠাকুরদের জিজ্ঞাসিয়া ওই বাঙালির খোঁজটা পেয়েছি। তবে, সেই সঙ্গে কটাক্ষও: বাঙালি লোক পারে না টানা ডিউটি দিতে। ওদের দম বেরিয়ে যায়!
বিজন সেতুর মুখ থেকে অটোয় পৌঁছালাম রুবি মোড়। সেখানে একটু খোঁজ করতেই পেয়ে গেলাম, দুদিকে টাইপ রাইটারদের সারির মাঝে এক ইটালিয়ানকে। নাপিতের নাম রামকৃষ্ণ শীল। বাড়ি নোনাডাঙায়। চেয়ারে বসিয়ে কাটেন। সামনে গাছের গায়ে পেরেক পুঁতে ঝোলানো আরশি। বলছিলেন, ২০ বছর চুল কাটছি। কিন্তু এখানে তো উচ্ছেদ অভিযানের হেভি ঝামেলা। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি। সেদিন দোকান চালু হওয়ার কথা, তার আগের দিনের কথাটা এখনও মনে পড়ে। চেয়ার কিনলাম, আয়না ও অন্যান্য সরঞ্জাম কিনে এখানে রেখে বাড়ি গেছি। ফিরে এসে দেখলাম সব ভাঙচুর হয়ে গেছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। তারপর কয়েক জনের কাছ থেকে টাকা চেয়েচিন্তে ফের জিনিসপত্র কিনে সেলুন খুললাম। এই কুড়ি বছরে কম করে ১৫ বার ভাঙা পড়েছে সেলুন। কাজ সেরে বাড়ি ফিরি ভয়ে ভয়ে, কী জানি কী হবে! আমাদের ভাঙচুরের কপাল, বুঝলেন তো!
আর বৃষ্টি হলে কী করেন?
ওই দেখছেন বাসস্ট্যান্ড। দাঁড়িয়ে থাকা কোনও বাসে উঠে অপেক্ষা করতে থাকি বৃষ্টি থামার।
কখনও ভাল একটা সেলুন করতে ইচ্ছে করে না? যেখানে এসি থাকবে। গদি দেওয়া চেয়ার থাকবে। টিভি থাকবে।
না, না...(বেশ জোর দিয়ে)
সেকী!... কেন?
(ঠোঁট দুটো একটু শক্ত হয়, মুখটায় আবেগ ভিড় করে আসে রামকৃষ্ণের) ওদের আছে গদি-টিভি-এসি। আমাদেরও আছে দাদা, অনেক কিছু। এই যে গাছের নীচে বসে চুল কাটাতে পারছেন, এটা কি কম, বলুন? আর কত সস্তায় সাফসুতরো হয়ে যাচ্ছেন ভাবুন একবার! টিভি-এসিতে বসিয়ে ওরা তো আপনার পকেট কেটে নিচ্ছে! (তারপর দুদিকে টাইপের কাজ করিয়েদের দিকে আঙুল দেখিয়ে) এই যে দেখছেন, এরা সব আমার ফিকসড কাস্টমার। আমায় কত ভালবাসে জানেন? পুজোয় আমাকে নতুন জামা দেয়, আমার ছেলেকেও দেয়। বউয়ের জন্য শাড়ি আনে। আমার মনটা ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল হয়ে যায়। বড়লোকের সেলুনে এত ভালবাসা আছে নাকি? থাকতেই পারে না। আর একটা কথা, যেমন আছেন, তাতেই খুশি থাকতে জানতে হয়, বুঝলেন না! আপনারা এসব বুঝবেন না, না!
রামকৃষ্ণের দু-চোখের কোনায় চিকচিকিয়ে ভেসে ওঠে মুক্তোর মতো দুটো জলবিন্দু।