Written By বিপাশা রায়
‘উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্ত মাঝে, চিরনূতনের দিলো ডাক, পঁচিশে বৈশাখ।’
পাখীর কলকাকলির সঙ্গে দূর থেকে ভেসে আসা এই গানে ঘুম ভাঙ্গলো। আজ পঁচিশে বৈশাখ| পঁচিশে বৈশাখ বললেই আমাদের সবার মনের মাঝে গুরুদেবের ছবিটাই জ্বলজ্বল করে ওঠে, আলাদা করে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না যে আজ রবি ঠাকুরের জন্মদিন, আজ বিশ্বকবির জন্মদিন, কারণ তিনি যে আমাদের অত্যন্ত কাছের এবং অত্যন্ত সাধের রবি ঠাকুর। প্রতি বছরের মতো আজও দিনটা শুরু হল চিরনূতনের শঙ্খ ধ্বনি দিয়ে। এই বছর গুরুদেবের একশো ঊনষাট তম জন্মদিন। পাড়ায় পাড়ায় অলিতে-গলিতে প্রতিটি ঘরে ঘরে রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব পালনের আয়োজন যে শুরু হয়ে যায় প্রতিবছর ভোর থাকতেই, কিন্তু এইবছর একটু ব্যতিক্রম থাকবে সেটা সকলেরই জানা| তবে ভোর থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে অবিরাম রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানোর মধ্যে দিয়ে। চতুর্দিকে সাজো সাজো রব। কোথাও তাঁর গান, কোথাও বা কবিতা পাঠের আসর, কোথাও আবার নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করা হবে। কবির ভাণ্ডার তো তাঁর সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ, তাই সবাই নিজের ইচ্ছে মতো তাঁর রচিত গান কবিতা নাচ ইত্যাদি পরিবেশন করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানায় ঠিক গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোর মতো করে।
এই দিনটি আমার কাছেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। যাঁর ভাবধারাকে পাথেয় করে আজও এগিয়ে চলেছি, সেই গুরুদেবের আবির্ভাবের দিনটি আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন না হয়ে যায় কোথায়। আর পাঁচ জনের কাছে রবিঠাকুরের অস্তিত্ব কতখানি জানি না, তাঁদের কাছে হয়তো শুধুই তিনি বিশ্বকবি, অথবা গীতাঞ্জলির রচয়িতা কিংবা একজন মহাপুরুষ, কিন্তু আমার জীবনে রবিঠাকুর এসেছেন সম্পূর্ণ অন্য এক রূপে। তিনি আমার প্রাণের ঠাকুর, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁকে অনুসরণ না করলে যেন জীবনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে প্রতিমুহূর্তেই। তিনি আমার প্রাণের আরাম মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি।
বেশ মনে পড়ে, তখন আমি ইস্কুলেও ভর্তি হইনি, খুব ছোটো, তখন ভাই বোনেদের সঙ্গে এই আজকের দিনে সুন্দর করে গুরুদেবের একটি ছবিতে মালা দিয়ে সাজিয়ে, চন্দনের ফোঁটা দিয়ে, ফুল দিয়ে ঠিক পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার মতো করে আমাদের শ্রদ্ধা অর্পণ করতাম। তারপর যে যা পারতাম, কেউ নাচ, কেউ গান কেউ কবিতা আবৃত্তি করে তাঁকে স্মরণ করতাম। শুধু কচিকাঁচার দল নয়, বড়রাও আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন, আর এই সমগ্র অনুষ্ঠানটির পরিচালনার দয়িত্বভার নিতেন আমাদের পরম প্রিয় দাদু। তখন থেকেই মা’কে বলতে শুনেছি আমাকে নাকি হোস্টেলে যেতে হবে, এই রবিঠাকুরের জায়গায়। তখন আমার শিশু মনে কবির দার্শনিকতা বা ভাবধারার বিকাশ ঘটেনি, ঘটবার কথাও নয়। শুধুমাত্র কতগুলি ছড়া আর সহজ পাঠ প্রথম ভাগের কতগুলি সুন্দর সুন্দর গল্প মনের গভীরে দাগ কেটেছিল। তাই হোস্টেল এর বাকি আনুষঙ্গিক ব্যাপার গুলি সবথেকে চিন্তা জনক হয়ে উঠেছিল।
তারপর একদিন যথারীতি মা বাবার হাত ধরে শান্তিনিকেতনের মাটিতে পা রাখলাম, সেই প্রথম আমার কবিগুরুর ভাবনার সঙ্গে পরিচয়। সেখানকার ধরণ ধারণ,কথা বলা, হাঁটা,চলা সবকিছুর মধ্যেই রাবীন্দ্রিক ভাবধারা লুকিয়ে আছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে পড়াশোনা করতে গিয়ে বুঝেছিলাম শৈশবের চঞ্চল মনটাকে তিনি বুঝতেন অনেক বেশী। লেখা পড়ার কঠিন রূপটা যাতে শিশু মনের সর্বাঙ্গীন বিকাশে বাধার সৃষ্টি হয়ে না দাঁড়ায় তাই এ হেন ব্যবস্থা। আমার সবথেকে বেশী প্রিয় ছিল বাংলা ক্লাস। তাঁর প্রতিটি গল্প কবিতা পড়তে গিয়ে মনে হত সত্যিই যদি জীবনটাকে এই ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম। প্রথম যেদিন ‘শিশু’ নামক কবিতার বইটি পড়েছিলাম সেদিন মনে হয়েছিল একটি শিশুর মনের বিকাশের পরিচায়ক হল এই কবিতা গুলি। তাঁর বীরপুরুষ কবিতাটি না পড়লে বোঝা যাবে না যে একটি শিশু তাঁর মা’কে কতখানি ভালোবাসলে আর সম্মান করলে তাঁকে ওই আসনে বসাতে চায়। তাঁর শিশু মনের পরিচায়ক ওই রাঙা ঘোড়াটি। গুরুদেবের শিক্ষার অঙ্গ শুধুমাত্র তাঁর কবিতা বা গল্প ছিল না। জীবনে চলার পথে যে একাগ্রতার প্রয়োজন আছে তার নিদর্শন পাই তাঁর প্রচলিত বৈতালিক আর উপাসনার মধ্যে দিয়ে। যে কোনো অনুষ্ঠানের পূর্বে আমাদের বৈতালিকে যেতে হতো। শালবিথি, আম্রকুঞ্জ পার করে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে শান্তিনিকেতন বাড়ির সামনে দিয়ে উপাসনা গৃহের সামনে দিয়ে চলে যেতে হতো সোজা ছাতিমতলায়। কত গান করতাম মনের আনন্দে। আর এই বৈতালিক এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে ছিল উপাসনা। গান শেষ করে ফের সাদা পোষাকে যেতে হতো উপাসনা গৃহে, সেখানে উপনিষদ থেকে পাঠ করা হতো এবং গানের মধ্যে দিয়ে শেষ হতো উপাসনা। আমাদের শাস্ত্রসম্মত পুজোর কঠিন উপাচার ছিল না সেখানে, সবকিছুই অত্যন্ত সহজ সাবলীল ছন্দে সম্পন্ন হত। অত্যন্ত সহজ চলনের বেগ আর সাবলীল ছন্দেও যে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তাঁর শিক্ষার মধ্যে সেটি প্রতিফলিত হয় আজও। কবি একাধারে ছিলেন একজন দার্শনিক, সঙ্গীতকার, লেখক, ঔপন্যাসিক, চিত্রকর আরও অনেক কিছুই। এমন কোনো বিষয় নেই যে বিষয়ে তিনি কিছু লিখে যাননি বা কাজ করে যাননি| এই সমস্তকে তিনি মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছেন, তার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর গান কবিতা তাঁর সবকিছুর মধ্যে দিয়ে। গোরা উপন্যাসের মধ্যে তাঁর দার্শনিক মনের প্রকাশ পাওয়া যায়। ধর্মের গোঁড়ামি যে মানুষকে কোন পথে নিয়ে যেতে পারে তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন এটি। আবার এই কবিই লিখেছেন ‘শেষের কবিতার’ মতো পরিপূর্ণ একটি প্রেমের কাব্য। ভালোবাসার মধ্যে যে ত্যাগের অস্তিত্বটাই প্রবল সেটা বেশ ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর কাছেই শিখেছি ভালোবাসার পূর্ণতা ভোগে নয় ত্যাগে। তাঁর রক্তকরবী নাটক সমাজের তিক্ততাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। অন্ধকার কঠিন জঞ্জালের মধ্যে থেকে যে ছোট্ট চারা গাছটি কঠিন মাটি ভেদ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে প্রাণের অস্তিত্বকেই শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করেছে নাটকটি,ওটা তার প্রমাণ। কিন্তু সামাজিক নীতির দাপট বারবার তাকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অবশেষে জয়ী হয়েছে এই প্রাণের প্রতীক। কবির এই ধরণের রচনাগুলি থেকে প্রমাণ হয় যে তিনি আশাবাদী ছিলেন। কবির সমগ্র রচনার নিদর্শন তুলে ধরা অল্প পরিসরে নিতান্তই কঠিন। তবে এটুকু বলতে পারি জীবনের প্রতিটি স্তরে নিজেকে কী ভাবে এগিয়ে যেতে হবে সেই শিক্ষা লাভ করেছি তাঁর থেকে। একজন নারী হিসাবে আমার ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা কখনোই জানতে পারতাম না যদি না চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যটি পড়তাম। নারীর যথার্থ সংজ্ঞা তিনিই ব্যক্ত করেছেন তাঁর চিত্রাঙ্গদা নাটকে। জীবনে চলার পথে তিনিই একমাত্র আমার পথপ্রদর্শক। আজও তাঁর দেখানো পথেই ধাবিত হই। সুখে, দুঃখে, আনন্দে, বিরহে তাঁর বাণীই আমার একমাত্র সম্বল এবং সহায়ক। আর আমার মনে হয় এটা শুধু আমার নয় এই বাণী সর্বকালের সর্বজনের সুখ দুঃখের সাথী। আমাদের অত্যন্ত কাছের। তাই রবিঠাকুর আমার কাছে আজও জীবিত। আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথ পথপ্রদর্শক। তার হাত ধরেই আমার বড় হওয়া আর তাঁকে কেন্দ্র করেই আমার পথ চলা। যতদিন এই পৃথিবীতে থাকবো তাঁর ভাবধারাকে সঙ্গী করেই বেঁচে থাকবো। রবীন্দ্রনাথ কোনোদিন ফুরিয়ে যাবেন না। তিনি চলমান। যুগ যুগ ধরে জীবনকে এই ভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তার কারণ তিনি যে কেবলমাত্র সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যেই আবদ্ধ থাকেননি| তিনি একাধারে সাহিত্যকেও যেমন প্রাধান্য দিয়েছেন ঠিক তেমনই প্রকৃতিকেও তিনি চিনতে শিখিয়েছেন নতুন করে| তাঁর সেই ব্যক্তচিত্তে প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে ওঠার অভ্যাস আজও যায়নি আমার| এক পঁচিশে বৈশাখের সকালে সাদা পোষাকে হোস্টেলের বাইরে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম উপাসনা গৃহে যাওয়ার জন্য, ঠিক তখনই নীল আকাশের বুক থেকে নেমে এসে একটা শালিক পাখি আমাকে যেন কানে কানে বলে গেল,জানো, আজ বিশ্বকবির জন্মদিন| অবাক হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন এই কথা ভেবে, যে, একটা পাখিও তোমার থেকে কতকিছুই না শিখেছে| সেও মনে রাখে তোমার জন্মদিনকে| আর সত্যিই তো তুমি না থাকলে আমার প্রকৃতিকে চেনাই হতো না,তুমি না থাকলে এতো গাছপালা,এতো পাখিদের নাম জানতাম না, তুমি না থাকলে ঋতুর নানান রূপকে দেখতেই পেতাম না| বেশভালো মনে পড়ে শান্তিনিকেতনে থাকার সময় কখনও কোনোদিন হাতে ঘড়ি পরেছি বলে মনে পড়ে না| কারণ, তোমার প্রকৃতির মধ্যে দাঁড়িয়েই অনায়াসে বলে দিতে পারতাম কটা বাজে ঘড়ির কাঁটায়| বসন্ত আগত হলেই মনটা আনচান করে উঠত কখন গিয়ে মনের আনন্দে তোমার গানের সঙ্গে একটু মনপ্রাণ ভরে নাচবো| তোমার শিক্ষাই আমাকে ঋতু পরিবর্তনের সবদিক চিনতে শিখিয়েছে| তাই শান্তিনিকেতনে সেই আশ্রমের গন্ধ আজও আমার গায়ে মেখে আছে সেই প্রথম দিনের মতোই| আমার মনে পড়ে না যে একটা দিন এমন ছিল না যেদিন তোমার গান না গেয়ে খেতে গিয়েছি আর ফিরেছি হোস্টেলে| তোমার গান,তোমার কবিতা,তোমার লেখা আমার প্রাণের হৃদস্পন্দনকে যেন আজও বাঁচিয়ে রেখেছে| তাই তুমি ছাড়া আমার বেঁচে থাকাটাই যেন ব্যর্থ| এই বিশ্বভুবন মাঝে তোমার সৃষ্টিকে গায়ে মেখেই প্রতিটা দিন পার করি আমি| তাই তোমার জন্মদিনে আর পাঁচজনের মতো তোমাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করার ইচ্ছাটুকু আমার নেই,কারণ, আমি যে প্রতিটি দিন তোমাকেই সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াই এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত| তোমার জন্মদিনে শুধু তোমার কথা ভেবে, তোমার গান গেয়ে, তোমার লেখা পড়েই আমি কাটিয়ে দিতে চাই আজকের দিনটাকে| আর শেষবেলায় কবি দেবব্রত দত্তের লেখা কটামাত্র লাইন সকলের জন্য রেখে গেলাম, যার মধ্যে দিয়ে সকলে অন্তত একবার তোমাকে স্মরণ করতে শিখবে তোমার দেখানো পথ ধরেই|
আমার রবীন্দ্রনাথ - - -
দেবব্রত দত্ত
যখন আমি অঘোর ঘুমে, যখন মধ্যরাত,
তখন যাঁকে স্বপ্নে দেখি তিনিই রবীন্দ্রনাথ।
যখন আমার দুঃখ কষ্ট ভিতরে অশ্রুপাত,
তখন যিনি দুঃখ ঘোচান তিনিই রবীন্দ্রনাথ।
যখন আমি হারিয়ে যাই, কেউ ধরেনা হাত,
তখন যিনি পৌঁছে দেন তিনিই রবীন্দ্রনাথ।
JAWED HASSAN
JAWED HASSAN
JAWED HASSAN