Written By অনিরুদ্ধ সরকার
কোচবিহার রাজবাড়ি
শীতের ভ্রমণের প্রথমেই আজ কোচবিহারের কথা-
কোচবিহারঃ কোচবিহারের ‘কোচ’ শব্দটি এসেছে কোচ রাজবংশ থেকে। আর ‘বিহার’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার বিহার বা পরিভ্রমণ থেকে। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত শাহজাহাননামা গ্রন্থে কোচবিহার নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মেজর রেনেলের মানচিত্রে কোচবিহার ‘বিহার’ নামে উল্লিখিত হয়। ১৭৭২ সালে ভুটানের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে কোচবিহার-রাজ ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে কোচবিহার ব্রিটিশদের একটি করদ রাজ্যে পরিণত হয়। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে রাজ্যটি "কোচ বিহার" নামে পরিচিত হয় । ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে শুরু করে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকাল অবধি পুরনো বহু স্মৃতির সাক্ষী এই কোচবিহার। অতীতের উত্তরবঙ্গের একমাত্র পরিকল্পিত নগর ছিল এই কোচবিহার। সাজান-গোজানো-পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন।আজও তাই। এই জেলায় প্রকৃতি উদারহস্ত তার নৈবেদ্য নিয়ে। না শীত না গ্রীষ্মের জেলা কোচবিহার। অক্টোবর থেকে মার্চ হচ্ছে কোচবিহার বেড়াতে যাওয়ার সবচেয়ে ভাল সময়। তবে যেহেতু এখানে খুববেশি গরম পড়ে না তাই অন্য সময়েও যাওয়া যায়। ১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে রোমের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার আদলে তৈরি হয়েছিল কোচবিহার রাজবাড়ি। প্রধানত ইট-বালি-সুড়কি দিয়ে তৈরি প্রাসাদটি। রাতের আলোয় এক মোহময় পরিবেশ তৈরি করে রাজপ্রাসাদটি। একে ঘিরে রয়েছে নানান গ্লপ-গাথা। রাজার আগ্রহে রোমান গথিক শৈলী ফুটিয়ে তোলা হয় সেই বিশাল প্রাসাদে। চার হাজার মিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে অবস্থিত প্রাসাদটির উচ্চতা ১২৪ ফুট। প্রাসাদের ভিতর রয়েছে শয়নকক্ষ, বৈঠকখানা, ডাইনিং হল, বিলিয়ার্ড হল, গ্রন্থাগার ইত্যাদি। তা ছাড়াও, সেখানে দেখতে পাওয়া যায় পুরনো দিনের আসবাব এবং নানা সামগ্রী। কোচবিহারের রাজবাড়ির ইতিহাস জানতে আজও বহু মানুষ ভিড় করেন। কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণের লেখা চিঠিই ছিল প্রথম গদ্যে লেখা নিদর্শন। মহারানি গায়ত্রী দেবীর জন্মস্থানও কোচবিহার। রাজাদের সেই যুগ আর নেই। রাজবাড়ি এখন কোচবিহারের অন্যতম আকর্ষণ। এ ছাড়াও এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশও মুগ্ধ করার মতো। কোচবিহাকে ঘিরে রয়েছে বিস্তর ইতিহাস। আর রয়েছে এখানকার বিখ্যাত মদনমোহন মন্দির। মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রীরা হলেন, মদনমোহন, তারা মা, কালী মা, মা ভবানী। মন্দির দেখতে খুব সুন্দর। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন এই মন্দির তৈরি করেন ১৮৮৫-৮৭ সালে। রাসপূর্ণিমায় এখানে বসে রাসমেলা, রাসয়াত্রা। উত্তরবঙ্গের এটি অন্যতম বড় উৎসব। প্রায় ২০০ বছর ধরে একইভাবে চলছে এই উৎসব। শোনা যায় ভৌতিক উপদ্রবের কারণে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহার রাজ্যের ভেটাগুড়িতে চলে যান মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ। ১৮১২ সালে রাস পূর্ণিমার দিন ভেটাগুড়ির রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছিলেন কোচবিহারের রাজা হরেন্দ্রনারায়ণ। আর সেই উপলক্ষে বসেছিল প্রথম রাসের মেলা। পরে কোচবিহারের রাজপ্রাসাদ এলাকায় স্থানান্তরিত হয় এই মেলা। কথিত আছে, ১৯১১ সালে রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের সময়কালে অসম থেকে এখানে এসেছিলেন বৈষ্ণব গুরু শঙ্করদেব। উত্তরবঙ্গের প্রায় সব জেলা, এমন কি আসাম থেকেও বহু মানুষ অংশ নেন এই উৎসবে। শহরের মধ্যেই রয়েছে বিশাল সাগরদিঘি। এর বিশালত্বের কারণে এর নাম হয়েছে সাগরদিঘি। শীতে গেলে দেখা পাবেন পরিযায়ী পাখিদের। ঘুরে ঘুরে দেখে নিন বাণেশ্বর মন্দির। শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। মন্দিরের অধিপতি শিব। এখানে শিবলিঙ্গের অবস্থান, মন্দিরের গর্ভগৃহে, যা সমতল থেকে ১০ ফুট নীচে। মদন চতুর্দশি ও দোলপূর্ণিমায় ভক্তরা এই মন্দির থেকে শোভাযাত্রা করে মদনমোহন মন্দির পর্যন্ত যান। এই মন্দির ঘিরে অনেক পকুর রয়েছে। পুকুরগুলিতে প্রচুর কচ্ছপ দেখা যায়। রাজার শহর কোচবিহার। সেখান থেকে বাসে এক ঘণ্টার পথ দিনহাটা। কোচবিহারের জেলা-সদর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে দিনহাটা। সেখানকার প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত ‘চৌপথি’। সেখান থেকে সড়ক পথে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে গোসানিমারি গ্রাম। খননের পর মিলেছে একাধিক নিদর্শন। পাল ও সেন রাজত্বকালে এই অঞ্চল ছিল কামরূপ বা কামতাপুর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। রাজ্য। খনন করে মিলেছে কামতাপুর রাজবাড়িরই অংশ। মিলেছে মুঘল আমলের মুদ্রা। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার মতে এই ঢিবির তলায় লুকিয়ে রয়েছে কামতাপুরের খেন রাজাদের মূল কামতেশ্বরী মন্দির। গোসানিমারি থেকে কিছু দূরেই কামতেশ্বরী মন্দির। যাকে স্থানীয়রা ‘গোসানি দেবীর মন্দির’ বলে। মূল মন্দিরটি এখনও মাটির তলায়। এই মন্দির ১৬৬৫ সালে নির্মাণ করেছিলেন কোচবিহারের মহারাজা প্রাণনারায়ণ। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এই মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বারের ওপর নহবতখানা। মূল মন্দিরের সামনের নাটমন্দিরে পুজো ও হোম-যজ্ঞ হয়। আর হাতে সময় থাকলে দেখে নিতে পারেন লৌকিক দেবতা মাশান ঠাকুরের মন্দির। ইনি উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজের আরাধ্য দেবতা। দেখতে কতকটা শিব ঠাকুরের মতো, তবে জটা-ত্রিশূল-ডমরু কিছুই নেই। দু-হাত বিশিষ্ট এই দেবতার এক হাতে গদা। দিনহাটা ছাড়া মাথাভাঙা ও মেখলিগঞ্জেও এই দেবতা প্রচলিত। কোচবিহার শহরটি ১ দিন বা ১/২ দিনের মধ্যেই আপনি ঘুরে ফেলতে পারবেন। আর হাতে যদি আর একটু সময় থাকে তাহলে কিন্তু অনায়াসে ঘুরে আসতে পারেন জলদাপাড়া জঙ্গল বা রাজাভাতখাওয়া জঙ্গল। আর চাইলে একরাত কিন্তু জঙ্গলেও কাটাতে পারেন। করে ফেলতে পারেন বেশ রোমাঞ্চকর জঙ্গল সাফারি, তাও আবার হাতির পিঠে চড়ে।
কীভাবে যাবেনঃ
ট্রেনে করে আপনি কোচবিহার পৌঁছতে পারেন। শিয়ালদহ কিম্বা হাওড়া থেকে আপনি বেশ কয়েকটি ট্রেন পাবেন যেমন তিস্তা তোর্সা, কামরূপ, উত্তরবঙ্গ ট্রেন তো পাবেনই। এছাড়া মোটামুটি সমস্ত গুয়াহাটি গামী ট্রেনগুলি কোচবিহারের ওপর দিয়েই যায়। এছাড়া আপনি যদি প্লেনে যেতে চান তাহলে বাগডোগরাতে নামতে হবে আপনাকে। তারপর গাড়ি বুক করে যেতে পারেন কোচবিহার। আর সড়কপথে কলকাতা সহ বিভিন্ন জেলা থেকে সরকারি ও বেসরকারী প্রচুর বাস চলছে কোচবিহার পর্যন্ত।
কোথায় থাকবেনঃ
কোচবিহারে থাকার খরচ খুব একটা বেশি নয়। ৪০০ টাকা থেকে ৩৫০০ টাকা অবধি হোটেল কিম্বা লজে আপনি থাকতে পারেন।