Written By ঋতিকা দাস
নবম ও দশম শতকে বহু সহস্র শিল্পী একত্রে শুরু করেছিল তাদের শিল্প স্থাপন। সেই শিল্পের মাধুর্য এতটাই প্রবল এবং সৃষ্টি শৈলী এতটাই দৃঢ় যে লক্ষ লক্ষ প্রস্তর খন্ডও হয়ে উঠেছিল জীবন্ত। হয়তো সেই সমস্ত শিল্পকলার স্পর্শে খাজুরাহো এখনও দেশ বিদেশের পর্যটকদের চোখের মণি। প্রস্তর খন্ডকে যে বহু রূপে রূপান্তর করা যায়, তার সব থেকে বড় প্রমাণপত্র বোধহয় রয়েছে খাজুরাহোয়।
মধ্যপ্রদেশের এক অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রবিন্দু এই খাজুরাহো। নবম ও দশম শতক থেকেই শুরু হয়েছিল খাজুরাহে মন্দির নির্মাণের কাজ। সেই সময় খাজুরাহোতে ছিল চান্দেল রাজাদের রাজত্ব। তাদের তত্বাবধানে এখানে তৈরী হয়েছিল ৮৫টি মন্দির যার মধ্যে মাত্র ২২টি মন্দির এখনও পর্যন্ত টিকে থাকতে পেরেছে। এই ২২টি মন্দিরের মধ্যে আছে বিষ্ণু, শিব, লক্ষণ, দুর্গা, কৃষ্ণ ও জৈন প্রভৃতি দেব দেবীর মন্দির।
এত মন্দিরের মধ্যে একমাত্র জীবন্ত মন্দির হল মাতঙ্গেশ্বর মন্দির। এর গর্ভগৃহের নয় ফুট লম্বা শিবলিঙ্গ এখনও পর্যন্ত ফুল বেলপাতার ছোঁয়ায় তার জৌলুশ বজায় রাখতে পেরেছে। সকাল সন্ধ্যায় তার পুজার্চনায় ভক্তের ভিড় হয় দেখবার মত।
মাতঙ্গেশ্বর মন্দিরের কাছেই গড়ে উঠেছে একাধিক মন্দির যার মধ্যে আছে বিশ্বনাথ মন্দির, জগদম্বীর মন্দির, লক্ষণ মন্দির, চিত্রগুপ্ত বা সূর্যদেবের মন্দির এবং কাণ্ডারিয়া মহাদেবের মন্দির।
তবে এত মন্দিরের মধ্যে একমাত্র যশ বর্মন নির্মিত লক্ষণ মন্দির এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে সুরক্ষিত। এই মন্দিরের বাহ্যিক গঠন থেকে শুরু করে গর্ভগৃহ, সব কিছুই অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় অনেকটাই অক্ষত। মন্দিরের গর্ভগৃহেও শিল্প নিদর্শন দেখবার মত এবং সেখানেই বহু বছর ধরে একই ভাবে বসবাস করছেন ভগবান বিষ্ণু। আসলে লক্ষণ মন্দির হল বিষ্ণু দেবের মন্দির। সেই বিষ্ণু দেবের মূর্তির হয়তো অতীতের সেই মসৃণতা নেই, কিন্তু তা যে এক সময় ছিল তা মূর্তির গঠন শৈলী থেকেই প্রকাশ্যে আসে। মন্দিরের দরজায় মৎস্য অবতার ও বরাহ অবতার এবং চৌকাঠে সমুদ্র মন্থনের দৃশ্য, তাও স্পষ্ঠ ভাবে দেখা যাবে।
লক্ষণ মন্দিরের কাছে একই প্রাঙ্গনের মধ্যেই আছে কান্ডারিয়া মহাদেবের ১০০ ফুট উঁচু মন্দির। উচ্চতায় যা খাজুরাহের অন্যান্য মন্দিরকে ছাপিয়ে গেছে।
তবে এত কিছুর মধ্যেও সব থেকে বেশি যা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে তা হল, এই সমস্ত মন্দির গাত্রের বিভিন্ন ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকা নরনারীর মূর্তি। হয়তো কোনো নারী চোখের কোণে কাজল পড়তে ব্যস্ত, কেউ হয়তো নৃত্যের ভঙ্গিতে আপনাকে আহ্বান জানাচ্ছেন, কেউ বা তার প্রেমিকের সঙ্গে যৌন আবেদনে লিপ্ত। শুধু তাই নয়, ভিন্ন ভগবানের মূর্তিও চিহ্নিত করা যাবে তাদের মধ্য থেকে। তবে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা ও চোখের চাহনিতে তারাও কিছু কম নন। ব্রহ্মা থেকে বিষ্ণু, মহাদেব থেকে রামচন্দ্র, অপ্সরা কিংবা প্রেয়সীদের সঙ্গে তারাও যেন একাকার হয়ে যেতে চেয়েছেন। দেখলে মনে হয় এই সমস্ত কিছুর প্রস্তুতকারী শিল্পী মন্দিরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে যেন শিল্পকলাকে মাধ্যম করে কামসূত্রকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। কামসূত্র শব্দটা শুনে অবাক হবেন না, কারণ যারা সামনে থেকে দেখেছেন এই মন্দির এবং শিল্পকলার সঙ্গে যারা কিছুটা হলেও পরিচিত, তাদের এই অনন্য শিল্পের নিদর্শন আকর্ষণ করবেই। তবে আবেদন একটাই, চোখ থেকে ক্যামেরা সরিয়ে কিছুক্ষনের জন্যে হলেও মন্দিরের গায়ের কারুকার্য গুলো একটু পর্যবেক্ষণ করবেন। কারণ একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, এই শিল্পকলা আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
লক্ষণ মন্দিরের পাশেই আছে বিশ্বনাথ মন্দির, এবং সেই মন্দিরের সামনেই মহাদেব বাহন নন্দীর মন্দির বিরাজমান। সাত ফুট লম্বা এবং ছয় ফুট উচ্চতার মহাদেব বাহনের সারা দেহে রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর খোদাই করা মূর্তি। শিল্পীর ছোঁয়ায় তারাও উত্তম। সেই সমস্ত দেবদেবীকে সঙ্গে নিয়েই সহস্র বছর ধরে সম্মুখে থাকা মহাদেবের পাহাড়ায় বসে রয়েছেন নন্দী।
খাজুরাহের কাছাকাছি আছে শিবসাগর দীঘি। এখানেই আছে খাজুরাহোতে তৈরী হওয়া প্রথম মন্দির, চৌষটযোগিনি। সেখানে রয়েছে গ্রানাইট পাথরে তৈরী ৩৭টি ক্ষুদ্র মন্দির। মধ্যযুগে এই সমস্ত জায়গায় তান্ত্রিকেরা তন্ত্র সাধনা করতেন। এখনও সেখানে কিছু কিছু তান্ত্রিকের আবির্ভাব ঘটে। গ্রানাইটের ওপর মূর্তি গড়া সম্ভব নয় বলে, এই মন্দির গুলি মূর্তিশূন্য হয়েই রয়ে গেছে বছরের বছর। খাজুরাহের অন্যান্য মন্দির গুলি এই কারণেই স্যান্ডস্টোনে তৈরী হয়েছিল, যা মূর্তি তৈরী পক্ষে এক অনুকূল উপকরণ।
পান্না ফরেস্ট ও রাইনা ফলস, খাজুরাহের নিকটবর্তী আরও দুই ঘোরার স্থান। পঞ্চপাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস করেছিলেন এই পান্নার জঙ্গলে। তবে তাদের বসবাসের কোন চিহ্ন তারা রেখে যাননি। কিন্তু এই জঙ্গলের মধ্যে তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট ও বড় ঝর্ণা এবং তার জলে তৈরী হয়েছে এক মাঝারি আকারের জলাধার। সেই জলাধারের কাছেই গড়ে উঠেছে কয়েকটি গুহা। আর এই সমস্ত কিছুকে চারপাশ থেকে আবৃত করে রেখেছে বৃহৎ গাছপালার এক জঙ্গল। খাজুরাহো থেকে অটোয় আধঘণ্টার পথে যাওয়া যায় রাইনা ফলস। ক্রমাগত জলপ্রবাহের ফলে তৈরী হয়েছে এই ফলস। একই সাথে এই ফলসের জল বহু বছর ধরে তৈরী করেছে বেশ কিছু গভীর গিরিখাত। প্রকৃতির গড়া ভাঙায় তারাও হয়েছে অসাধারন।
ভারতের দেশি বিদেশি পর্যটকদের জন্য এ এক শিল্প মনোভাব প্রতিষ্ঠা করার জায়গা। পর্যটনের ভাষায় সিজিন বলুন বা অফ - সিজিন, ভিড়টা প্রায় একই রকমই থাকে। তবে আগে থেকেই সাবধান করে রাখা ভাল, গরমের তুলনায় শীতকালে যাওয়াটাই মঙ্গল। কারণ গরমের কাঠ ফাটা রোদে প্রস্তর খন্ডের চাকচিক্য না বাড়লেও মন্দিরের তাপের প্রতিফলন হবে ভয়ঙ্কর। ফলে মনের মধ্যে শিল্প ভাব জাগায় ভাটা পরবে। তাতে ঘোরার আমেজটাই বৃথা যাবে। তাই শীতকালেই খাজুরাহো যাত্রা বাঞ্ছনীয়।
কি ভাবে যাবেন ঃ
হাওড়া থেকে শিপ্রা এক্সপ্রেসে মধ্যপ্রদেশের সাতনা। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে খাজুরাহো।
হোটেল ঃ
খাজুরাহোয় প্রচুর বেসরকারি হোটেল গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন দামের এই হোটেল গুলি থাকার পক্ষে উপযোগী।
6th March, 2021 05:22 pm
5th March, 2021 01:57 pm
5th March, 2021 12:17 pm
4th March, 2021 01:38 pm