Written By অমর নন্দী
এক বসন্তের সকালে পৌঁছেছিলাম পাখিদের পাঠশালায়। বেশি দূর নয়। শহর কলকাতার একেবারে কাছেই। এক সবুজের গন্ধমাখা চৈতালি সকালে কোকিল, বসন্তবৌরি, চশমা টুনটুনি, মৌটুসী আর দোয়েলরা সমবেত কন্ঠের ভৈরবীর সুরে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। চিন্তামণি কর বার্ড স্যাঞ্চুয়ারি। কলকাতার কাছেই নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের শেষ গেট থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে। বাংলার পাখ পাখালির মুক্তাঞ্চল এই পাখিরালয়।
আসলে ‘কয়ালের বাগান’ বলে খ্যাত চিন্তামণি কর পাখিরালয় সোনারপুরে রাজপুর-সোনারপুর পৌরসভা অঞ্চলের উকিলা-পাইকপাড়া মৌজায় অবস্থিত। বিশ্ব বিখ্যাত ভাস্কর চিন্তামণি কর এই বাগান লাগোয়া অঞ্চলেই বসবাস করতেন। তাই তাঁর নামাঙ্কিত এই বাগানটি বনদফতর প্রথমে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসাবে অধিগ্রহণ করলেও পরে পক্ষী প্রেমীদের অনুরোধে ২০০৫ সালে ১৭.১৯ একর এই অঞ্চলটি নতুন করে চিন্তামণি কর পাখিরালয় হিসাবে নামকরণ করা হয়।
সকাল ৮টায় টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের তাপমাত্রা যেন নিমেষেই ৫ডিগ্রি কমে গেল। ভেতরে শতাব্দী প্রাচীন আম গাছে মুকুল ধরেছে। সকালের হালকা হিমেল হাওয়ায় মুকুলের গন্ধ ম ম করছে। পায়ে চলা জঙ্গলের মাঝে মাটির রাস্তা কিছুদূর গিয়ে একটা উঠোনের মতো জায়গায় পড়ল। অন্যপ্রান্তে খড়ে ছাওয়া সুন্দর একটা মাটির বাড়ি। জিজ্ঞাসা করে জানলাম এটা বনদফতরের অফিস। অফিসকে মাঝখানে রেখে রাস্তাটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে গভীরতর জঙ্গল ঝোপের দিকে চলে গেছে। ধীর পায়ে চলতে চলতে হয়তো চোখে পড়বে কোনো বেজি বা কাঠবিড়ালির চকিতে থমকে চাওয়া। নয়তো কোনো শুকনো পাতার ওপর খসখস আওয়াজ করে চলে যাওয়া কোনো গিরগিটি। গাছপালা, গুল্মলতার ডালে ডালে নেচে গেয়ে চলছে পাখিদের কনসার্ট। বিচিত্র তার সুর ও ধ্বনি। ওদিকে দু-একজন করে পক্ষী প্রেমীদের দল ভিড় করতে শুরু করেছেন। হাতে মস্ত সব ডিএসএলআর নিয়ে চলেছে পাখি নিরীক্ষণ আর ফটোশ্যুট। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম আরো গভীরে। পথ ডাইনে-বাঁয়ে ভাগ হয়েছে কোথাও। বড় বড় আম, অর্জুন, খিরিশ, কৃষ্ণচূড়া, নিম, শিশু, বকুলের সঙ্গে নানা জাতের বাঁশ, ছোট গুল্ম লতা, আঁশশ্যাওড়া, ধুতরা, দারুচিনি, নীলকান্ত, ভূঁই আমলা, আর বন ওখড়া মিলে মিশে এক ছায়া ঘন সবুজ অন্ধকার পরিবেশ। বুনোফুল আর আমের মুকুলের গন্ধে ওড়াউড়ি করছে হরেক রঙের প্রজাপতি। জানলাম সাধারণ হলুদ রঙের লেমন ইমিগ্র্যান্ট, ইন্ডিয়ান জিজাবেল, ব্লু মর্মন, কমন মর্মন, ইন্ডিয়ান ওয়ান্ডারার, বর্ডার জেব্রা ব্লু আর গ্রাস ডেমনের মত অজস্র প্রজাপতি রয়েছে এই পাখিরালয়ে। আর বাংলার সাধারণ পাখি যেমন চিল, মধুচিল, বাজ, টিয়া, নানা জাতের টুনটুনি, রাজ ঘুঘু, তিলে ঘুঘু, পাপিয়া, মৌটুসী, কোকিল, বুলবুলি, ধানপাতি, বেনে বউ যেমন আছে তেমনই দেখা মেলে ডাহুক, নানান বক, পানকৌড়ির মত জলচর পাখিদেরও।
জঙ্গলের মাঝে মাঝে সিমেন্টে বাঁধানো রয়েছে নানা আকৃতির ওয়াটার বডি। পাখিরা মহা আনন্দে জল পান আর জলকেলি করে এই জলে। সব থেকে মজার দৃশ্য হল এদের স্নান। একটু এগিয়ে দেখি দুটি পক্ষী প্রেমী ঝোপের আড়ালে পাখিদের স্নানের দৃশ্য ধরে রাখার জন্য ক্যামেরা রেডি করে চুপটি করে বসে আছেন। তাঁদের সঙ্গে আমি ও আমার ফটোগ্রাফার সঙ্গী বিমলদা দাঁড়িয়ে গেলাম। পরপর ক্যামেরাবন্দি করা হল একে একে বিভিন্ন পাখির স্নানের দৃশ্য।
প্রথম এল বুলবুলির দল। মনের সুখে স্নান করে উড়ে যাওয়ার পর এল ছোট্ট চশমা টুনটুনির দল। অনেকে আদর করে বলে ‘শ্বেতাক্ষী’। আড়াই তিন ইঞ্চি লম্বা এই পাখির চোখের চারপাশে চশমার মতো সাদা একটা বর্ডার এর সৌন্দর্যকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। নাচতে নাচতে লাফাতে লাফাতে ৪-৫ জনের এই টুনটুনির দল এ ডাল ও ডাল করে লাফাতে লাফাতে জলে নেমে এসে সারা গায়ে ফোয়ারার মত জল ছিটিয়ে মহানন্দে স্নান করল অনেকক্ষণ। ক্যামেরায় ননস্টপ শাটার পরলো। একটা বিষয় খুব মজার, যখন যে দল স্নান করছে তখন তাদের অন্যরা কিন্তু বিরক্ত করছে না। ওদের স্নান সারা হলেই নেমে আসছে অন্য প্রজাতির পাখি। এদের শৃঙ্খলা দেখে অবাক হতে হয়। কয়েক ঘণ্টা শুধু পাখিদের জলকেলি দেখে কাটলাম। একদম শেষে এল চাকদোয়েল বা ফানটেল।
অনিন্দ্যসুন্দর দু’খানি ডানা মেলে বিচিত্র ভঙ্গিতে স্নান করা দেখে আরো এগোলাম সামনের দিকে। জঙ্গলের মাঝেই একটা ছোট বোর্ডে এখানে লেখা রয়েছে এই বনের নানান স্তন্যপায়ী আর সরীসৃপের ছবি ও তাদের তালিকা। এর পাশ দিয়ে একটু ভেতরে এগোলেই ফরেস্ট গার্ডদের থাকার সবুজ রংয়ের কোয়ার্টার। নানা জাতের সাপ যেমন গোখরো, চন্দ্রবোড়া,কালাচ, লাউডগা, দাঁড়াশ এখানে দেখা যায়। তার সঙ্গে আছে গেছো ব্যাঙ, বুনো ব্যাঙ, গিরগিটি ও নানান জাতের গোসাপ। এত ঘন বাগান, অথচ শিয়াল থাকবে না, তাও কি হয়? আছে গোল্ডেন জ্যাকেল। একটু সন্ধ্যা নামলেই এদের কোরাস গানও শোনা যায়। আছে কাঠবিড়ালি, বনবিড়াল, বেজি, মেঠো ইঁদুর আর বুনো খরগোশ।
একজন ভিজিটরস জানালেন যে একটি আম গাছের কোটরে থাকত এক পেঁচা দম্পতি। সম্প্রতি অবশ্য পুরুষ পেঁচাটি মারা যাওয়ায় মেয়ে পেঁচাটি নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছে। পশুপাখিদের জল খাবার জন্য পাখিরালয়ের দুই প্রান্তে খনন করা হয়েছে ২টি পুকুর। ডান দিকের রাস্তা বরাবর যেতে গিয়ে দেখি, ওধারে একটি মস্তকহীন বড় নারকেল গাছের কোটরের নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে একটি টিয়া উঁকি মেরে মাঝে মাঝে আমাদের দেখছে। আবার কী ভেবে ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ এই লুকোচুরির পর আমরা যখন ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছি, দেখি ফরেস্ট অফিসের ঠিক পেছনে খসখস আওয়াজ। থমকে দাঁড়িয়ে দেখি প্রায় ৬ ফুট লম্বা বিশালাকার এক গোসাপ স্লথ গতিতে এদিক-ওদিক একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে, সম্ভবত আমাদের বিদায় জানিয়ে হেলতে-দুলতে আবার জঙ্গলের মধ্যে সেধিয়ে গেল।
কলকাতার কাছেই নাগরিক জীবনের অবসরে প্রাণভরে প্রশ্বাস নিতে যেকোনও সময় চলে আসাই যায় ঘরের কাছের এই মায়াকাননে যে কোনদিনই। তবে এই বসন্তকাল হল সব থেকে আদর্শ সময়। বাগান খোলা থাকে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।