Written By অনিরুদ্ধ সরকার
লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ
আজ পঞ্চম পর্বে নিরিবিলিতে প্রকৃতিকে খোঁজার পালা। নির্জিনে একাকী হারিয়ে যাওয়া দুটো দিনের গল্প। মনের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিন এই পথে। সঙ্গে নিয়ে যা ফিরবেন তা সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে।
লাভাঃ নিরিবিলিতে পাহাড়ে দুটো দিন কাটাতে চাইলে আপনার গন্তব্য হওয়া উচিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ। নেওড়াভ্যালি জাতীয় উদ্যানের উদ্ধত পাইনের বন এসে মিশেছে এখানকার পাহাড়ের ঢালে। আর তারই মাঝে সারি সারি দেশলাই বাক্সের মত বাড়ি। অনবরত মেঘ-কুয়াশার আনাগোনা। লাভার কাছেই লাভা মনাস্ট্রি। সুন্দর গুম্ফায় লামাদের স্কুল। সুন্দর মনাস্ট্রি, মেঘমুক্ত আকাশে এই গুম্ফার বারান্দা থেকে হিমেল পর্বতশ্রেণীদের দেখা মিলবে। লাভা থেকে ৩ কিমি দূরে শেরপা ভিউপয়েন্ট। রেচেলা লা, জেলেপ লা-সহ নানা শৃঙ্গরাজের দেখা মেলে। লাভা থেকে নানা আকর্ষণীয় ট্রেকরুট রয়েছে। তবে যাঁরা হাল্কা ট্রেক পছন্দ করেন তাঁরা অনায়াসে ঘুরে আসতে পারেন ছাঙ্গে ফলস। পাইন, দেবদারু ঘেরা পথের বাঁকে বাঁকে শুধুই রোমাঞ্চ আর অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানি। প্রতি মুহূর্তে নানা বন্যপ্রাণীর আনাগোনা। মাঝে মাঝে কুয়াশা এসে জড়িয়ে ধরবে আপনাকে। মায়াময় পথে পাখির কলতান শুনতে শুনতে পৌঁছে যান সুন্দর ঝর্নার কাছে। নাম, ছাঙ্গে ফলস। সিকিমে আছে ছাঙ্গু লেক আর লাভায় ছাঙ্গে ফলস। সূর্যের আলোকমালা ঝর্নার গায়ে রামধনু তৈরি করে। কুয়াশা ও মেঘে ঢাকা পাইন গাছে ঘেরা এই ছোট্ট গ্রামটি কালিম্পং থেকে খুব কাছে। ভূটানের সঙ্গে বাণিজ্যের পুরনো পথের মধ্যে অবস্থিত গ্রামটির উচ্চতা ২৩৫০ মিটার। এখানে একটি বৌদ্ধ মন্দির ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রও রয়েছে। প্রকৃতিকে প্রাণ ভরে উপভোগ করুন। পাখি দেখার জন্য অনেকে লাভা আসেন। নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে ওঠার সূচনা এই লাভা। শিলিগুড়ি থেকে সেবক ব্রিজ পেরিয়ে ডামডিম-গরুবাথান হয়েও আসা যায় লাভা। আকাশে মেঘ না থাকলে আর ভাগ্য প্রসন্ন হলে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সুর্যোদয় লাভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। মূল শহর ছাড়িয়ে জঙ্গলের নিরিবিলি পথে ঘুরে বেড়ালেও আপনার মন তরতাজা জয়ে উঠবে।
লোলেগাঁওঃ আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে প্রায় ২৪ কিমি দূরে পাইন, ফার, জুনিপার আর ক্রিপ্টোম্যানিয়ার বনের ছায়ায় আরও এক পাহাড়ি গ্রাম লোলেগাঁও। কালিম্পং-এর ছোট্ট, শান্ত গ্রাম লোলেগাঁও। অপূর্ব সুন্দর এখানকার পরিবেশ। ঘন সবুজ অরণ্য এবং শান্ত উপত্যকার লোলেগাঁওকে প্রকৃতি অকৃপণ হাতে দান করেছে। ভোরের কুয়াশায় মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কালিম্পং ও লাভা থেকে পাইনের জঙ্গলে ঘেরা আঁকাবাঁকা পথ ধরে লোলেগাঁও চলুন। সফরের এক ঘণ্টা কাটবে বেশ আনন্দে। এখানকার বনবাংলোর বারান্দায় বসে দূরের কালিম্পং শহর দেখেই আপনার সময় কেটে যাবে। সন্ধ্যে নামলে এখানকার অপরূপ দৃশ্য আপনাকে মোহিত করে দেবে। মনে হবে অগুনতি জোনাকি দীপ জ্বালিয়ে রেখেছে পাহাড়চুড়োয়। ঘরের ব্যালকনিতে বসেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় দিব্যি। ভোরের সূর্যোদয় আর রাতে তারায় ভরা আকাশ আপনাকে মুগ্ধ করবে। নীচের বিস্তৃত উপত্যকার দিকে তাকালে মনে হবে যেন মশাল জ্বলছে। আপনি মিল খুঁজে পাবেন উত্তরাখণ্ডের যোশীমঠ কিম্বা চমোলির সঙ্গে।
রিশপঃ কালিম্পং অঞ্চলের সেরা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে মানা হয় রিশপ-রিম্বিককে। রিশপ লাভা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে এবং কালিম্পং থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে ৮২৫০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। লাভা থেকে পাহাড়ি পথে ট্রেকিং করে পৌঁছনো যায় ‘রিশপ’ শব্দের অর্থ ‘পাহাড়ের মাথায় একলা গাছ’। লাভা থেকে রিশপ পর্যন্ত জিপে গেলে সে অভিজ্ঞতার মজা আলাদা। রিশপের রাস্তা এখনও কাঁচা। বিদ্যুৎ এখনও পৌঁছনি সর্বত্র, এখানে থাকার মধ্যে একটা মধ্যযুগীয় অনুভূতির মজা আছে। অপার সৌন্দর্যের আধার রিশপ। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা একেবারে কাছে। স্থানীয় শেরপা ও লেপচারা কটেজের মতো বেশ কিছু পর্যটকদের থাকার জায়গা বানিয়েছেন। নাথুলা পাস, তিন সীমানা, গ্যাংটক, তিব্বতের পাহাড়গুলি সহ এখান থেকে হিমালয়ের অসাধারণ দৃশ্য চোখ পড়ে। রিশপ এখনও এক পাহাড়িয়া গ্রাম, যে গ্রামের প্রতিটি বাড়ির বারান্দায় শোভা পায় রঙিন ফুল আর নানান অর্কিড। আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে আকাশে হিমালয়ের হিমকন্যাদের দর্শন মেলে। ৮,৫০০ ফুট উচ্চতায় নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত এই পাহাড়ি গ্রামে প্রচুর পাখি আর আকাশের ক্যানভাসে একফ্রেমে কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ নানা অল্প চেনা শৃঙ্গের দেখা মেলে। সুন্দর সূর্যোদয় দেখতে হলে প্রায় ২ কিমি জঙ্গল ট্রেকে চলে যান টিফিনদারা ভিউপয়েন্টে। রিশপের সূর্যোদয় আপনার স্মৃতিতে সারা জীবন তাজা থাকবে। শহর- নগর ছাড়িয়ে প্রকৃতিকে প্রাণ ভরে উপভোগ করতে দুটো দিন হারিয়ে যান লাভা-লোলেগাঁও আর রিশপের পথে পথে।
কীভাবে যাবেন: লাভা’র সবচেয়ে কাছের রেলওয়ে স্টেশন নিউ মাল জংশন। কালিম্পং ও লাভা থেকে পাইনের জঙ্গলে ঘেরা আঁকাবাঁকা পথ ধরে লোলেগাঁও যেতে ১ঘণ্টা সময় লাগে। কালিম্পং থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লাভা ।রিশপ লাভা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে এবং কালিম্পং থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে । গাড়ি নিয়ে লাভা হয়ে রিশপ যেতে পারেন। অথবা ট্রেন কিম্বা বাসে নিউ জলপাইগুড়ি গিয়ে সেখান থেকেও গাড়ি বুক করে সরাসরি লাভা যেতে পারেন ও পরে রিশপ পৌঁছতে পারেন। প্লেনে যেতে চাইলে বাগডোগরায় নামুন তারপর বাকী রাস্তা গাড়ি বুকিং করে নিতে পারেন অথবা গাড়ি শেয়ার করে নিতে পারেন।
কোথায় থাকবেন: থাকার জন্য লাভায় আছে ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের বাংলো সহ নানা বেসরকারি হোটেল।পাহাড়ের গায়ের ধাপে বেশ কয়েকটা রিসর্ট তৈরি হয়েছে রিশপে। যেগুলোর বেশিরভাগ থেকেই সানরাইজ ভিউ পাওয়া যায়। রয়েছে হোম স্টে’র ব্যবস্থাও। খরচ ৮০০- ১৫০০ মাথাপিছু।