Written By অনিরুদ্ধ সরকার
“প্রেমের পরশে প্রত্যেকেই কবি হয়ে ওঠে ”- বলেছিলেন প্লেটো। কথাটা বেশ বোঝা যায় ১৪ ফেব্রুয়ারি এলেই। রোমান্ট্যিক যুগের বিখ্যাত কবি কিটস বলেছিলেন- “ যে ভালোবাসা পেল না, যে কাউকে ভালোবাসতে পারল না, সংসারে তার মতো হতভাগা কেউ নেই।” আবার বিখ্যাত নাট্যকার বার্নার্ড শ বলেছিলেন-“ প্রেম হলো সিগারেটের মতো, যার আরাম্ভ হয় আগুন দিয়ে আর শেষ পরিণতি হয় ছাইয়ে।” তরুণ কবি বায়রণ নিজের উপলব্ধি থেকে একবার বলেছিলেন- “ প্রেম মানুষকে শান্তি দেয়, কিন্তু স্বস্তি দেয় না।” তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা বলেছিলেন কবি নজরুল। তাঁর কথায়-“ বিশ্বাস করুন,আমি কবি হতে আসিনি,আমি নেতা হতে আসি নি-আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম,প্রেম পেতে এসেছিলাম-সে প্রেম পেলামনা বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চির দিনের জন্য বিদায় নিলাম।” ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব প্রেম দিবস’, সারা বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় এই বিশেষ দিনটি নানান ভাবে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মিলিয়ে এই দিনটি ঘিরে বেশ উন্মাদনা লক্ষ্য করা যায় বিশ্বজুড়ে। প্রেমিক প্রেমিকারা কীভাবে এই দিনটি সেলিব্রেট করবেন তার জন্য তাঁরা অনেকদিন আগে থেকেই প্ল্যান করেন, আর সবাই চান প্রতিবারের চেয়ে যেন আলাদা হয় সেবারের সেলিব্রেশন। যেমন ধরুন, আগেরবার যদি কোনো প্রেমিক প্রেমিকা গঙ্গার ওপর নৌকোয় বসে ভালবাসার মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে ক্যান্ডেল-লাইট ডিনার সেরেছেন তো এবার তাঁরা চাইছেন- ভালো কোনো রেস্তরাঁয় পছন্দসই মিউজিকের সঙ্গে ইণ্ডিয়ান বা কন্টিনেন্টাল খাবারের সঙ্গে জমিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যেটা কাটাতে কিম্বা আধো আলোতে কলকাতার কোনও রুফটপ রেস্তোরাঁয় দুজনে টুক করে ডিনারটা সেরে ফেলতে। হাজারো ব্যস্ততা, অফিসের চাপ সব ফেলে রেখে রুফটপ রেস্তোরাঁর ওপর থেকে কলকাতার স্কাই লাইনকে সাক্ষী রেখে এদিন তাঁরা একসঙ্গে বলবেন- “আমি শুধু চেয়েছি তোমায়”। স্কুল কলেজের টিন-এজ প্রেমের দিকে একটু তাকালে দেখা যাবে, সদ্য মনে ‘রঙিন স্বপ্ন’ নিয়ে ভ্যালেন্টাইন ডে-তে তাঁদের ডেস্টিনেশন হয় নিউ মার্কেট কিম্বা দক্ষিণ কলকাতার সিসিওয়ান, সাউথ সিটি কিম্বা অ্যাক্রোপলিশ। একটু আধটু শপিং সেরে পছন্দের খাবার খেয়ে একে অপরের হাতে ভালবাসার উপহার তুলে দিয়ে প্রপোজ সেরে বলে- “তুমি কী আমায় ভালোবাসো?” ইউনিভার্সিটির প্রেম অবশ্য একটু অন্য ধরনের। সেখানে ভাবের উষ্ণতার পারদ সবসময় থাকে উর্ধমুখী, সেই উষ্ণতার পারদকে ভাগাভাগি করে নিতে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের জুড়ি মেলা ভার। কফি হাউসের এককাপ ব্ল্যাক কফির সঙ্গে পড়ন্ত শীতের বিকেলে সেই উষ্ণতাকে অনেকেই ভাগ করে নেন এই দিনটিতে। আর যদি থাকে বইয়ের প্রতি টান তাহলে কলেজ স্ট্রিটের চেয়ে ভালো জায়গা হয় না ১৪ ফেব্রুয়ারি। মনের মত বই কিনুন, দেখুন আর একে অন্যকে বই উপহার দিন। উত্তর কলকাতার বনেদিয়ানাকে সাক্ষী রেখে যদি ‘বিশ্ব প্রেম দিবসে’র দিনটি কাটাতে চান অন্যভাবে, তাহলে একটু নস্ট্যালজিক ওয়েতে প্রেম করুন। হেরিটেজ ব্রেকফাস্ট খেয়ে দিনটা শুরু করুন। তার জন্য সক্কাল সক্কাল চলে যান পার্কস্ট্রিটের ফ্লুরিজে। ১৯২৭ সাল থেকে এই দোকানের ব্রিটিশ ব্রেকফাস্টে মজে আছেন বাঙালি। গরম ধোঁয়া ওঠা চা আর প্যাটিজ খেয়ে ভালোবাসা দিবস শুরু করুন। সেখান থেকে বেরিয়ে আপনার অপশন হতে পারে ট্রাম। জানলার ধারে প্রিয়জনকে বসতে দিন। ট্রামের ধীরগতিতে মিশে থাকুক আপনাদের রোমান্ট্যিক একান্ত আপন গল্পেরা। কিম্বা চড়ে বসুন ঘোড়ার গাড়িতে। গেয়ে উঠুন - 'পৃথিবী বদলে গেছে, যা দেখি নতুন লাগে' আর যদি একেবারে আলাদা অনুভূতি চান তাহলে গঙ্গার ধারের বিকল্প হয় না। শ্যামবাজার কিম্বা শোভাবাজারের অলিগলি হয়ে পুরনো ইট কাঠ পাথরের কলকাতাকে দেখতে দেখতে- সিধা আহেরিটোলা কিম্বা বাগবাজার ঘাট। গঙ্গা দেখতে দেখতে প্রেমে ডুবে যান। দূরের আলোগুলো জানান দেবে আমরা আছি... আমরা থাকব...। বাদাম ভাজা, প্রেম আর ভিক্টোরিয়া এই তিন চিরকাল মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে কলকাতার বুকে৷ প্রেম আর ভিক্টোরিয়ার সখ্যতা বেশ গভীর৷ নিরিবিলি হলেও কিন্তু বেশ প্রাণবন্ত। এক অদ্ভুত ভালোলাগা রয়েছে৷ শ্বেতশুভ্র মর্মর রাজকীয় আর্কিটেকচারকে সাক্ষী রেখে হাতে হাত রেখে মনের কথাটুকু সেরে ফেলার অপেক্ষা। আর ! যারা লাইভ মিউজিক পছন্দ করেন তাঁরা চলে যান সামপ্লেস এলসে। কলকাতার নামজাদা পাবে হালকা ড্রিঙ্ক নিয়ে মিউজিকের সঙ্গে এনজয় করেন দিনটিকে। কেউকেউ ভ্যালেন্টাইন ডে-তে সারপ্রাইজ গিফট দিয়ে একে অপরকে চমকে দেন। এই রেওয়াজ বেশ পুরনো হলেও কিন্তু বেশ মজার। এক্ষেত্রে যেটা হয় তা হল একে অপরের পছন্দের বিষয়টা আগে বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী প্ল্যান করেন। কেউকেউ বিদেশি কায়দায় মিউজিশিয়ানকে পাঠিয়ে দেন সঙ্গে হাতে তৈরি কার্ড, চকলেট, টেডি, কেক, ফুলের মত গিফটও থাকে। মুভি দেখে অনেকেই এই দিনটি কাটান অন্যভাবে। নন্দন চত্বরে এদিন তাই দেখা মেলে উপচে পড়া ‘ভালোবাসার ভিড়’। কেউ কেউ অবশ্য এসব বিষয়কে ‘ন্যকামো’ বলে মনে করেন, তাঁরা গতানুগতিকতাকে পাত্তা না দিয়ে বাইক নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার রাইডে বেরিয়ে পড়েন দুজনে। নাম না জানা গন্তব্যে ঘুরে ফিরে কাটিয়ে দেন সারা দিন। আসলে সবাই চান তাঁদের গল্পে নতুন করে লেখা হোক ভালোবাসার ইতিহাস। তাই কোনো কোনো আবেগপ্রবণ বাঙালি আবেগ ধরে রাখতে না পেরে ভালোবাসার ইতিহাস লিখতে দিনের শেষে চলে যান প্রিন্সেপ ঘাটে। সূর্যাস্তকে সাক্ষী রেখে একটা সেলফি তুলে একে অপরকে বলেন- “হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে , আমি শুধু চেয়েছি তোমায়...”