Written By বিপাশা রায়
সালটা ছিল ১৮৮৬। আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল সেই সময় থেকেই| এরপর ধীরে ধীরে সেই আন্দোলন রূপ নেয় এক বড় আকারে| ১৮৯০ সালে আমেরিকার শিকাগোতে হে মার্কেটের সামনে সেদিন যে ঘটনা ঘটেছিল তা হয়তো আজও অনেকেই ভুলে যাননি| শ্রমিকদের কাজের নির্ধারিত সময়ের দাবিতে ছিল আন্দোলন| মানে তার আগে শ্রমিকদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় বলতে কিছু ছিল না| কিন্তু তার জন্য তাঁরা কখনও কোনোদিন উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেতো না| ফলে ধীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ জমতে জমতে তা এক বিশাল আন্দোলনের আকার নিয়েছিল| সেখানকার সরকার সেদিন পুলিশকে ডেকে নির্দেশ দিয়েছিল গুলি চালানোর| অগত্যা পুলিশ গুলি চালিয়েছিল এবং সেই গুলির আঘাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক| আন্দোলনে দোষী সাব্যস্থ করে চার শ্রমিককে ফাঁসি দেওয়া হয়। শ্রমিকের সেই রক্তে ভেজা কাপড় থেকেই জন্ম নিয়েছিল লাল পতাকা| আর সেই পতাকাকে সামনে তুলে ধরে শুরু হয়েছিল শ্রমিকের স্বার্থে আন্দোলন| আজ ১৩৪ বছর পরেও সেই লাল পতাকার রঙ কোথাও ফিকে হয়ে যায়নি| কারণ,গোটা বিশ্বে যত মানুষ আছেন তাঁরা প্রত্যেকেই শ্রমিক| সেই শ্রমজীবী মানুষের ডাকে আজও গর্জে ওঠে পয়লা মে| গোটা বিশ্বজুড়েই যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হয় এই দিনটি। একজন শ্রমিকের আটঘন্টা কাজের দাবিতে শুরু হয় এই আন্দোলন। এর বাইরে তাঁকে কাজ করাতে গেলে তাঁকে বাড়তি পারিশ্রমিক দিতে হবে| এটা চলে আসছিল বহু বছর ধরে| কিন্তু কালের বিবর্তনের ফলে সেদিনের আন্দোলনের সেই রূপরেখার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে| এখন বর্তমানে সেই দাবিকে অনেক মালিকপক্ষই আর মানেন না| পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ আজও অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে শুধুমাত্র নিজের পেটের দায়ে| আর মালিকপক্ষ সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে খাটিয়ে নিচ্ছে কখনো দশঘন্টা তো কখনো বারো ঘন্টা| কোনো হিসেবটাই থাকছে না| আর কাজের জন্য কেউই বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কিছু বলতে সাহস করছেন না এই ভেবে যে কাজটাই যদি চলে যায় তাহলে খাবে কি করে| তাই ধীরে ধীরে মে দিবসের যে আদর্শ যে বৈচিত্র্য যে প্রেক্ষাপট তা ক্রমশই হারিয়ে যেতে বসেছে| বর্তমানে অনেক সংস্থাই আছে যেখানে শ্রমিকের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজ এই নিয়মকে মানতেই চায়না| নিয়মকে রীতিমতো বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজেদের ক্ষমতাকে প্রদর্শন করে চলেছে প্রতিমুহূর্তেই| আর তার শিকার হতে হচ্ছে আমার আপনার মতো সকলকেই| তবু মুখ বুজে সবকিছুকেই সহ্য করে যেতে হচ্ছে নিজের কথা ভেবে,নিজের পরিবারের কথা ভেবে|
বর্তমানে গোটা বিশ্ব জুডে় এখন যে পরিস্থিতি তাতে এখনই কত মানুষ তাঁর নিজের কাজ হারিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই| কবে যে থামবে এই করোনা ভাইরাসের আক্রমণ আর কবে যে উঠবে এই লকডাউন তা কেউই জানে না| ফলে যতদিন যাচ্ছে ততই যেন মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে| এই সুযোগে গুজরাট সরকার সেই রাজ্যের ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে একত্রিত হয়ে সেখানে বারো ঘন্টার ডিউটি চালু করে দিয়েছে| যা সম্পূর্ণ বেআইনি| গোটা বিশ্বের নিয়মের বাইরে গিয়ে কখনই এটা করতে পারে না কিন্তু তারা করে দিয়েছে| এখন যে অবস্থা তাতে করে দেশে একমাত্র সরকারি কর্মচারীরাই একমাত্র আটঘন্টার কাজ করে, বাকি আর কেউই সেই নিয়মের বেড়াজালের মধ্যে থাকে না| আর মালিকের তো এই উদ্বৃত্ত শ্রমটাই হল পুঁজি| কিন্তু বর্তমানে সেই মালিকপক্ষও আজ অমানবিক হয়ে পড়ছে প্রতিমুহূর্তে| তাই তাঁরা শুধু দেখে তাদের স্বার্থ সম্পূর্ণ হল কিনা| তাঁদের মুনাফা অর্জন হল কি না? তাঁরা কখনই সেই অর্থে কোন শ্রমিকের স্বার্থই দেখে না| তবে এটাও ঠিক যে সব মালিক কিন্তু আবার সমান হয় না| এরমধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা নিজের স্বার্থের সঙ্গে শ্রমিকের স্বার্থকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখেন| আজ একদিকে যখন মে দিবস পালন করার কথা ভাবছে সকলে তখন পাশাপশি তাঁরা সকলেই ভাবছেন কি হবে রাজ্য,দেশ তথা গোটা বিশ্বের| বর্তমানে যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে করে যাঁরা আজ এই করোনা ভাইরাসের আক্রমণের জন্য নিজেদের জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছেন তাঁদের কি হবে? ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই মে দিবসের গুরুত্ব কতখানি, কেনো মে দিবস,কবে থেকেই বা পালন করা হয় এই সব এখনকার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আলোচনা করা অবান্তর, তার কারণ আমাদের গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের ইতিহাস সকলেরই প্রায় জানা। কিন্তু হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা এই সব ঐতিহাসিক দিনগুলিতে একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করে, যা ইতিহাসের পাতাকে ছাপিয়ে যায়। আজকের দিনটাও কিন্তু ঠিক সেইরকমই এক বিশেষ মাত্রা পেয়েছে।
আজ যখন একটি একগ্রাম ওজনের ছোট্ট ভাইরাস যাকে চোখে দেখা যায় না পর্যন্ত, সেইরকম একটি ভাইরাসে আক্রান্ত ও জর্জরিত গোটা বিশ্ব, যখন তারা এই কোরোনা ভাইরাস এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত তখন এই ঐতিহাসিক দিনটি আরেকবার নতুন করে ইতিহাসের পাতায় নতুন মাত্রা যোগ করে নতুনভাবে নিজের স্থান করে নিল। তার কারণ আজকের এই মহান দিনটিতে বহু শ্রমিক কর্মহারা, বহু শ্রমিক গৃহছাড়া। প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে বাড়ি ফেরার পথে অমানুষিক পরিশ্রম ও ক্ষুধা জ্বালায় পথের ধুলোতেই লুটিয়ে পড়েছে তাঁদের প্রাণহীন দেহ। এই কোরোনা ভাইরাসের জের তাঁদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে, জীবনের গতিবিধিকে স্তব্ধ করেছে। বহু শ্রমিক যারা পেটের দায়ে নিজের ভিটে মাটি ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে কাজ করতে গিয়েছিল তারা আজ সেই সব জায়গায় বন্দি। এই মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে, এই মহামারীর সময় নিজেদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোরও উপায় নেই তাঁদের। ছোটো ছোটো কলকারখানা বা ছোটো ছোটো কোম্পানি গুলি নিরূপায় হয়ে শ্রমিকদের ছাঁটাই করে চলেছে। সবথেকে অসহায় অবস্থা তাঁদের যাঁরা কুলি মজুর বা দিন আনে দিন খায় এমন মানুষদের। সারা দিনে মজুরী করে যদি বা দু’বেলা দুই মুঠো অন্ন জুটতো আজ এই কোরোনা তাঁদের সর্বশান্ত করেছে। সারা দেশে লকডাউনের ফলে এইসব মানুষ গুলোর কাছে আজ কাজ নেই, তাঁরা জানে না কি করে ঘরের ছোটো ছোটো বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখবে। যদিও প্রশাসন তাঁদের সহায়তা করতে উদ্যত হয়েছেন কিন্তু তবু্ও তাঁরাই বা কতদিন অবধি তাঁদের এই ভাবে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন সেটা বলা খুবই মুশকিল। বড় বড় কোম্পানি গুলি যদি বা ভবিষ্যতে আবার নিজেদের জায়গা করে নেবে আশা করা যায়, কিন্তু এইসব কুলী মজুর বা এই ধরণের শ্রমিকরা আবার কী ভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবে সেটা সত্যিই ভাববার বিষয়। সুতরাং বলা যায় আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই শ্রমিক দিবস এমন এক ইতিহাস তৈরি করলো যার গুরুত্ব অপরিসীম, যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক দিন রূপে গণ্য হবে বলে আশা করা যায়। এখন দেখার বর্তমান এই অবস্থা থেকে আমরা কত তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হতে পারি| ঐতিহাসিক মে দিবসের গুরুত্বকে যেন আমরা কেউই কোনোদিন ভুলে না যাই| তবেই স্বার্থক হবে সেদিনের আন্দোলন|
very nice
??????? ??????
Mind blowing ????????