Written By আশিস চট্টোপাধ্যায়
একেই বলে এক যাত্রায় পৃথক ফল। আপনি কি কোনো অপরাধ করেছেন? শাস্তি পেতে হতে পারে? ভয় পাবেন না, আপনি যদি হিন্দু হন, আপনার শাস্তি নামমাত্র। আর মুসলমান হলে শাস্তি দশ গুণেরও বেশি। অন্তত একটি ক্ষেত্রে মোদি সরকার এই বিধি চালু করেছে। সম্প্রতি কলকাতায় টেস্ট খেলতে এসে এই বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের একজন মুসলিম ক্রিকেটার। বিষয়টি খুলেই বলা যাক।
চলতি সপ্তাহের বুধবার রাজ্যসভায় সংখ্যাধিক্যে পাশ হয়ে গেল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। সারা দেশে এই আইনের সমালোচকরা সরব হয়েছেন এই কথা বলে যে, এটা ধর্মে ধর্মে বিভাজন ঘটাবে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব দেবার আইন অন্যদের থেকে আলাদা। কিন্তু সম্প্রতি খবর পাওয়া যাচ্ছে, এই আইন পাশ হবার আগে থেকেই ভারতে এমনই বিভাজন শুরু হয়ে গিয়েছিল।
জানা যাচ্ছে, প্রায় বছরখানেক আগে এ দেশের ভিসা আইনের বিধিতে গুরুত্বপূর্ণ বদল আনা হয়েছে। ব্যাপারটা এরকম — অন্য কোনো দেশ থেকে ভারতে বৈধ ভাবে আসতে গেলে ভারতের ভিসা প্রয়োজন হয়। ভিসা হলো ভারতে থাকার আইনি অনুমতিপত্র, যা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চালু থাকে। সেই সময়সীমার মধ্যে ভারত ছেড়ে চলে না গেলে ওই বিদেশি ব্যক্তিকে ফাইন দিতে হয়। এই ফাইন সংক্রান্ত বিধিতেই বদল আনা হয়েছে। কেমন বদল?
পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা আফগানিস্তান থেকে যদি এমন কোনো ব্যক্তি আসেন যে ওই দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান ইত্যাদি, তবে তাদের ফাইন দিতে হবে মাত্র ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। ৯০ দিন পর্যন্ত বেশি থাকার জন্য ১০০ টাকা, ৯০ দিন থেকে ২ বছর পর্যন্ত ২০০ টাকা আর দু’বছরের বেশি সময় থেকে গেলে ৫০০ টাকা। কিন্তু ব্যক্তিটি যদি মুসলিম হন? তাহলে ৯০ দিন পর্যন্ত বেশি থাকার মাশুল গুণতে হবে ৩০০ ডলার বা আজকের হিসেবে প্রায় ২১ হাজার টাকা, ৯০ দিন থেকে ২ বছর পর্যন্ত বেশি থাকলে ৪০০ ডলার বা প্রায় ২৮ হাজার টাকা, আর দু’বছরের বেশি হলে গুণতে হবে ৫০০ ডলার বা ৩৫ হাজার টাকা। ফাইনের পরিমাণটা লক্ষ করলেই বোঝা যাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কী ভাবে ধর্মীয় কারণে বাড়তি শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে।
এই নয়া বিধি আড়ালেই ছিল এতদিন। যারা ফাইন দিতে বাধ্য হয়েছেন, যেভাবে হোক ফাইন দিয়ে চলে গেছেন। কিন্তু গোল বাঁধল কলকাতায় পিংক টেস্টের সময়। ২২ নভেম্বর ২০১৯ শুরু হওয়া ঐতিহাসিক এই টেস্টে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সেই সময়েই বাংলাদেশের ক্রিকেটার সইফ হাসান ভিসার থেকে বেশি সময় থাকার কারণে বিপুল ফাইনের সম্মুখীন হন। তার মানে, কেবল মুসলিম হওয়ার কারণেই সইফকে অত টাকা ফাইন দিতে হয়। ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে, বাংলাদেশের অন্য একজন ক্রিকেটার লিটন দাস যদি কয়েকদিন বেশি থাকেন, তাঁকে ফাইন দিতে হবে ১০০ টাকা, আর ওই একই সময়কাল বেশি থাকার জন্য সইফকে গুণতে হবে ২১ হাজার টাকা। ব্যাপারটা নিয়ে কলকাতাস্থ বাংলাদেশের হাইকমিশনের কর্তারা বেশ অসন্তুষ্ট। সূত্র মারফত জানা যাচ্ছে, মাত্র কয়েকদিন আগে একজন দরিদ্র মুসলমানের ফাইনের টাকা তুলতে রীতিমতো চাঁদা তুলতে হয়েছে হাইকমিশনের কর্মীদের।
বিদেশিদের ভারতে থাকা সংক্রান্ত কাজের দায়িত্বে যে অফিস, তার নাম ফরেন রিজিওন্যাল রেজিস্ট্রেশন অফিস বা এফআরআরও। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ফাইনের তালিকা দেখতে গিয়েই দেখা গেল, সোজাসাপটা ভাষায় লেখা আছে ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যের বিষয়টি। প্রশ্ন উঠছে, এটা জানা গেল, তাই কথা হলো, আরও কত কত ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গেছে, কে জানে!