Written By দীপঙ্কর গুহ
মানুষ - শব্দটার অর্থ খোঁজ করছিলাম, কারণ মারাদোনা বাধ্য করলেন। পেলাম এক জায়গাতে।
জানলাম- মানুষ শব্দটির সুন্দর অর্থ করলে দাঁড়াবে, যাঁর মধ্যে অন্য সব সৃষ্টিকে ভালোবাসার উপাদান আছে এবং যাঁর মধ্যে অন্যের ভালোবাসা রাখার জায়গা আছে- সেই হচ্ছে মানুষ।
ঈশ্বর -শব্দটার অর্থ খোঁজ করছিলাম, কারণ মারাদোনা বাধ্য করলেন। তাও পেলাম এক জায়গায়। বুঝলাম-ঈশ্বর শব্দের মূল "ঈশ্" এর অর্থ - দক্ষ, মালিক,শাসক। দ্বিতীয় অংশ 'বর'। যার আভিধানিক অর্থ হল "সেরা, চমৎকার, সুন্দর, শাসক"। অতএব, ঈশ্বর শব্দের অর্থ হল; সেরা বা সুন্দরের স্রষ্টা।
দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা। জন্ম-৩০ অক্টোবর ১৯৬০। মৃত্যু- ২৫ নভেম্বর ২০২০। তাঁর জন্ম হল। মৃত্যুও হল। মানুষ মরণশীল। ঈশ্বর অবিনশ্বর। মারাদোনা "মানুষ"। আবার একাধারে "ঈশ্বর"। ৬০ বছরের জীবনপঞ্জিকা বারবার তাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে যে দেখিয়ে গেল!
মানুষ তিনি হলেন মাঠের বাইরে আর ভিতর একজন আর্জেন্টিনিয় পেশাদার ফুটবলের এক খেলোয়াড় এবং ম্যানেজার। ভক্তদের কাছে "এল পিবে দে অরো" (সোনালী বালক) ডাকনামে পরিচিত মারাদোনা তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের বেশিরভাগ সময় আর্জেন্তিনার বোকা জুনিয়র্স এবং নাপোলির হয়ে খেলেছেন। একজন এমন ফুটবলারের পছন্দের পজিশনটি ছিল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। কখনও আবার আক্রমভাগেও খেলেছেন। বহু ফুটবলাররা এবং বিশেষজ্ঞরা তাঁকে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের আসনে বসিয়েছেন। মাঠের ভিতর বল পায়ে তিনি - সেরা, সুন্দর, চমৎকার শাসক। তাই তিনি "ফুটবলের ঈশ্বর"।
মাঠের বাইরে তিনি রক্তমাংসের এক মানুষ। এই মারাদোনা খেলার জগতের অন্যতম এক বিতর্কিত রঙিন চরিত্র।
১৯৯১ সাল। ইতালিতে মাদক পরীক্ষায় কোকেইনের ব্যবহারের জন্য ধরা পড়ায় তাঁকে ১৫ মাসের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। তখন তিনি এক মানুষ।
১৯৯৪ ফিফা বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ ড্রাগ ইফিড্রিন পরীক্ষায় রেজাল্ট পজিটিভ হওয়ার জন্য তাঁকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়া হয়। সেখানেও তিনি - সেই সাধারণ এক মানুষ।
২০০৫ সালে তিনি তাঁর কোকেইন নেশা ত্যাগ করেন। তাঁর মেজাজি মানসিকতার জন্য সাংবাদিক-ক্রীড়া বিশেষজ্ঞ এবং তাঁর মধ্যে বেশ কিছু সময় মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানেও মারাদোনা- আরও একজন মানুষ মাত্র।
ঠিক মনে নেই কোথায় শুনেছিলাম। নাকি পড়েছিলাম। শুনি বা পড়ি- কথাগুলো মনে বেশ ধরেছিল। ‘জীবন হল এক খেলা। সেই খেলা উপভোগ করা ভালো। জীবন মানেই এক চ্যালেঞ্জ, তার মুখোমুখি দাঁড়ানো ভালো। জীবন একটা সুযোগ, তা হাতছাড়া না করে লুফে নেওয়াই উচিৎ। ’ এই তত্ব মেনে জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া চরিত্রের খোঁজ মেলা খুব কঠিন। বলা ভালো- তা হাতে গোনা। মারাদোনা - সেই হাতে গোনা চরিত্রগুলোর একজন।
আমজনতা মানুষ ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। সেসব মানুষের জীবনটা তাই আলাদা খাতে বয়ে যায়না। ভীড়ে হারায়। এর মধ্যে যাঁরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে জীবনকে জড়িয়ে ধরেন নিজের মতো করে - তারাই তো সেলেব। তাই তো ফুটবল মাঠের "ঈশ্বর" মারাদোনা যদি ফুটবল নাও খেলতেন আলোচনার হ্যালোজেনে ভাসতেন। তবু "মানুষ" মারাদোনা জীবনকে যেভাবে উপভোগ করেছেন, তা পেরেছেন ক'জন!
মাঠের বাইরের মারাদোনার সঙ্গে হেঁটেছে আরও অনেক নাম আর সঙ্গ। সেই তালিকায় যেমন আছেন, ফিদেল কাস্ত্রো-শাভেজ। তেমনি জড়িয়ে ছিল...ড্রাগ...নারীসঙ্গ। সেসবই কিন্তু ছিল আয়তকার জমির টাচলাইনের বাইরে। কিন্তু সেই জমির টাচলাইনের ভিতর? তিনি ফুটবল ‘ঈশ্বর’। আমার কাছে মারাদোনা এমনই এক প্যাকেজ।
১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপ। সেই " হ্যান্ড অব গড"। তা দেখে কেউ বলেন ঈশ্বরের এ কী রূপ! আমি বলি, চাঁদের কলঙ্ক আছে ঠিকই -কিন্তু তার রূপের আর আলোর বন্যা কি কম?
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মারাদোনার সেই হাত দিয়ে গোল (হ্যান্ড অব গড) হয়তো সেদিনের এক ঈশ্বরের দান, যা বিতর্ক নয়, এক কীর্তি বলে মনে করা হয়। কিন্তু তা এখন হলে? প্রযুক্তির চুলচেরা যুক্তিতে গোলটি হয়তো বাতিল হতো। মারাদোনা হয়তো "লাল কার্ড"....। নাহ্, থাক। কী হতো সে ভাবন বাদ যাক আজ। সেদিন তিনি দেশের জন্য যা করেছিলেন- সে তো দেশপ্রেম। আমি তাই বিশ্বাস করি।
নিজের ইমেজ আর জীবনকে তিনি কখনও তোয়াক্কা করেননি বলেই সেই বিতর্কিত গোলটা যেন তাঁর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি—দেশকে জেতাতে হবে- তাই সব বাধা টপকে যেভাবেই হোক গোল চাই!
এর নামই তো- আবেগ।
আর এটুকু আবেগ ছিল বলেই তো তাঁর জাদুকরি বাঁ পা- অমন করে কথা বলতো। আর সেই আবেগ আজ জাত-জাতি-ধর্ম আর পৃথিবীর সব গোলার্ধের জাল ছিঁড়ে মানুষের মন ভাসিয়ে দিয়েছে। ইতিহাস-রাজনীতি-কূটনীতি- বৈদেশিক সম্পর্কের প্রাচীরও টপকে গিয়েছিল একটি নামঃ মা-রা-দো-না।
সালটা-১৯৮২। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনার মধ্যে চলছিল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। মারাদোনা তখন এক কিংবদন্তির হয়ে ওঠার দৌড় শুরু করেছেন। সেই সময় তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন কিছু ব্রিটিশ সাংবাদিক। এর জবাবে তিনি সেইসময় বলেছিলেন, " সাক্ষাৎকার দেব- কিন্তু তোমরা ব্রিটিশরা আগে আমাদের মালভিনাস (ফকল্যান্ডের স্প্যানিশ নাম) ফেরত দাও।’
মারাদোনা নাপোলিতে খেলার সময় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন মাদক সেবনে। সেইসব খবর জেনে, মনে হতো কেন মানুষ-মারাদোনা এভাবে নিজেকে শেষ করে ফেলতে চান! বেশ মনে আছে, (প্রচার মাধ্যমের দৌলতে) তখন ভীষণ চিন্তায় পড়েছিলেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেনেম ও ক্রীড়া সচিব ভিক্টর লুপো। বুয়েনস এয়ারসে তাঁরা সংবাদমাধ্যমের কাছে করজোড়ে বলেছিলেন, ‘ আমাদের ছেলেটাকে ড্রাগ থেকে বাঁচাতেই হবে। সকলে পাশে আসুন। ’
মারাদোনার জন্য এই আবেদন সেদিনও আমার মতো অনেকে করেছিলেন। নিশ্চিত করে বলতে পারি এমনসব কথাই ছিল সকলের হৃদয়ের কথা।
পেলে আর মারাদোনাকে নিয়ে যখনই তুলনা টানা হয় তখনই পেলে এগিয়ে থাকেন-মাঠের বাইরে। "ফুটবল সম্রাট"এর ইমেজ নিয়ে। যে ইমেজে ছিল না বেহিসাবি জীবন। ছিল না বোহেমিয়ান জীবনের কোনও ছাপ। জায়েন্ট অব ব্রাজিল। সেই একগল্পো। লাতিন আমেরিকার অনাদরে থাকা পরিবারের এক মুখ। রুটি-রুজির লড়াই আর ফুটবল। ব্রাজিলের পেলের পর আর্জেন্টিনার মারাদোনা।
১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মারাদোনার দুটি গোল—প্রথমটি যদি হয় চটুল শঠতা ( আমি বলি দেশপ্রেম) , পরেরটি প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনে তাঁর " ফুটবল ঈশ্বর" ইমেজ ঠাসা । মিডফিল্ড থেকে একের পর এক বাধার পাঁচিল টপকে নিজ প্রচেষ্টায় নিজ গোল।
একটা মানুষের এমন ওঠাপড়া!
এ যেন অতিমানব থেকে অতি সাধারণ। এই চূড়ায় তো- এই অতলে চলে যাওয়া। বাইরে রূঢ় কিন্তু ভেতরে কোমল—এসব মিলিয়েই তো আমার "ফুটবল রাজপুত্র"। অভাবনীয় এই প্যাকেজ। পার্টি-ড্রাগ-বিতর্ক-বিপ্লব, আর বাঁ পায়ের জাদু।
যে নাপোলিতে তিনি বেসামাল হয়েছিলেন সেখানেই মারাদোনা ছিলেন ‘ঈশ্বর’। সেইসময় একটা কথা চালু ছিলঃ ‘নাপোলি ভক্তদের জন্য দলটা হলো ধর্ম আর মারাদোনা ঈশ্বর।’
ভালো হোন বা মন্দ - মানুষের মনে ভালোবাসার ‘ধর্ম’ হিসেবে জায়গা করে নেওয়া এই মানুষটি তাঁর জীবনকে কীভাবে উপভোগ করেছেন তা আমরা আজও দেখতে পাই একটি ইউটিউবের ভিডিও ক্লিপে। একটি প্র্যাকটিসের ক্লিপ। সম্ভবত উয়েফা কাপে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ম্যাচের আগে।
মাঠে বাজছিল ‘হিপ হপ’ মিউজিক। মারাদোনা তাঁর সতীর্থদের নিয়ে গা গরম করছিলেন একটু অন্যভাবে। বাজনার তালে তালে অনুশীলন। কখনো গা দোলাচ্ছেন কিংবা গানের তালে তালে বল নিয়ে কসরত করছেন। তিনি মারাদোনা-যা করবেন তাতেই দোলা লাগবে মানুষের মনে। তাই কোনো কিছুই তোয়াক্কা করেননি।
ঠিক এভাবেই সেদিনও পাত্তা দেননি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে গ্রিসের বিপক্ষে গোল করে সেই তাঁর বিচিত্র সেলিব্রেশনের পর ফিফার নিষেধাজ্ঞাকে। বরং মাদক নিয়ে মাঠে নিষিদ্ধ হয়েও ফিফার নানা বিতর্কিত কাজের সমালোচনা করতে তাঁর কখনো এতটুকু বাঁধেনি। অনেকটাই যেন ডিফেন্ডারদের সামনে পেলে হেলায় হারিয়ে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলার দাপুটে মানসিকতা।
বিশ্বাস করুন , আমি মেজাজে মারাদোনা হতে চাই। অনেকের জীবনটা বাস্তবে চরম হিসেবি হলেও শয়নে-স্বপনে তো কেউ কেউ অমন জীবনই চেয়ে থাকতে পারেন। যে জীবন ড্রিবল করে চলে যাওয়ার পর মানুষ কাঁদবে, ভালোবাসা আরও বাড়বে।
বুধবার রাতে খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই, গোটা বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভেসে বেড়াচ্ছে এক আবেগ। যার নামঃ মা-রা-দো-না। কিংবাঃ দি-য়ে-গো।
বাঙালির ফুটবল মনে-প্রানে প্রয়াত গায়ক মান্না দে সবসময় আলাদা জায়গা করে রেখেছেন। ফুটবলের গানে। গায়কিতে। কিন্তু ফুটবল রাজপুত্রের এমন হঠাৎ চলে যাওয়ায় অন্য একটি গানের কটি কলি মনে টোকা মারলো।
" আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে, নিশুতি রাত গুমড়ে কাঁদে--
মনের ময়ূর মরেছে আজ ময়ূর মহলেই--
দেখি মুকুটটাতো পড়ে আছে - রাজাই শুধু নেই।"
ফুটবল রয়েই যাবে, ফুটবল রাজপুত্রই শুধু নেই