Written By অনিরুদ্ধ সরকার
স্তব্ধ চিন। মারা যাচ্ছে শয়ে শয়ে মানুষ। ভেঙে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। এরই মধ্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ২৫,০০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে ১০০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছে চিন মাত্র ১০ দিনে। একটাই কারন, করোনাভাইরাস। ২০০৩ সালে চিনে সার্স ভাইরাসের মারণ হানার সময়ে জরুরি ভিত্তিতে এমনই এক বিশেষ হাসপাতাল গড়ে তুলেছিল চিন। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন চিন নিজেই এই মারণ রোগের ভাইরাস ছড়িয়েছে কারণ, এর অ্যান্টিডোজও চিনের কাছে আছে। মোটা টাকায় চিন তা সারা বিশ্বে বিশ্বে বেচবে। এর নেপথ্যে অকাট্য যুক্তি দিয়েছে অনেকেই তাঁরা বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’ কীভাবে জানাল ১৮ মাস পরেই মিলবে করোনার অ্যান্টিডোজ। যুক্তি পাল্টা যুক্তি চলতেই থাকবে। এদিকে ২৫ জানুয়ারি ছিল চিনা নববর্ষ। যা লুনার নিউন ইয়ার নামে পরিচিত। চিনের প্রবাসীরা এইসময় বাড়ি ফেরেন ও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান, উৎসবে মেতে ওঠেন। আনন্দ করেন। কিন্তু এবার...! নববর্ষের উৎসবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় চিনের প্রাচীরের একাংশ। বেজিংয়ের বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়াম বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ ছিল বেজিংয়ে মিং রাজবংশের সমাধি, ইনশান প্যাগোডা। ডিজনিওয়ার্ল্ড সাংহাই ও হংকংয়ে তাদের পার্কগুলি বন্ধ করে দেয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। উৎসবের মরশুমে চিনের রাজধানী কার্যত একেবারে সুনসান। যে শিংশান পার্ক এই সময় থাকে ভিড়ে ঠাসা, মূলত তুষারপাত দেখতেই ভিড় জমান চিন সহ সারা বিশ্বের মানুষ সেই শিংশান পার্ক ফাঁকা। সেখানে এত কম পর্যটক এসেছেন যে সবাই অবাক। অন্যান্য বছর এই সময়ে এই এলাকায় ট্যুরিস্ট এবং গাড়ির ভিড়ে পথ হাঁটাই দায় হয় তা সুনশান। অন্যদিকে সংক্রমণ ঠেকাতে চিন সরকারের তরফে নিষিদ্ধ হয়েছে যে কোনও জমায়েত। এমনকি দল বেঁধে খেতে যাওয়াও বন্ধ করা হয়েছে। ফলে সমস্ত দোকান, বার, রেস্তরাঁ ইত্যাদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি ক্ষতির মুখে। বেজিংয়ে ‘ফুড স্ট্রিট’ বলে খ্যাত গুইজিতে এখন মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি দোকান খোলা আছে। ঘাতক করোনাভাইরাস বেজিংয়ে সেভাবে থাবা না বসালেও প্রাণঘাতী সংক্রামক এই ভাইরাসের ভয়ে কার্যত শহর ছেড়েছেন অনেকেই। চিন জুড়ে মৃত্যু সংখ্যা হাজার পেরিছে, আক্রান্তের সংখ্যা পেরিয়েছে পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি তাকে আর কোনও ভাবেই ভরসা করতে পারছেন না কেউ। তাই খাঁ খাঁ করছে বেজিংয়ের আশপাশ। শুধু বেজিং নয়, চিনের অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র সাংহাই-সহ অন্য শহরেরও পরিস্থিতি এখন এমনটাই। করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে ছুটি ঘোষণা হয়েছে সমস্ত স্কুল, কলেজ, অফিসে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ বেরোচ্ছেন না বাড়ির বাইরে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশটিতে এক একটি শহর যেন এখন আস্ত এক প্রেতপুরী!
বিশেশজ্ঞদের মত, করোনা আসলে ফ্ল্যাবিও ভাইরাস, যা দ্রুত সংক্রামিত হয়। চিনের ইউহানে প্রথম করোনা সংক্রণের ঘটনা নজরে আসে। তারপর একের পর এক জায়গায় এই ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটেই চলেছে দিনের পর দিন। ইউহানের মাছের বাজার থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে বলেই জানা যাচ্ছে। উহান শহর সি-ফুড ও মাছ-মাংসের বাজারের জন্য বিখ্যাত। এই বাজারে বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণীর মাংস বেআইনি ভাবে বিক্রি হয়। একটি সংবাদ সংস্থা সূত্রের দাবি, হুবেই প্রদেশের বাসিন্দারা বাদুড় এবং চিনা গোখরো সাপের মাংস খান, সেকারণে সেখান থেকেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, এই অঞ্চলেই বেশিরভাগ সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকশো মানুষ এই সংক্রমণের শিকার। গবাদি পশু থেকে এই রোগ ছড়ায় বলে করোনার ক্ষেত্রে বিপদের মাত্রা অনেক বেশি বলছেন গবেষকরা। ২৫ জানুয়ারি ছিল চিনের লুনার নববর্ষ৷ দেশের সবচেয়ে বড় এই উৎসবে এবার কেউ কোনো আনন্দ করেনি৷ কারণ ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল সরকারি ছুটি৷ করোনা ভাইরাসের কারণে সেই ছুটি ২ ফেব্রুয়ারি অবধি বাড়িয়ে দেয় সরকার৷ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থা কার্যত বন্ধ৷ অনেকের ব্যবসা প্রায় বন্ধের মুখে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি কর্মচারীদের বাড়ি বসে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে৷
করোনা ভাইরাসের প্রভাব পড়েছে চিনের খেলাধূলোতেও। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে চিনে বাস্কেটবল লিগ হওয়ার কথা ছিল। তা হচ্ছে না৷ চাইনিজ বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন সে দেশের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম ওইবো-তে এক বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছে, দেশ করোনা ভাইরাসের ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার পর নতুন সময়সূচি জানানো হবে। অন্যদিকে ১ ফেব্রুয়ারি ১৪তম জাতীয় শীতকালীন গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল মঙ্গোলিয়ার হুলুনবু্ইরে। এই আয়োজনও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে৷ হংকংয়েও করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে ছড়িয়েছে। ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি চিনে ম্যারাথন হওয়ার কথা ছিল৷ ৭৪ হাজার প্রতিযোগী তাতে অংশ নিতে আগ্রহী ছিলেন৷ হংকংয়ের নেতা ক্যারি ল্যাম করোনা ভাইরাসের কারণে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর এ আয়োজনটিও বন্ধ রাখা হয়েছে৷এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপও বিশ বাঁও জলে। দু’দিনের এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ হওয়ার কথা ১২ ফেব্রুয়ারি। চিনের মেডিক্যাল কমিশনের পরামর্শে এটিও আপাতত স্থগিত৷ ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের এই আয়োজন কবে, কোথায় হবে তা এখনোও ঠিক হয়নি। ১৫ ফেব্রুয়ারি সুঝৌ অলিম্পিক স্টেডিয়ামে হওয়ার কথা চিনের ফুটবল সুপার কাপ ফাইনাল কিন্তু চিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সেই আয়োজন অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়েছে। শুধু তাই নয়, টেনিসের বড় একটা আয়োজন এটিপি চ্যালেঞ্জও কার্যত বন্ধ, সেখানেও পড়েছে করোনা ভাইরাসের প্রভাব৷ ২ মার্চ থেকে ২৩ মার্চের মধ্যে হওয়ার কথা ছিল বেশ কিছু ম্যাচ৷ এটিপি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বছরের অন্য কোনো সময় হবে ম্যাচগুলি , এখন হচ্ছে না। চন্দ্র-নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন আয়োজন পণ্ড হয়েছে চিন জুড়ে। স্টারবাকস, কেএফসি, ম্যাকডনাল্ডস ও পিজা হাটের মতো বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ঘোষণা করেছে এই ছুটির মরশুমে তাদের শাখাগুলি তারা বন্ধ রাখবে। এরমধ্যে কয়েকটি কোম্পানি সমগ্র চিনজুড়ে ব্যবসা বন্ধ রেখেছে। বিভিন্ন প্রসাধনী কোম্পানিগুলি জানিয়েছে, বছরের এই সময় সাধারণত তাদের বেচাকেনার উর্ধ্বগতি থাকে কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে তাদের বেচাকেচা একেবারে কমে গেছে। করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে ক্ষতিগ্রস্থ হতে শুরু করেছে চীনের অর্থনীতি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যেমন চিন্তিত তেমনি বিনিয়োগকারীরাও এ নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে ভয়ঙ্করভাবে মার খেয়েছে পর্যটন ব্যবসা। এই সময় সারা বিশ্বের লোক আসেন চিন বেড়াতে কিন্তু ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে পর্যটন ব্যবসা ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চিনে। শিল্পগুলির সাপ্লাই চেন ভেঙ্গে যাচ্ছে যার ফলে পন্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে নতুন এক সংকটের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে চিনের অর্থনীতি।