Written By অনিরুদ্ধ সরকার
খুন হলেন ‘আমাজন অরণ্যের অভিভাবক’ পাওলো। মৃত্যু হল ‘গার্ডিয়ান্স অব দ্য ফরেস্ট’ বা ‘অরণ্যের অভিভাবক’ দলের সক্রিয় সদস্য পাওলোর। কে এই পাওলো? ব্রাজিলে আমাজন অরণ্যের ভূমি রক্ষা আন্দোলনকারী আদিবাসী নেতা ছিলেন পাওলো। শুক্রবার আমেরিকার মারানহো রাজ্যে আরারিবইয়া সংরক্ষিত অঞ্চলে ২৬ বছরের পাওলো পাওলিনো গুয়াজাজারাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করে অবৈধ কাঠুরেরা। পাওলোর অপরাধ সে জঙ্গলকে বাঁচাতে চেয়েছিল। সে বদ্ধপরিকর ছিল জঙ্গল রক্ষার কাজে। আমাজন রক্ষা করার চেষ্টায় ‘অরণ্যের অভিভাবক’ দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন পাওলো। নিহত আদিবাসী পাওলো তাঁর নিজের এলাকায় কাঠুরেদের চক্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছিলেন। আমাদের মত সিভিলিয়ানদের অবশ্য এনিয়ে বিশেষ ভাববার নেই। মাথা ব্যথা নেই। দিল্লির বাতাসে বিষ বাড়ছে। গাছ যত না লাগাচ্ছি তার থেকে বেশি কাটছি, কি – না আরও চারটে ফ্ল্যাট বাড়বে মল বাড়বে। কি আর করা যাবে। আমরা ওসব ভাবি না । কারণ আমরা মলে যাব, ফ্ল্যাটে থাকব আর জঙ্গল বেড়াতে যাব দু-চার দিনের জন্য। ব্যাস। জঙ্গল বা প্রকৃতি রক্ষার জন্য কোনও তাগিদ অনুভব করব না। আর যারা করবেন তাঁরা? মারা পড়বেন। পাওলোর অপরাধ তিনি আমাজনের জঙ্গলকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইরো বলসোনারো ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাঁর অরণ্য-নীতি একাধিক সমালোচনার মুখে পড়েছে। সংরক্ষিত এলাকায় চাষজমি, খনি খোঁজার ব্যাপারে অনুশাসন আলগা করেছেন তিনি, আর তাতেই মাথা চাড়া দিয়েছে খনি মাফিয়া আর জমি মাফিয়ারা। মাফিয়ারা অবাধে সাফ করে চলেছে অরণ্য। আর সেই সাফাইয়েরই বড় রূপ ‘আমাজনের অগ্নিকাণ্ড’। উপগ্রহ চিত্রও একই কথা বলছে, ‘এই আগুন প্রাকৃতিক নয়, ম্যানমেড’। এই হত্যাকাণ্ডের পর আমাজন সুরক্ষার দাবিতে আমাজন রক্ষাকারীদের আন্দোলন আরও বৃহত্তর আকার নেবে বলেই আশঙ্কা করছে প্রশাসন। কারণ এই ঘটনার পর রীতিমতো ফুঁসছেন আন্দোলনকারীরা। তাঁরা জানিয়েছেন, “সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ফাঁদ পেতে পাওলোকে হত্যা করা হয়েছে আমরা এর বিচার চাই।” সত্যি কথা বলতে কি অরণ্য আছে বলেই আদিবাসীরা বেঁচে আছেন। মনে পড়ে বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যকে’র কথা। বৃদ্ধ রাজা দোবরুপান্নার কথা। আর্য-অনার্যের সেই লড়াই। কিছু ক্ষমতালোভী দাম্ভিকের দাম্ভিকতার আগুনে নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি। আর যারা তাকে রক্ষা করতে চাইছেন তাঁরা সেই আগুনে পুড়ে ঝলসে যাচ্ছেন বা ছাই হয়ে যাচ্ছেন। বহির্জগতে আদিবাসীরা আজও ‘অনুন্নত’, ‘অশিক্ষিত’ বা ‘অসভ্য’ বলে পরিচিত। আমাদের দেশে তাঁদের উন্নতির জন্য নানান চেষ্টা করা হয়ে থাকে, ‘স্কিম’ দেওয়া হয় ভোট ব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে। ব্যাস ওটুকুই। সরকার খালাস। দায় শেষ। কিন্তু তাঁরা যেখানে থাকেন সেই জায়গা সংরক্ষণের ভাবনা ভাবা হয়? সম্ভবত না। আজও সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দর্শক মনোরঞ্জনের জন্য ‘জারোয়া’ দেখানো হয়। কারণ ওরা জঙ্গলে থাকে। আসলে জঙ্গলে বসবাসকারীদের জঙ্গল এই শিক্ষাটুকু দিয়েছে, যে প্রকৃতি না থাকলে মানুষও থাকবে না। অরণ্য না থাকলে তাঁরাও থাকবেন না। তাই অবৈধ কাঠুরেদের আমাজনে অনুপ্রবেশ রুখতে চেয়েছিল পাওলো। কড়া নজর রেখেছিল পাওলো ও তাঁর সঙ্গীরা। আমাজনে আগুন লাগার পর নতুন করে যাতে জঙ্গলের কেউ কোনও ক্ষতি না করতে পারে, সে জন্য জান লড়িয়ে দিয়েছিল পাওলোর মত জঙ্গল রক্ষাকারীরা। দিন-রাত এক করে রুখে দিয়েছিল, আগুন বাড়ানোর চক্রান্ত। আগুন লাগিয়ে আমাজন উজাড় করা শুরু হয়েছিল আগস্ট মাস থেকেই। তার পর থেকেই নিয়মমাফিক পাহারা দিতে শুরু করে পাওলো এবং তাঁর সঙ্গীরা। আমাজনের বিশাল এলাকার আগুনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার পর নড়েচড়ে বসে মার্কিন প্রশাসন। এদিকে বিচ্ছিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির উন্নতির জন্য গড়ে তোলা এনজিও ‘সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনালে’র রিপোর্ট অনুযায়ী, এর আগে ৩জন স্থানীয় আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়। আমাজনের পূর্বাঞ্চলে এই আদিবাসীদের এলাকাটি সংরক্ষণ ও সুরক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে একাধিকবার। তবে ব্রাজিলের আইনমন্ত্রী হের্গিও মোরো আশ্বাস দিয়েছেন তদন্তের।