Written By অনিরুদ্ধ সরকার
স্ট্যাণ্ড রোড চন্দননগর।
কলকাতার খুব কাছেই গঙ্গার ধারে চন্দননগর। আপাদমস্তক ফরাসি ধাঁচে তৈরী একটা শহর। রাস্তাঘাট থেকে নির্মাণ শিল্প সব কিছুতেই আছে ফরাসি আমলের প্রতিচ্ছবি। সেযুগে ফরাসি উপনিবেশ থাকার দরুন এই শহর ছিল বাংলার বিল্পবীদের গা ঢাকা দেওয়ার অন্যতম জায়গা। আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত অরবিন্দ ঘোষ ও অন্যান্য বিপ্লবীরা ইংরেজদের হাত থেকে বাঁচতে এই শহরে আত্মগোপন করেছিলেন। আসলে ফরাসিশাসিত অঞ্চল ছিল বলে ইংরেজরা সহজে এই শহরে প্রবেশ করতে পারতেন না, ফরাসিদের পারমিশন লাগত। একসময় এখনে ছিল প্রচুর চন্দনগাছ। আর বিপুল পরিমাণে চন্দন কাঠের ব্যবসা হওয়ার কারণেই এই জায়গার নাম হয়েছিল, ‘চন্দননগর’। মনসামঙ্গল ও কবি কঙ্কণ চণ্ডীর লেখায় এই শহরের উল্লেখ রয়েছে। লাক্ষা, মোম, বেত, কাঠ, চন্দনকাঠ, বস্ত্র শিল্প, রেশম ও মশলার আমদানি-রফতানির জন্য চন্দননগরে সেযুগে সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। বলা হয়, অধিষ্ঠাত্রী দেবী বোরাই চণ্ডী বা মঙ্গল চণ্ডী থেকে ‘চণ্ড’ এবং ফরাসি উচ্চারনে তা ‘চণ্ডননগর’ হয়ে যায়। এর আরেক নাম ছিল ‘ফরাসডাঙ্গা’। হিন্দু, মুসলমান, ফরাসি, ইউরোপীয় এবং আর্মেনীয়গণ এখানে বসবাস করত সেযুগে।
একনজরে দেখে নেওয়া যাক এখানকার ইতিহাস। দুপ্লের নেতৃত্বে ফরাসিরা পা রাখে চন্দননগরে। প্রথমে ব্যবসার কারণে একটি গুদামঘর তৈরি করে ফরাসিরা। ফরাসিরা ১৬৭৬ সাল পর্যন্ত চন্দননগরে থাকলেও কোনো উন্নতি করতে পারেন নি। বাঁশবেড়িয়া, শেওড়াফুলি প্রভৃতি অঞ্চলের জমিদারদের দখলে ছিল সেসময় চন্দননগর। এদিকে ১৬৮৮ সালে এক ফরমানের বলে ফরাসিরা গৌরহাটিতে একটি কুঠি নির্মাণ করার অনুমতি পায়। ১৬৯৭ সালে ডেসল্যাণ্ড নামে এক ফরাসি এখনকার লালদিঘির কাছে ‘ডি-অঁরলিয়ে’ দুর্গ নির্মাণ করেন। দুর্গটি ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে যায়। ১৭৩৬ সালে পণ্ডিচেরির গভর্নর দিসা স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা প্রকাশের জন্য নবাবের কাছ থেকে বিশেষ ফরমান সংগ্রহ করেন। ১৭৩১ সালে নতুন গভর্নর, জোসেফ ফ্রান্সিস দুপ্লে জমিদারদের কাছ থেকে জমি নিয়ে উত্তরে তালডাঙ্গা থেকে দক্ষিণে গৌরহাটি পর্যন্ত শহরটিকে প্রসারিত করেন। এ শহরের শাসনব্যবস্থা একজন গভর্নর ডাইরেক্টর, ৫ জন সদস্যের দ্বারা গঠিত কাউন্সিলের মাধ্যমে পরিচালিত হতে শুরু করে। ১৮ মার্চ লর্ডক্লাইভ স্থলপথে এবং ওয়াটসন জলপথে আক্রমণ করে চন্দননগর। ইংরাজদের গোলাবর্ষনে ভেঙ্গে পড়ে ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী নির্মিত অন্যতম ঐতিহাসিক স্থাপত্য নন্দদুলাল মন্দিরের একাংশ। আজকের চন্দননগরে যেটি কুঠির মাঠ হিসাবে খ্যাত ছিল সেখানেই ছিল এই দুর্গের অংশ। ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে যুদ্ধ শেষে চন্দননগর ইংরাজদের দখলে আসে। ১৭৫৭ থেকে ১৮১৬ সাল পর্যন্ত মোট চারবার চন্দননগরের বুকে উড়েছিল বৃটিশ পতাকা। দুপ্লের শাসনকাল ছিল চন্দননগরে ফরাসী শাসনের স্বর্ণযুগ। দুপ্লের নেতৃত্বে ফরাসডাঙ্গা এক মনোরম নগরীতে পরিনত হয়। ১৯৪৯ সাল চন্দননগরে গনভোট হয়। ১৯৫০ এর ২ মে ফরাসি শাসন মুক্ত হয় চন্দননগর । ১৯৫৪ ফরাসডাঙ্গা বা চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হয়। এই ফরাসি উপনিবেশ ইংরেজশাসিত কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে বরাবর। কলকাতার মত চন্দননগরেও আছে স্ট্র্যান্ড রোড, বড়বাজার, বাগবাজার, বউবাজার।
ফরাসি উপনিবেশ হওয়ায় স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিপ্লবীরা এখানে আশ্রয় নিতেন, আত্মগোপন করে থাকতেন। আলিপুর বোমার মামলায় অভিযুক্ত অরবিন্দ ঘোষ ও অন্যান্য বিপ্লবীরাও এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অরবিন্দের ভাই বারীন দীর্ঘদিন ছিলেন চন্দননগরে। একসময় অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের আখড়া হয়ে উঠেছিল চন্দননগর। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সঙ্গে যুক্ত বিপ্লবী গনেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহের মত বিপ্লবীরাও আত্মগোপন করেছিলেন এখানে। ফরাসি উপনিবেশ, তাই ব্রিটিশ পুলিশকে অনুমতি নিয়ে এখানে ঢুকতে হতো। সেই সুযোগে বিপ্লবীরা ফরাসিদের এই উপনিবেশে লুকিয়ে থাকতেন। আর অরবিন্দ এখান থেকে বাগবাজার ঘাট থেকে চলে গেছিলেন পণ্ডিচেরি।
এখানে দিনে দিনে দেখে নেওয়া যায়-
চন্দননগর স্ট্র্যান্ড রোড- চন্দননগরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী দুর্গাচরণ রক্ষিতের স্মৃতিরক্ষার্থে এই ঘাটটি নিমির্ত হয়। যা চন্দননগরের অন্যতম ভিউ পয়েন্ট। এখানে বসে সারাদিন আপনার পেরিয়ে যেতে পারে গঙ্গার সৌন্দর্য দেখে।
চন্দননগর স্ট্র্যান্ড পার্ক – হুগলি নদীর তীর বরাবর সুসজ্জিত রাস্তা আর ছায়ায় ঘেরা এক মনরোম পরিবেশ আপনাকে মাতিয়ে দেবেই।
সেক্রেড হার্ট চার্চ- পায়ে পায়ে পৌঁছে যান সেক্রেড হার্ট চার্চে। ১৬৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত ফরাসি স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে বেঁচে আছে এই চার্চ। চার্চের সামনেই শহিদ বিপ্লবী মাখনলালের মূর্তি। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যতম নেতা মাখনলাল। ইংরেজদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে আত্মবলিদান দেন।
চন্দননগর মিউজিয়াম – এককালে ফরাসি শাসন ছিল বলে এই মিউজিয়ামে তখনকার দিনে ফরাসিদের ব্যবহৃত জিনিস আজও স্বযত্নে রাখা আছে।
ফরাসিদের সমাধিস্থল -ওলন্দাজ সমাধিস্থল- স্যর কর্নওয়ালিস জঙ্গকে সমাধি দেওয়া হয় এখানে। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ এটিকে হেরিটেজ ঘোষণা করে রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। এর দু’টি ভাগ। একভাগে ইংরেজ ও অন্যান্য স্থানীয় খ্রিস্টানদের সমাধিস্থল। সমাধিগুলোর আশপাশ সুন্দর করে সাজানো। বাঁধাই করা রাস্তা। ছাঁটাই করা গাছ। মাঝে মাঝে রংবাহারি ফুল। ডাচ সাহেবদের স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে দণ্ডায়মান। বহু ফরাসি শবদেহের সাক্ষি এই সমাধিস্থল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হল ফরাসি ছিটমহলের শ্রষ্ঠা কম্যান্ডার ডুপ্লেসিসের সমাধি। বিভিন্ন ফুল দিয়ে সাজানো এই সমাধিস্থল আকর্ষণ করে সাধারণ মানুষকে।
চন্দননগর গেট – শহরের দক্ষিণে ও উত্তরে প্রবেশের পথে ফরাসি কারিগরদের শিল্পকলার নিশান এই তোরণ দুটি। উত্তরের তোরণটি না থাকলেও দক্ষিনের তোরণটি আজও আছে।
পাতাল বাড়ি – স্ট্রান্ডের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত। নামের সাথে সাথে স্বার্থক এই স্থাপত্য। এই বাড়িটির একদম নিচের তলা নদীর ভুগর্ভে বা পাতালে অবস্থিত সেই কারণে একে পাতাল বাড়ি বলা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধিকবার এই শহরে এসেছেন আর থেকেছেন পাতাল বাড়িতে।
উপরোক্ত স্থাপত্যগুলি ছাড়াও ঘুরে দেখুন কানাইলালের বাড়ি। লাল রঙের বাড়ির এক অংশে এক কুঠুরি রয়েছে তার সামনে লোহার গরাদ। ভেতরে বিপ্লবীর প্রস্তর মূর্তি। সবটাই বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। শহীদ কানাইলাল বসুর শৈশব কেটেছে এই শহরে। তাঁর ভিটেই নয়, তার নামাঙ্কিত একটি বিদ্যালয় ও ক্রীড়াঙ্গন রয়েছে শহরে। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পৈতৃক ভিটেও এই শহরের ফটকগোড়া এলাকায়। প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট। আজ যেটি ফ্রেঞ্চ ইন্সটিটিউট রূপে খ্যাত সেটি একদা দুপ্লের বাসভবন ছিল । ১৮৫০ খৃঃ নির্মিত হয় স্ট্র্যান্ডের ধারে সুউচ্চ ক্লক টাওয়ার । ১৮৭০ সালে নির্মিত হয় হোটেল দি প্যারিস যা আজকের সাবডিভিসনাল জুডিসিয়াল কোর্ট। এরপর ১৮৭৫ খৃঃ তৈরী হয় রোমান ক্যাথিলিক গির্জা যা আজো ফরাসি স্থাপত্যের সাক্ষ্য বহন করছে । চন্দননগরের লিবার্টি গেট যা আজও সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার ঐতিহ্য বহন করছে । ঐতিহ্যশালী দুপ্লে কলেজ আজ চন্দননগর সরকারী কলেজ হিসাবে খ্যাত । ফরাসী স্থাপত্যের পাশাপাশি বহু ধনী ব্যাক্তিবর্গ বিভিন্ন সুউচ্চ সুন্দর মহল নির্মান করেন যার মধ্যে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী দুর্গাচরন রক্ষিত নির্মিত রক্ষিত ভবন ও রক্ষিত স্কুল অন্যতম। এছাড়াও চন্দননগরের অন্যতম শিক্ষাব্রতী হরিহর শেঠের বসত বাড়ি শেঠ বাড়ি ও তার নির্মিত মেয়েদের স্কুল কৃষ্ণভাবিনী নারীশিক্ষা মন্দির ও চন্দননগর পাঠাগার নৃত্যগোপাল স্মৃতি মন্দির অন্যতম। এছাড়াও চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার মণ্ডলবাড়িতে কবিগানের আসর বসত। সেযুগের বিখ্যাত কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী আসতেন এখানে। জমে উঠত আসর। উর্দিবাজারের শেখ হার্বেনের তৈরী মসজিদ শহরের অন্যতম একটি স্থাপত্য। আর রয়েছে বিশালক্ষ্মী মন্দির। আর হিমালয়ের উচ্চতা মাপা সত্ত্বেও যার উচ্চাতকে ইংরেজরা স্বীকৃতি দিতে চায় নি সেই রাধানাথ শিকদারের স্মৃতি রোমন্থন করতে চাইলে গোন্দলপাড়া যেতে পারেন।
কৃষ্ণনগরের আদলে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়। তিনশো বছর আগে এই পুজোর সূত্রপাত। কালে কালে এই পুজো হয়ে ওঠে জাঁকজমকপূর্ণ। তার ওপর আলোর ব্যবহারে অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছে চন্দননগর। দুর্গাপুজোর সপ্তমী থেকে ঠিক একমাস পর আসে জগদ্ধাত্রী পুজোর সপ্তমী। দুর্গাপুজোর মতই চারদিন ধরে হয় পুজো। পুজো শেষে বিরাট বিরাট আকারের প্রতিমা বিস র্জিন দেওয়া হয় গঙ্গায়। বাংলায় প্রথম এখানেই পুজো বিসর্জনের কার্নিভ্যাল শুরু হয় বহুকাল আগে।
কি ভাবে যাবেন?
রেলপথ – হাওড়া স্টেশন থেকে বর্ধমানগামী প্রচুর ট্রেন আছে। বর্ধমান মেন লাইনের যে কোনো লোকাল ট্রেন বা ব্যাণ্ডেল লোকাল বা কোটোয়া লোকাল ধরে চন্দননগর স্টেশন। আপনি মানকুণ্ডুতে নামুন। হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে আধঘণ্টা থেকে চল্লিশ মিনিটের দূরত্ব চন্দননগর।
সড়ক পথ- দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে কংসরির মোড়। সেখান থেকে ১৭ নম্বর রুট ধরে চন্দননগর। জিটি রোড ধরেও আপনি চন্দননগর যেতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
চন্দননগরে থাকার জন্য লজ কিম্বা হোটেল আছে। দিনে দিনে বেড়িয়ে রাতের মধ্যে কলকাতা ফিরে যেতে পারেন।
6th March, 2021 11:13 pm
6th March, 2021 10:38 pm
6th March, 2021 07:54 pm
6th March, 2021 07:25 pm