Written By অনিরুদ্ধ সরকার
সত্যজিৎ রায় এসেছেন ময়নাগড়। “অশনি সংকেত” সিনেমার শ্যুটিং এর অভিপ্রায়ে রিক্সা করে ঘুরে বেড়ালেন পুরো ময়না। পরিখাবেষ্টিত গড় ঘুরে দেখলেন, কিন্তু পুরো ইউনিট নিয়ে কোথায় থাকবেন তার জায়গা খুঁজে পেলেন না। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকায় তাঁকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হল। ইচ্ছে হলেও উপায় ছিল না সত্যজিতের কাছে। সত্যজিতের মনে কিন্তু ময়না এক আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল। একারণে পরে তিনি ‘আগন্তুক’ সিনেমার একটি দৃশ্যে ব্যবহার করেন এখানকার বিখ্যাত গহনাবড়ি। মহাশ্বেতা দেবীর লেখা চিঠি থেকেও বাহুবলীন্দ্র পরিবারের তৈরী গহনাবড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়।
ময়নাগড়ের ইতিহাস বড়োই বিচিত্র! আর এর ইতিহাস জুড়ে শুধুই লাউসেনের গল্প। অতীতের ময়না মধ্যযুগে ছিল উৎকল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। গৌড়ের অধিপতি দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে যুদ্ধে পরাজিত কর্ণসেন তাঁর অধীনে সেনভূম ও গোপভূম অঞ্চল শাসন করতেন। গৌড়েশ্বরের মন্ত্রীর নাম ছিল মহামদ। যার চক্রান্তে সোম ঘোষ নামে এক অনুগত প্রজা কারাগারে বন্দী হন। পরে এই সোম ঘোষের সঙ্গে গৌড়েশ্বরের বন্ধুত্ব স্থাপন হলে রাজপাট্টা, একটি ঘোড়া এবং একশ দেহরক্ষী সৈন্যসহ সোম ঘোষ কর্ণসেনের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। সোম ঘোষের পুত্র ইছাই ঘোষ কর্ণসেনকে যু্দ্ধে পরাস্ত করেন। তাঁর ছয় পুত্রকে বিনাশ করে রাজ্যের অধিকার নেন। পুত্রশোকে কর্ণসেনের মহিষী বিষপান করেন ও মারা যান। তখন গৌড়েশ্বর কর্ণসেনকে দক্ষিণবঙ্গের অংশবিশেষ যা সেযুগে ময়নামণ্ডল নামে পরিচিত ছিল তার রাজত্ব দেন। তিনি কংসাবতীর শাখানদী কালিন্দীর জলপথে ধরে কর্ণসেনের নতুন রাজধানী কর্ণগড়ে প্রবেশ করেন। যা পরে ‘ময়নাগড়’ নামে বিখ্যাত হয়। কর্ণসেনের দ্বিতীয় পত্নী রঞ্জাবতী বাঁকুড়ার রামাই পণ্ডিতের উপদেশে ধর্মঠাকুরের তপস্যা করেন ও লাউসেনকে পুত্ররূপে লাভ করেন যিনি মঙ্গলকাব্যে লাম্বাদিত্য নামে খ্যাত। লাউসেন অজয় নদীর তীরে ইছাই ঘোষকে নিহত করে পিতৃরাজ্য উদ্ধার করেন৷ এভাবে লাউসেনের সাম্রাজ্য বীরভূম থেকে ময়না পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। ময়নাগড়ে এখনও লাউসেনের একাধিক কীর্তিচিহ্ন রয়েছে। লাউসেনের বীরত্বের কাহিনী ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। ময়নাগড় ধর্মপূজার পীঠস্থান হিসাবে তাই আজও জনপ্রিয়। লোকবিশ্বাস, ময়নার কাছে বৃন্দাবনচকে যে প্রাচীন ধর্মঠাকুর আছেন তাকে লাউসেন প্রতিষ্ঠিত করেন। বৃটিশ কালেকটর এইচ.ভি.বেইলি তাঁর এক লেখায় লিখছেন, “লাউসেনের পর রাজা গোবর্ধন প্রচুর অর্থব্যয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন,যে অস্ত্রধারী সৈন্য তো দূর কোনও যুদ্ধাস্ত্রও প্রবেশ করতে পারতো না। ময়নাগড়ের একদম কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি দ্বীপ। এই দ্বীপের নাম ভিতরগড়, যেখানে বাস করতেন রাজা। সেই কারণে এখানে প্রাসাদ, মন্দির প্রভৃতি তৈরি হয়েছিল। তোরণদ্বার পেরিয়ে লাল মাটির রাস্তা। পাশ দিয়ে কালিদহ ও মাকড়দহ নামে দুখানি পরিখা। পরিখা ঘুরে দেখতে পাবেন ডিঙি। চড়ে বসুন। লাউসেনের নির্মিত গড়ের প্রায় পুরোটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। যেটুকু আছে, যে কোনো সময় হয়তো ভেঙে পড়তে পারে। জঙ্গলাকীর্ণ ঐ ভগ্ন গড়ে এখন বটগাছের বাস৷
একবার লাউ সেনের উত্তরপুরুষ গোবর্ধনানন্দ ক্ষিপ্ত হস্তীকে বশ করেছিলেন যে কারণে উত্কল নৃপতি তাঁকে বাহুবলীন্দ্র উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।বাহুবলীন্দ্র বংশের প্রথম পুরুষ কালিন্দীরাম সামন্ত বালিসীতাগড়ে ১৪৩৪ খ্রীষ্টাব্দে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এই বংশের জগদানন্দ বাহুবলীন্দ্র স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন অগ্রগণ্য সেনানী ছিলেন।রাজার শেষদশায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে ময়নাগড় আক্রমণ করলে জগনানন্দ আত্মসমর্পণ করেননি,গড়ের ভেতরে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আত্মগোপন করে থাকেন। হেস্টিংস অনেক চাপ সৃষ্টি করলেও ১৭৬০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও মীরকাশিমের মধ্যে লিখিত চুক্তি অনুযায়ী জমিদারী অক্ষুন্নই থেকে যায় রাজার। রাজা জগনানন্দের সম্মানার্থে – Statue of Dignity নির্মিত হয় ২০১৪ সালে৷
ময়নাগড় পঞ্চদেবতার গড়ও বলেও পরিচিত। বৈষ্ণব -শৈব-শাক্ত-ধর্ম-পীর সব ধর্মের মানুষজন আছেন এখানে। ময়নাদুর্গের চৌহদ্দির মধ্যে রয়েছে বৈষ্ণব – শৈব ও শাক্তির সমাহার। তিন ধর্মের তিন মন্দির- শ্যামসুন্দর মন্দির, লোকেশ্বর শিব, এবং মহাকালী রঙ্কিণীদেবীর মন্দির। এছাড়া রয়েছে ধর্মঠাকুরের মন্দির, মোহান্ত নয়নানন্দ দেবগোস্বামী সমাধিমন্দির, তিন শতাব্দী প্রাচীন সুফি পীরের দরগা যা হজরত তুর জালাল শাহ দরগা নামে পরিচিত। পীর হজরত রাজা জগদানন্দের আহ্বানে এখানে এসে ডেরা বেঁধেছিলেন।গভীর ঘন জঙ্গলের মাঝে চাপা পড়ে গেছে অতীতের নানা ঘাট। আয়না মহল, সওয়ারি মহল, পুজোর ঘাট, রাজ ঘাট আজ কেবল ইতিহাস।
কালিদহের তীরে রয়েছে লোকেশ্বর শিব মন্দির। মন্দিরের মধ্যে বেশ গভীরে শিবলিঙ্গ ছিল। বর্গী হামলা থেকে রক্ষা পেতে যে সুড়ঙ্গ পথ নদীতীর অবধি বিস্তৃত ছিলো, তা বেশ ভালো রকম সক্রিয় থাকায় শিবকুন্ডটি বন্যায় অতিরিক্ত জলে ডুবে যায়। মূল মন্দিরটির নির্মাণকাল প্রাচীন। পরে সংস্কারের সময় মন্দির টেরাকোটার কাজে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে ৷ কালিদহের তীরে রয়েছে আরও একটি মন্দির — শ্যামসুন্দরজীউর ‘পঞ্চরত্ন’ মন্দির। যা দেউল রীতির। এই শ্যামসুন্দরজীউ হলেন বাহুবলীন্দ্র পরিবারের কুলদেবতা। প্রতিষ্ঠার সাল জানা যায় না।
তবে পারলে ময়না আসুন কার্তিক পূর্ণিমার সময়। রাসের সময় কদিন নৌকায় করে শোভাযাত্রা বের হয়।রাসমঞ্চে যান শ্যামসুন্দর জীউ। নৌকাগুলি আলোতে ভরে ওঠে। সুসজ্জিত নৌকার আলোয় পরিখার জল রঙিন হয়ে ওঠে। আকাশে ওড়ে রঙিন ফানুস। সারা ভারতে আর কোথাও কৃষ্ণ ভগবান এরকম নৌকায় করে রাসমঞ্চে যান না।
কীভাবে যাবেন
তমলুক থেকে ময়নার দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার আর মেচেদা থেকে হাইরোড হয়ে ময়না ২৮ কিলোমিটার। তমলুক বা মেচেদা থেকে ময়না বাসে আসা যায়।
কোথায় থাকবেন
ময়নায় থাকার কোন ব্যবস্থা নেই, মেচেদা বা কোলাঘাটে থেকে জায়গাটি দেখে নেওয়া যায়।