Written By অনিরুদ্ধ সরকার
ভারতের বিখ্যাত ভূতুড়ে বাংলো মরগ্যান হাউস
“আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ / জানে তা কি এ কালিম্পঙ”- এ কবিতা রবিঠাকুরের। আর রবি ঠাকুর বড্ড ভালোবাসতেন এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরটিকে। তাই কালিম্পঙে নেমে প্রথমেই চলুন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য ‘গৌরীপুর হাউসে’। এই গৌরীপুর হাউস অতীত কালিম্পঙের অন্যতম সুন্দর একটি ভবন। ময়মনসিংহ-র গৌরীপুর এস্টেটের জমিদার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ রায়চৌধুরী এটি নির্মাণ করিয়েছিলেন । অনেক বিখ্যাত মানুষ কালিম্পঙে এসে এই বাড়িতে আতিথ্য পেয়েছেন। হিমালয় পর্বতমালা বরাবরই রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণের প্রিয়তম স্থান, এখানে এলে রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িতেই থাকতেন । সুন্দর একটি ভারতীয় ও পাশ্চাত্য মিশ্ররীতিতে প্রস্তুত সাদা দোতালা বাংলোবাড়ি । একাধিক ব্যালকনির রেলিঙে পাথরে জাফরির কাজ। সামনের নির্জন উপত্যকা ছাড়িয়ে অবাধ শূন্যতা আর পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে অনন্ত আকাশ, মুগ্ধ করেছিল কবিকে। এই বাড়িরই একটি ঘরে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ । আজও সেই ফায়ার প্লেস, পুরনো আসবাব আপনাকে ভাবাবে। গৌরীপুর হাউস ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে বেশ নিবিড়। এই ভবন থেকেই ১৯৩৮ সালের ২৫ বৈশাখ আকাশবাণীর বেতার-তরঙ্গে কবি তাঁর বিখ্যাত ' জন্মদিন ' কবিতাটি পাঠ করেন।
এবার পায়ে পায়ে চলুন মরগ্যান হাউস। এই বাংলোটি ভারতের অন্যতম বিখ্যাত ‘ভূতুড়ে বাংলো’ বলে পরিচিত। পেল্লায় সাহেব বাংলোটির বয়স একশোর দোরগোড়ায়। দুরপিনদাঁড়া পাহাড়ের টঙে, সবুজে মোড়া লনের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে মরগ্যান হাউস। সবুজ লনের চারপাশে নানা বাহারি ফুল। পায়রার বকবক বকম। আর লনের এককোণে গেলেই দেখা যাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বাংলোটাকে প্রথম দেখলে, ছ্যাঁত করে উঠবে বুকটা। ভূতে বিশ্বাস করুন বা না করুন,মরগ্যান হাউসের পরিবেশ কিন্তু গা ছমছমে। গেট ছাড়িয়ে ঢুকলেই মনে হবে একটা ভূতুড়ে পোড়ো বাড়িতে আপনি পা রাখছেন। বাড়ির গা জুড়ে শিকড়-বাকড়, লতানে গাছের সারি। ব্রিটিশ কাঠামোর বাংলো। পাথুরে দেওয়াল। মনে হবে ব্রিটেনের কোনও কাউন্টিতে পৌঁছে গেছেন আপনি। ভয়টা কাটার সম্ভাবনা কিন্তু কম। এবার একটু জেনে নেওয়া যাক এই ভূত বাংলো সম্পর্কে। শোনা যায়, ১৯৩০ সালে এই বাংলো তৈরি করেছিলেন জর্জ মরগ্যান। মরগ্যান সাহেবের ছিল পাটের ব্যবসা। অগাধ টাকার মালিক মরগ্যানের সেযুগে ক্ষমতা-প্রতিপত্তিও নেহাত কম ছিল না। কালিম্পং শহর তখন অনেকটাই ছোট। লোকজন কম, প্রকৃতি আরও উদার-মুক্ত। প্রথমবার এসেই প্রেমে পড়ে গেলেন! মরগ্যান সাহেব বানালেন বাংলো। আর স্ত্রীকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই এসে উঠতে লাগলেন এই বাংলোয়। গ্রীষ্মে তো বটেই সারা বছরই মরগ্যান সাহেব তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে কাটাতে লাগলেন দিন। একসময় মারা গেলেন মরগ্যান, দেখতে দেখতে তার প্রিয়তমাও চোখ বুজলেন। নিঃসন্তান দম্পতি কোনো উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারলেন না এই বাংলোর। ফলে, এই বাংলো চলে গেল ভারত সরকারের হাতে। ১৯৬২-তে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু যখন অসুস্থ, ঠিক হল এই বাংলোটিকেই সরকারি রেস্ট হাউসে পরিণত করা হবে। নেহরুজি থাকবেন, পাহাড়ি আবহাওয়ায় সেরেও উঠবেন দ্রুত। কিন্তু, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই নেহরুর মৃত্যু হয়। পরে ১৯৭৫ সাল নাগাদ এই বাংলো পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দফতরের হাতে আসে। তারও পরে ‘মরগ্যান হাউস’ কালিম্পঙের অন্যতম বিখ্যাত হোটেলে পরিণত হয়। এতক্ষণ তো সবই ঠিক ছিল তাহলে ভূত বা ভৌতিক ব্যাপার কোথায়? স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলে নানান ধরনের উত্তর পাবেন। যেমন কেউকেউ বলেন, লেডি মরগ্যান অদ্ভুত ভালোবাসতেন এই বাড়িকে। মৃত্যুর পরেও তাঁর নাকি সেই প্রেম ঘোচেনি। এখনও নাকি তিনি প্রায়ই দেখা দেন বাংলোতে। ঘুরে বেড়ান বাংলোর করিডরে, এমনকি ঘরেও ঢোকেন থাকেন! সাদা গাউন পরিহিতা লেডি মরগ্যানকে অনেকবার দেখেছেন বাংলোর পাহারাদারেরা। তাঁর এবং মরগ্যান সাহেবের শোওয়ার ঘরে যে-সব অতিথিরা থাকেন, তাঁদেরও নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে অতীতে। এমনও জনশ্রুতি রয়েছে, পর্যটকদের মাথায় নাকি হাতও বুলিয়ে দিয়েছেন লেডি মরগ্যান। মরগ্যান হাউসের এক মহিলা কর্মচারী গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে জানিয়েছেন, কোজাগরী পূর্ণিমায় মরগ্যান সাহেব ও তার প্রিয়তমার সাক্ষাৎ পাওয়ার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি। অতিথিপরায়ণা লেডি মরগ্যান তাঁর বাংলোর অতিথিদের ঠিকমতো যত্ন-আত্তি হচ্ছে কিনা, তা সরেজমিনে পরীক্ষা করতে বের হন বলে শোনা যায়। তাঁর পায়ের শব্দ এখনও শুনতে পান আবাসিকরা। বিদেহী লেডি মরগ্যান যে কারও কোনও ক্ষতি করেননি কখনও, তা একবাক্যে মেনে নেন কালিম্পঙের সকলেই। ভয় পেয়ে কোনও কোনও পর্যটক পরের দিনই ঘর বদলে নিয়েছেন বা বাংলো থেকেই পাততাড়ি গুটিয়েছেন, এমন ঘটনাও অবশ্য কম নয়। আবার, কেউ কেউ এই রোমাঞ্চের টানেই বারে বারে আসেন মরগ্যান হাউসে। বহুবার রাত কাটিয়েও এখানে ভূতের ভ-ও দেখতে পাননি এমন মানুষের সংখ্যাও কিন্তু অনেক। তাঁরা মনে করেন, গোটাটাই রটনা। এখনও কথা হল যা রটে তার কিছুটাও তো ঘটে।
কালিম্পং নামের সঠিক উৎস অবশ্য অজ্ঞাত। সর্বজনগ্রাহ্য মত হল, তিব্বতি ভাষায় ‘কালিম্পং ’ মানে ‘কালোন’ মানে ‘রাজার মন্ত্রী’ আর ‘পঙ’ মানে ‘বেড়া’। অন্য মতে, লেপচা ভাষায় ‘কালিম্পং’ শব্দটির অর্থ ‘যে শৈলশিরায় আমরা খেলা করি ’ । অতীতে এখানে স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়ানুষ্ঠানের আসর বসত। পাহাড়ের অধিবাসীরা এই অঞ্চলকে কালিবং-ও বলত। কালো নালও বলে থাকেন। ‘ দি আনটোল্ড অ্যান্ড আননোন রিয়ালিটি অ্যাবাউট দ্য লেপচাস’ গ্রন্থের রচয়িতা কে পি তামসাং-এর মতে, “কালিম্পং কথাটি এসেছে কালেনপাং শব্দ থেকে, লেপচা ভাষায় যার অর্থ গোষ্ঠীর ছোটো পাহাড় বা "Hillock of Assemblage"”। শব্দটি প্রথমে ব্যবহৃত হত ‘কালীবাং’ নামে পরে আরও বিকৃত হয়ে হয়ে যায়, ‘কালিম্পং’। অন্য মতে, এই অঞ্চলে বহুল প্রাপ্ত তান্তব উদ্ভিদ ‘কাউলিম’-এর নামানুসারে এই অঞ্চলের নাম হয়েছে ‘কালিম্পং’। কালিম্পং হিমালয় পর্বতমালার একটি সুদৃশ্য হিল স্টেশন, ১২৫০ মি উঁচুতে অবস্থিত। তিস্তা নদী আর হিমালয়ের অবিশ্বাস্য দৃশ্য আপনার মনকে সতেজ ও তরতাজা করে তুলবে। একেবারে শুরুর তিকে অতীতে কালিম্পঙ ছিল বৌদ্ধধর্মের একটি ধর্মীয় কেন্দ্র।
অতীতের সিল্করুট ধরে চলুন। এক সময় সুদূর তিব্বত থেকে ব্যবসায়ীরা জেলেপা-লা পার করে কুপুপ, জুলুক, আরিতার, পেডং হয়ে টানা এক মাস চলার পর কালিম্পংয়ে আসতেন। এখান থেকে দেশের নানা প্রান্তে সেই রেশম রফতানি হত। ১৮৭০ সালে ভুটান রাজার থেকে ইংরেজরা ছিনিয়ে নেয় এই শহর। সেজে ওঠে শহর। এই শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানান দ্রষ্টব্য। ঘুরে দেখে নিন।
কালিম্পঙ শহর থেকে চলুন ডেলো আর দুরপিনদাঁরা। প্রথমেই ডেলো পার্কে। ডেলো জলাধারের পাশেই এক সাজানো পার্ক। রয়েছে বসার চেয়ার। রঙিন ফুল ফুটে থাকে চারপাশের টিলার ধাপে ধাপে। মেঘমুক্ত আকাশে, পাইনের ফাঁকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সুখী পরিবারের দেখা মেলে। আর টিলার মাথায় সুন্দর ডেলো বাংলো, বুকিং থাকলে সে বাংলোয় রাত্রিবাস করা যায় । আর যাঁরা পাখির চোখে কালিম্পংকে দেখতে চান, তাঁরা সাহসে ভর করে ভেসে পড়ুন প্যারাগ্লাইডিং-এ। এ ছাড়াও ডক্টর গ্রাহাম’স হোম, মঙ্গলধাম, ম্যাকফারলেন চার্চ, দুরপিনদাড়া গুম্ফা, দুরপিনদাড়া ভিউপয়েন্ট, হনুমান পার্ক, দুর্গামন্দির, কালীমাতা মন্দির, জং ডং পালরি , ফো-ব্রাং মিউজিয়াম আর ক্যাকটাসের অনবদ্য সম্ভার দেখতে হলে চলে আসুন পাইন ভিউ নার্সারিতে। নামী ক্যাকটাস সমেত নানা অর্কিডের সেরা সম্ভার আর এখান থেকে কালিম্পংকে অসাধারণ লাগে। কালিম্পঙের হস্তশিল্প কেন্দ্র ঘুরে দেখুন ভালো লাগবে। মথারপা চোলিং মঠ কালিম্পঙের পুরানো ভাস্কর্য ও তথ্য সংরক্ষণালয় হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। আর রয়েছে ‘থোংসা মঠ’ - এলাকার সবচেয়ে পুরানো মঠ। আছে ‘ধর্মোদয় বিহার’। নেপালি বৌদ্ধ মন্দির ছাড়াও ঘুরে দেখুন পর্নমি মন্দির এবং মঙ্গল ধাম। দুরপিনদাঁরার নিরিবিলিতে কাটাতে পারেন একটা দিন। নানা বর্ণের অজস্র ফুল গাছে সাজানো ছোট্ট লপচু গ্রামের হোম-স্টেতে থাকুন দুটো দিন। ভালো লাগবে।
কীভাবে যাবেন
শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি কালিম্পঙের দুরত্ব ৬৯ কিমি। শিলিগুড়ি থেকে জিপ ও অন্যান্য শেয়ার গাড়ি পাওয়া যায়। চাইলে দার্জিলিং ত্থেকেও যেতে পারেন কালিম্পঙ। দার্জিলিং থেকে তাকদা হয়ে কালিম্পঙ গেলে দূরত্ব ৫০ কিমি। কাছের বিমান বন্দর বাগডোগরা। আর ট্রেনে করে এলে প্রথমে নিউ জলপাইগুড়ি। তারপর ওখান থেকে গাড়ি।
কোথায় থাকবেন
কালিম্পঙ শহরে ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে ভালো মানের হোটেল রুম বা কটেজ পাওয়া যায়। চাইলে ম রগ্যান হাঊসে থাকতে পারেন। আগে থেকে বুকিং প্রয়োজন। কালিম্পঙের অফবিট ডেসটিনেশনে থাকতে চাইলে হোম-স্টেতে থাকতে পারেন। মাথাপিছু খরচ ১৫০০-৩০০০ টাকা