Written By অনিরুদ্ধ সরকার
হাতে যদি থাকে দু-এক দিন তাহলে এই শীতে চলুন উত্তরবঙ্গ। একনজরে দেখে নেওয়া যাক উত্তরবঙ্গের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গার অন্দরের খবর। আজ ডুয়ার্সের কথা।
ডুয়ার্স
‘ডুয়ার্স’কথার অর্থ দুয়ার বা দরজা। ব্রিটিশ আমলে উত্তরবঙ্গের এই জায়গার নাম হয় ডুয়ার্স। প্রকৃতির সৌন্দর্য তো আছেই, তাছাড়াও সেখানে রয়েছে চাপরামারি, গজলডোবা, বক্সা টাইগার রিসার্ভ, বক্সা ফর্ট, গরুমারা জাতীয় উদ্যান, চেলসা, জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান, রাজাভাতখাওয়া, বিন্দু, হাসিমারা, গোঁরবাতান, ঝালংয়ের মতো সুন্দর জায়গা। পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশের পশ্চিমবঙ্গ ও অসম নিয়ে গঠিত ডুয়ার্স। ডুয়ার্স দ্বারা ভুটান ও ভারতের মধ্যে যোগাযোগ সম্পন্ন হয়। এই অঞ্চল ভুটান তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার। এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা ১৫০-১৭০০ মিটারের মধ্যে। হিমালয়ের পাদদেশ তথা সমভূমি ও পর্বত অঞ্চলের মিলনস্থানে ডুয়ার্স এর অবস্থান। ডুয়ার্সকে সংকোশ নদী দুই ভাগে ভাগ করেছে। এই নদীর পূর্বের অংশকে বলা হয় পূর্ব ডুয়ার্স বা অসম ডুয়ার্স এবং পশ্চিমের অংশকে বলে পশ্চিম ডুয়ার্স বা পশ্চিমবঙ্গ ডুয়ার্স। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার এবং অসমের ধুবড়ি, কোকড়াঝাড়, বরপেটা, গোয়ালপাড়া ও বঙাইগাঁও জেলা নিয়ে ডুয়ার্স অঞ্চল গঠিত। এই অঞ্চলের নদীগুলি হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট বলে নদীতে সারাবছর জল থাকে। প্রধান নদীগুলি হল তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, মহানন্দা, কালজানি, বালাসন প্রভৃতি। ডুয়ার্সের অফ-সিজন একমাত্র বর্ষা। ১৫ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জঙ্গল বন্ধ থাকে। ডুয়ার্সকে যদি সত্যিই তার আসল রূপে দেখতে হয়, তা হলে বর্ষার তুলনা নেই কিন্তু ডুয়ার্সে ভিড় থাকে মূলত শীতে। সবুজ প্রকৃতির মাঝে বর্ষার সময় ভিড়ভাট্টা একদম পাবেন না, উল্টে হোটেল-লজ-রিসর্টে পাবেন বিশেষ ‘মনসুন’ ছাড় কিন্তু শীতে একেবারে উলটো।
কি কি দেখবেন ডুয়ার্সে-
জলদাপাড়া -ডুয়ার্স ভ্রমণের কথা উঠলেই প্রথমেই এসে যায় জলদাপাড়ার নাম। বুড়ি তোর্সা, তোর্সা,কালিঝোরা, হলং নদীর চারপাশে শাল,শিশু,গামার, খয়েরের ঘন জঙ্গলে দেখা মিলতে পারে চিতল,গাউর,সম্বর, বুনো হাতির দলের। নলখাগড়ার ঘাস জমিতে মিলতে পারে ডুয়ার্সের বিখ্যাত একশৃঙ্গ গণ্ডারের। সব মিলিয়ে আপনার ডুয়ার্স সফর জলদাপাড়া থেকেও শুরু করতে পারেন। বরদাবাড়ি-হাসিমারা থেকে খুব কাছে শাল,সেগুন আর গামারের জঙ্গলে ঘেরা অরণ্য ঠিকানা বরদাবাড়ি। এখানে মালঙ্গি বনবাংলোয় কাটাতে পারেন একটি দুটি রাত্রি। বন বাংলোর ঠিক পেছনেই এলিফ্যান্ট রাইডিং পয়েন্ট । টিকিট কেটে চড়ে বসুন হাতির পিঠে আর ক্যামেরা তৈরি রাখুন আচমকা চোখে সামনে চলে আসা গণ্ডার বা বুনো হাতির পালের ফাস্ট ক্লিকের জন্যে। ২৮মাইল- আলিপুরদুয়ার থেকে পাক্কা ২৮ মাইল দুরের অবস্থিত হওয়ার জন্য এই গ্রামের নাম ২৮ মাইল। একদিকে বালা নদী অন্যদিকে সামান্য দূরে জয়ন্তী নদী। এখান থেকে সামান্য পাহাড়ি পথ পেরিয়ে দেখে নিতে পারেন বক্সা দূর্গ। লোকাল ট্যুরে ঘুরে দেখতে পারেন জয়ন্তী। দূরে ঢেউ খেলানো ভুটান পাহাড় আর জ্যোৎস্না রাতে ডলোমাইটে সাদা জয়ন্তী নদীর বুকে খাসি পাহাড়ের মায়াবী ছায়া সে এক স্বপ্নের দেশে পৌঁছে দেবে আপনাকে। গরুমারা জাতীয় উদ্যান ( লাটাগুড়ি)-মালবাজার,চালসা হয়ে পৌঁছে যেতে পারেন লাটাগুড়িতে। দুপাশে চায়ের বাগান শেষ হলেই বেশ কয়েক কিলোমিটার জঙ্গলের পথ পেরিয়ে গরুমারা জাতীয় উদ্যান। তবে জঙ্গলের পথ পেরোনোর সময় খুব সাবধান। একেরপর এক অ্যানিমেল পাসিং করিডোর দিয়ে আচমকা সামনে এসে যেতেই পারে বুনো হাতির পাল অথবা এক পাল বাইসন। এখানে দিন দুয়েক থেকে জীপ সাফারি করে দেখে নিতে পারেন -যাত্রাপ্রসাদ, চুকচুকি, চন্দ্রচূড়, মেদলা, রাইনোপয়েন্ট ওয়াচটাওয়ার। সাফারি করার জন্য খুব সকালে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে লাইন দেওয়া প্রয়োজন। ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা মিলতেই পারে গণ্ডার, হাতি,বাইসন অথবা নানান রঙের ময়ূরের। সারাদিন চারটি পর্বে জঙ্গল সাফারি হয়ে থাকে। কালিপুর ইকো ক্যম্প- ডুয়ার্সের ঘন জঙ্গলে একটি স্মরণীয় রাত কাটাতে চলে যেতে পারেন লাটাগুড়ি থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কালিপুর ইকো ক্যাম্পে। প্রথমে বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত এবং তার পরে চা বাগানের মধ্যদিয়ে পৌঁছে যান কালিপুর ইকো রিসোর্টে। চা -বাগান আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা রিসোর্টে গা ছম ছমে একটি রাত আপনার সারাজীবনের স্মৃতির সঙ্গী হয়ে থাকবে। কয়েক পা হেঁটেই চলে যেতে পারেন মেদলা ওয়াচ টাওয়ারে। ইকো ক্যাম্পের অতিথিদের জন্য কোন প্রবেশ মূল্য লাগেনা। রাতে অ্যডভেঞ্চার করুন প্রাণভরে আর পড়ে কাকভোরে হাতির পিঠে চেপে মূর্তি আর জলঢাকা নদী পেরিয়ে ঘুরে আসুন ঘাসের বনে গণ্ডারে বিচরণ ভূমিতে। ২৪ ঘন্টার প্যাকেজে আস্ত একটি অরণ্য ভ্রমন আপনার ভালো লাগবেই। জয়ন্তী- সকালে প্রথমে চলে যান ফুন্টশেলিং। খারবন্দি পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত বৌদ্ধ গুম্ফা দর্শন করে ফেলুন। দুপুরের খাওয়া সারুন ফুন্টশোলিংয়েই। বিকেলে জয়ন্তী পৌঁছন। নদীর ধারে পায়েপায়ে বেড়িয়ে নিন। চাইলে রাত্রিবাস করুন জয়ন্তীতে। ভোরে বক্সা জঙ্গল বেড়িয়ে এসে ব্রেকফাস্ট সেরে বক্সা দুর্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিন। গাড়িতে সান্তালাবাড়ি পৌঁছে শেষ ৫ কিলোমিটার রাস্তা ট্রেকিং। ফের রাত্রিবাস জয়ন্তীতেই। ভোরে পুখরিপাহাডের পথে চলুন। ২ কিলোমিটার ট্রেকিং। দুপুরে ফেরার পথে রাজাভাতখাওয়া নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার বেড়িয়ে নিয়ে আলিপুরদুয়ার পৌঁছে যেতে পারেন। জয়ন্তী থেকে যাওয়া যায় ভুটানঘাট। হাতিপোতা হয়ে ভুটানঘাট এখনও পর্যটকদের ভিড়ে জমজমাট। তবে শীতের সময়টা বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে। বক্সা ফোর্ট- বক্সায় যে দুর্গ ছিল এক সময়, অধুনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত সেই দুর্গে এক সময় অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। চাইলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’ বইয়ের ‘মেঘের গায়ে জেলখানা’ পড়ুন। বক্সা যেতে আগেও যেমন দুর্গম পথ ধরে যেতে হত, এখনও পথ প্রায় তেমনই দুর্গম। ঘন অরণ্যে ঢাকা দুই পাশ। মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে বক্সা যাওয়ার রাস্তা। দিনের বেলাও গা ছমছমে ভাব। বন্য পশুর আক্রমণের ভয় তো আছেই; তা ছাড়া ডাকাতি, ছিনতাইয়েরও আশঙ্কা রয়েছে। আগে বক্সা জঙ্গলে ঢোকার আগে ভাবতে হত কিন্তু এখন ভ্রমণপিপাসুরা আর বিশেষ ভাবেন না। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার আগ্রহে তাঁরা বেরিয়ে পড়েন। সামসিং- ডুয়ার্সের সামসিং ইদানিং বেশ জনপ্রিয়। শিলিগুড়ি হয়ে গাড়িতে যাওয়া যায় সামসিং। ছোট এই পাহাড়ি জায়গাটা প্রকৃতিপ্রেমিকদের কাছে স্বর্গ। সামসিং বেশ শান্ত। শহরের গোলমাল, ধুলো-ধোঁয়া থেকে দূরে, নিশ্চিন্তে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আদর্শ জায়গা। পাহাড়ি জায়গা। ছোটখাটো ট্রেক সেরে নিতে পারেন। পথে পড়বে ছোট ছোট ঝরনা। পাহাড়ের গায়ে সুন্দর চা-বাগান। চোখ জুড়িয়ে দেওয়ার মতো দৃশ্য! জঙ্গলে দেখতে পাবেন নানান ধরনের পাখি আর প্রজাপতি।
কীভাবে যাবেন
প্লেনে গেলে নামুন বাগডোগরা এয়ারপোর্টে।পরে শেয়ার গাড়ি করে নির্দিষ্ট জায়গাগুলি ঘুরে দেখুন।ট্রেনে গেলে নিউ মাল জংশন কিম্বা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। গাড়িতে শিলিগুড়ি, তারপর একে একে ঘুরে দেখুন জায়গাগুলি। প্যকেজ টুরে ট্রাভেলসের গাড়িও বুক করে নিতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
৬০০ থেকে ৬০০০ এর মধ্যে লজ এবং হোটেল পাবেন। সরকারি বনবাংলো পেতে হলে আগে থেকে বুকিং করে নিতে হয়। এছাড়া গড়ে উঠেছে হোম-স্টে।