Written By তন্ময় ঘোষ
কি ভালো লাগে না যখন টেলিভিশনের পর্দায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ ভেসে ওঠে আর নরম মোলায়েম গলায় তিনি জানিয়ে দেন যে দেশের ৮০ কোটি মানুষ বিনা পয়সায় খাবার পাবে? তাঁর সরকার নাকি লকডাউনে বিনা পয়সায় খাইয়েছেন এবং আগামী দিনে উৎসবের মরশুমে বিনামুল্যে রান্নাঘরে আলো জ্বালাবেন। আসুন দেখে নেওয়া যাক ভারতবর্ষের এই বিনা পয়সার বায়োস্কোপের নেপথ্যের চিত্রটা।
অন্ধ্রপ্রদেশ, গোয়া, গুজরাট, ঝাড়খন্ড, লাদাখ, মহারাষ্ট্র, মেঘালয়, ওডিশা, সিকিম, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, ত্রিপুরা। ১২টা রাজ্য করোনা পরবর্তী সময়ে গুরুত্বই দিলো না মোদীজির এই স্বপ্নের বিনা পয়সার রেশন পদ্ধতিকে। মোদী সরকারেরই রিপোর্ট বলছে যে এই রাজ্যগুলো যা খাদ্যশস্য কেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করেছে তার এক শতাংশও বন্টন করা হয়নি। গোয়া এবং তেলেঙ্গানা বন্টনই করেনি এপ্রিল এবং মে মাসের বরাদ্দ কোনো খাদ্যশস্য। বিহার, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু , সিকিম এবং লাদাখ জুনের কোনো খাদ্যশষ্যই বন্টন করেনি। সরকার ইতিমধ্যেই বড়ো মুখ করে প্রচার শুরু করে দিয়েছে যে গোটা লোকডাউনে গরিব মানুষদের মুখে বিনা পয়সায় খাবার তুলে দিয়েছে তারা। নির্মলা সীতারামান থেকে দেশের চৌকিদার - সকলেই ঢাক পেটাতে শুরু করেছেন যে দেশের প্রায় ৮০ কোটি মানুষের অন্নকষ্ট দূর করলো এই সরকার। এমনকি রেশন কার্ড নেই এমন ৮ কোটি মানুষকেও সাহায্য করেছেন মোদী সরকার। কিন্তু বাস্তবে যে কেন্দ্রীয় শস্যভান্ডারের ১% ও খরচ করা হয়নি সেই পরিসংখ্যান প্রকাশ করে দিল মোদী সরকারেরই মিনিস্ট্রি অফ কনসিউমার অ্যাফেয়ার্স, ফুড এন্ড পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন। এই ১২ টি রাজ্য বরাদ্দ শস্যের প্রায় ৮০% তুলে নিয়েছে যা প্রায় ৮ লক্ষ টনের কাছাকাছি কিন্তু বন্টন করেনি তারা। এমনকি মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটও বিনা পয়সার চাল নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতে রাজি নন। কিন্তু এই পরিমাণ খাদ্য শস্য বিনা পয়সাতে মোদী সরকার দিতে চাইলেও কেন রাজ্যগুলো বিষয়টাকে গুরুত্ব দিলো না? কেন সুস্থ ভাবে বন্টন হলো না এই শস্য? কেন ৮ লক্ষ টনের মধ্যে মাত্র ১.০৭ লক্ষ টন খাদ্য মানুষের হাতে পৌঁছালো? দেশের প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন যে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই বিনা পয়সায় খাদ্য তুলে দেওয়া হচ্ছে, তবু কেন এই দুরবস্থা?
কারণ হিসেবে সরকারি ভাবে উঠে আসছে বিচিত্র সব অজুহাত। গোয়া এবং তেলেঙ্গানা জানিয়েছে যে পরিযায়ী শ্রমিকরা সবাই বাড়ি ফিরে গেছে তাই এই বিনা পয়সার চাল দেওয়া যায়নি তাদের কাছে। গুজরাট, ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র জানিয়েছে যে তাদের হাতে আগের যে পরিমাণ খাদ্যশস্য জমা রয়েছে সেটাই আগে বন্টন করা হচ্ছে। তারপর দেওয়া হবে কেন্দ্রের ভান্ডার থেকে পাওয়া শস্য। ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং ওড়িশা জানিয়েছে যে লকডাউনের সময় কর্মীসংখ্যা কম ছিল বলে বন্টন ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে। তাই সরবরাহ করা যায়নি। কিন্তু এখন দ্রুত বন্টন করা হবে। কিন্তু প্রকৃত কারণটা শুনলে লজ্জায় মুখ লুকোবেন কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ কর্তারা। অধিকাংশ রাজ্য প্রশাসনের দাবি, কেন্দ্রীয় ভাঁড়ারে মজুত থাকা খাদ্য শস্যের গুণমান অত্যন্ত খারাপ এবং এই দুর্দিনে তা সাধারণ মানুষের হাতে দিলে রীতিমতো বিক্ষোভ শুরু হবে। দ্বিতীয়ত, কোনো কারণে যদি বহু সংখ্যক মানুষ একসাথে কোনো একটা এলাকায় অসুস্থ হয়ে পড়েন সেক্ষেত্রে মারাত্মক বিপদে পড়বে স্থানীয় প্রশাসন। মূলত এই কারণেই কোনো রাজ্য প্রশাসনই খুব একটা আগ্রহী নন এই খাদ্য বন্টন করতে।
কেন্দ্রীয় খাদ্য দপ্তরের এক শীর্ষকর্তার মতে, প্রশাসন এই ধরণের সিদ্ধান্ত নেবার আগে যদি একবার বিভাগের শীর্ষকর্তা এবং
বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে নিতেন তবে বিষয়টা অনেক বেশি
সুস্থভাবে করা যেত। প্রথমত, খাদ্যশস্যের গুণমান একটা বড়ো বিষয়। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন রাজ্য প্রশাসনের সাথে কথা বলে তাদের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী যদি বন্টন করা হতো তবে সেটা অনেক বেশি বাস্তবসম্মত হতো। তৃতীয়ত, সামনেই বর্ষা এবং এই বছর বেশ কিছু রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতি তৈরী হবার আশংকায় রয়েছে। সেসব জায়গায় খাদ্যশস্য ঠিকঠাক ভাবে মজুত করা এবং দুর্গতদের কাছে খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়া একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে। ফলে এখনই যদি দেখা যায় যে এপ্রিল, মে, জুনের খাদ্যশস্যের ১% বন্টন করা না হয়ে থাকে, ফলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি যে আরও জটিল হয়ে উঠবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। আসলে নির্মলা সীতারামান বা প্রধানমন্ত্রী - দুজনের কেউই যে বাস্তব অবস্থা দেখে ঘোষণা করতে ভালোবাসেন না। কোন ঘোষণায় বেশি প্রচার - এটাই যে সবসময় মাথায় ঘুরে তাদের।