Written By অংশুমান কর
হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ঢুকছি। ফোন এল মালদার এক তরুণী কবির। কোনও ভণিতা ছাড়াই সে জিজ্ঞেস করল, “তোমার মত কী?” আমি বললাম, “কী নিয়ে?” সে বলল, “এই যে যা-সব হচ্ছে, সেইসব নিয়ে”। আমি বললাম, “কী সব হচ্ছে?” সে বলল, “তুমি ফেসবুক দেখোনি?” আমি বললাম , “ঢুকেছিলাম এক ঝলক, কিন্তু আমি ফেসবুকে পড়ে থাকি না। টুকটাক নিজের কাজ সেরে বেরিয়ে আসি সাধারণত। তাই কী হয়েছে জানি না!” সে বলল, “ওই যে রবীন্দ্রভারতীতে মেয়েরা পিঠে রোদ্দুর রায়কে লিখেছে, দেখোনি?” বয়সে সে আমার চেয়ে ছোটো, স্নেহাস্পদও বটে। তাই এইবার এক ধমক দিয়ে উঠলাম, “না দেখিনি, অত সময় নেই আমার। আর সব বিষয় নিয়েই কি আমাদের ভাবতে হবে নাকি?” হয়তো খানিকটা মন খারাপ করেই সে ফোন রেখে দিল। আমি অবশ্য টুক করে ফেসবুকে ঢুকতেই ৫ সেকেন্ডেই আন্দাজ পেলাম ঠিক কী হয়েছে রবীন্দ্রভারতীতে।
একদিন পরে গিয়েছি শান্তিনিকেতন। “আলোবাতাস”-এর বসন্তোৎসবে। স্কুটার রাখলাম স্টেশনে। যাব ট্রেনে, ফিরবও ট্রেনে। ফেরার সময় স্ট্যান্ড থেকে স্কুটার নিচ্ছি, বেশ অসুবিধে হচ্ছিল স্কুটার বের করতে। এক তরুণ এগিয়ে এল সাহায্যের জন্য। তারপরে স্কুটার স্ট্যান্ড থেকে ঠিকঠাক বের করা হলে, তরুণটি পরিচয় দিল তাঁর। জানলাম সে আমার প্রাক্তন ছাত্র। আমাদেরই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেসপন্ডেসে এম এ করেছে। বলল, “আপনি আমাদের ‘টম জোনস’ পড়িয়েছিলেন, মনে আছে”। আমি হাসলাম মৃদু। এরপরেই সে বলল, “আপনার সব লেখা পড়ি। কিন্তু রবীন্দ্রভারতী নিয়ে আপনার মত জানতে পারলাম না। আমি কি মনে করেন, ওরা ঠিক কাজ করেছে?” ছাত্র। তাঁকে ধমক দিতেই পারতাম। কিন্তু দিলাম না। বরং দু’মিনিট দাঁড়িয়ে বললাম, কী আমার অবস্থান দু’চার কথায়। তারপর স্কুটারে স্টার্ট দিলাম।
বাড়ি ফিরে ভাবছিলাম যে, কেন কবিতা লিখতে গেলাম, আর লিখলামই যদি তাহলে কেনই বা সেই সব লেখা ট্রাঙ্কে পুরে মহাকালের গর্ভে নিক্ষেপ করলাম না? কেন যে প্রকাশ করতে গেলাম সেইসব ছাঁইপাশ! কেনই যে সেইসব লেখা পড়েও নিলেন দু’চারজন আর আমাকে চিনেও নিলেন দু’চারজন! এই সব না-হলে, ‘কবির দায়’—মাথায় এই গন্ধমাদন পর্বত চাপিয়ে ঘুরে বেড়াতে হত না! আজ একটি পাতা খসে পড়লেও মানুষ জানতে চায় কী বলছেন লেখক-শিল্পীরা? আর সেই-পাতা যদি খসে পড়ে রাজনীতি বা সংস্কৃতির অঙ্গনে, তাহলে তো আর কথাই নেই!
মাঝে মাঝে ভাবি, ‘কবির দায়’ ঠিক কতখানি? এ কথা তো ঠিক যে, আমি সমাজের দিকে পেছন ফিরিয়ে থাকা মানুষ নই। ছোটোবেলা থেকেই বরং নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থেকেছি রাজনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে। সেদিক থেকে দেখলে, আমি একজন আদ্যন্ত রাজনীতি ও সমাজসচেতন মানুষই বটে! সমাজ-সংসারে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা নিয়ে আমি তো প্রায়শই লিখেওছি কবিতা। তখনও অবশ্য শুনতে হয়েছে, এই ঘটনাটা নিয়ে লিখলেন, ওই ঘটনা নিয়ে নিশ্চুপ কেন? আমার মতো অনেককেই শুনতে হয় এই প্রশ্ন। কী করে বোঝাই যে, সব ঘটনায় একজন কবি বা শিল্পীর অন্তঃপ্রকৃতি সমান ভাবে নড়ে ওঠে না। হতেও পারে যে, এই নড়ে ওঠাটির নিয়ন্ত্রক অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর আদর্শগত অবস্থান বা কখনও কখনও হয়তো বা সুবিধাবাদ। আঙুল আমার দিকেও তোলা যেতেই পারে, কেননা আমারও একটি নির্দিষ্ট রজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাস আছে। কিন্তু, সত্যিই কি আমরা যারা লিখি, আঁকি, নাটক করি, সিনেমা বানাই—তাঁরা সকলেই নির্লজ্জভাবে মতাদর্শতাড়িত বা সুবিধাবাদী হয়েই একটি ঘটনা নিয়ে কবিতা লিখি আর একটি ঘটনা নিয়ে লিখি না? এমনও কি হয় না, যে মন এক-এক দিন অন্য কিছু কারণেও পারিপার্শ্বের ডাকে সাড়া দেয় না? হয় তো। খুবই হয়।
নিজের কথা একটু বলি। লজ্জা লাগছে বলতে, তবু বলি। রবীন্দ্রভারতীতে রোদ্দুর রায় কান্ড যখন ঘটছে, তখন আমি একটি অন্য পারিবারিক সমস্যায় বেশ চিন্তিত। প্রায় আট মাস হয়ে গেল একটি ব্রেন স্ট্রোকের পর আমার ভাই, কবি অনির্বাণ কর, কোমাতে রয়েছে। তাঁর অবস্থা সম্প্রতি একটু জটিল হয়েছে। আবার একটি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। রক্তের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল কতগুলি। সেই পরীক্ষার রিপোর্টগুলি নিয়েই চিন্তায় ছিলাম বেশ। রিপোর্ট ভালো হলে, একদিনের নোটিশেই অস্ত্রোপচার হবে। খারাপ হলে, হবে না। কী হবে রক্তের রিপোর্টের ফল, হলে কী করব, এইসব ভাবনাই যখন ভাবছি তখনই ঘটছে রোদ্দুর রায় কান্ড। তারপরে এল রিপোর্ট। খারাপ। পিছিয়ে গেল অস্ত্রোপচার। আমি চলে গেলাম শান্তিনিকেতন। এখন প্রশ্ন হতে পারে, কেন গেলাম শান্তিনিকেতন? গেলাম তার কারণ, আমি একটু মুক্তির মধ্যে ঝাঁপ দিতে চাইছিলাম। কবিতাও কি লিখিনি এই সময়ে? লিখেছি তো, অনুরোধে লিখেছি রঙ নিয়ে ৫টি কবিতা, নিজেই এসেছে আর একটি কবিতা, তারও বিষয় ‘দোল’। তাহলে কেন রবীন্দ্রভারতী কান্ড নিয়ে মন সাড়া দিল না সেইভাবে? ভাবি। স্পষ্ট কোনও উত্তর পাই না। মনে হয় যে, যা হয়েছে, তাতে রবীন্দ্রনাথের বা বাঙালির সংস্কৃতির কণামাত্র ক্ষতি হয়েছে বলে আমার মনেই হয়নি হয়তো, তাই সাড়া দেয়নি মন। আবার হতেই পারে যে, মন পারিবারিক সংকটের মধ্যেই দোলকে বুঝতে চাইছিল একটু অন্যভাবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আবাসনের যে-বাড়িটিতে আমি থাকি, সেই বাড়িটির জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই ধরা যায় গুচ্ছ গুচ্ছ পলাশ। মন চাইছিল আর কিছুই না করতে, শুধু ওই পলাশের গুচ্ছের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে বসন্তের অর্থ বুঝতে। চাইছিল রাজনীতি বা সংস্কৃতির অঙ্গনে নয়, কীভাবে প্রকৃতির অঙ্গনে এই সময়েই নতুন পাতাকে জায়গা করে দেবে বলে খসে পড়ছে বুড়ো-বুড়ি পাতা সেই দৃশ্যকে অবলোকন করতে। মন যদি এইটুকুই চায় শুধু, মনকে কি দোষ দেব আমি?
যাঁরা দাবি করেন যে, কবি-শিল্পীরা সমাজ-সংসারের সব ঘটনাতেই নড়ে উঠবেন সমানভাবে, তাঁদের দোষ দেওয়ার কারণ দেখি না। কারণ, ইতিহাস বলে, সমাজ কবি-চিন্তক-লেখক-শিল্পীদের কথা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থেকেছে চিরকাল। গোল বাঁধে তখনই যখন সমাজ ভুলে যায় যে, কোনও কোনও দিন হয়তো অকারণেই কবির মন নড়ে ওঠে অন্য কোনও বিদ্যুৎ তরঙ্গের স্পর্শে। এই রকমটি ঘটা কিন্তু খুবই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক নয়।
দোলের দিনেও কি সবাই রঙ খেলেন? কেউ কেউ রঙের মেহফিল থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন না? সবার রঙে তাঁরা যদি সেইদিন রঙ না-মেলান, তাঁরা কি অপরাধী?