Written By সম্পাদক
রাজনীতি সারা বছর চলতে থাকে, টোয়েন্টিফোর ইন্টু সেভেন। কারখানা, ক্ষেত, বাজার, বন্দর, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গান, সিনেমা, গল্প কবিতা, কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়, রাজনীতির বহির্ভূত বলে কিছুই হয় না, ধর্মও রাজনীতির আওতাতেই পড়ে। যাঁরা বলেন, আমি রাজনীতি করি না, তাঁরাও স্বজ্ঞানে বা অজ্ঞানে রাজনীতিই করেন, প্রত্যেকটা মানুষের জন্ম মৃত্যু, এমন কি মরার পরেও রাজনীতি থেকে মুক্তি নেই, লাশের রাজনীতি তো বিরাট রাজনীতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তো শুরুই হয়েছিল একটা মৃত্যু, একটা লাশকে ঘিরে। এই প্রতি মুহূর্ত চলতে থাকা রাজনীতির এক ছোট্ট অংশ হল, নির্বাচনের রাজনীতি, সংসদীয় গণতন্ত্রে যাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বিরাট, বিশাল করে দেখানো হয়, মনে হয় নির্বাচন শেষে অপেক্ষা করে আছে মোক্ষ, নির্বাণ, সুখ, অপার শান্তি। এক নির্বাচন চলে যাবার পরেই জানা যায়, শ্রমিক কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ, আম আদমি যে কুলে ছিল, সেই কুলেই আছে। কিন্তু নির্বাচন এসে রাজনীতি আর রাজনৈতিক নেতাদের চিনিয়ে দেয়, তাঁদের আদর্শহীনতা, তাঁদের দুর্নীতী, তাঁদের দিশাহীনতা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে পড়ে। আসুন আজ সেটা নিয়েই চতুর্থ স্তম্ভে আলোচনা করা যাক, কারণ নির্বাচনের ঢাক বাজতে শুরু করেছে এ বাংলায়, নেতাদের গতিবিধি বাড়ছে। স্বাধীনতা এসেছে আমাদের রাজ্যের বিভাজনের মধ্য দিয়ে, আমাদের জমি ভাগ হয়েছে, নদী ভাগ হয়েছে কেবল নয়, আমাদের বিরাট জুট শিল্পকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়ে, কারখানা সব এই বাংলায়, আর পাট চাষ ওই বাংলায়। বিভাজনের প্রথম দিন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের বাংলা, তার ওপরে উদ্বাস্তুদের আসা, তারা তো আমাদেরই আত্মীয়, স্বজন। লক্ষ লক্ষ মানুষ এসেছেন এক বস্ত্রে। জমির লড়াই, উদ্বাস্তুদের লড়াই, শিক্ষিত বেকারদের লড়াই সেই তখন থেকেই বামপন্থার হাত ধরে, না নির্বাচন নয়, সে লড়াই ছিল প্রতিদিন বেঁচে থাকার লড়াই, টিঁকে থাকার লড়াই। কমিউনিস্ট পার্টি কেবল তাঁদের মঞ্চে এনে হাজির করতে পেরেছিল, তাঁদের দৈনন্দিন সুখ দুঃখের ভাগীদার হতে পেরেছিল এবং সংখ্যালঘু মানুষ জন, যাদের বিরাট অংশ ছোট কৃষক বা ক্ষেত মজুর তাঁরাও ভরসা পেয়েছিল কমিউনিস্ট নেতাদের কাছ থেকে, তাদের সম্মিলিত শক্তিই ছিল বাম দলের অগ্রগতির কারণ। তখন প্রতিটা নির্বাচন কেবল নির্বাচন ছিল না, তা এক রাজনৈতিক আন্দোলন হয়ে উঠতে পেরেছিল, কারণ কেবল পাইয়ে দেবার, মাছ কাটলে মুড়ো দেবো, গাই বিয়োলে দুধ দেবোর রাজনীতি নয়, সে রাজনীতি ছিল সম্মানজনক শর্তে বাঁচার রাজনীতি, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। কংগ্রেসের রাজনীতি ছিল, গ্রাম, মফস্বলে ধনী কৃষক, জোতদারদের রাজনীতি, তাঁদের স্বার্থের রাজনীতি, শহরে বড় শিল্পপতিদের রাজনীতি। পরিস্কার বিভাজন, বড়লোক কৃষক, শিল্পপতি, উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষ জন ছিলেন কংগ্রেসের পক্ষে, শিল্প শ্রমিক, কৃষক বা কৃষি মজুর ছিল বাম দল গুলোর সঙ্গে। এ লড়াই অন্য চেহারা নিতে থাকে মধ্য ৬০ থেকে, কমিউনিস্টরা ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে ক্ষমতায়, উত্তাল গণ আন্দোলনের শেষে একদল কমিউনিস্ট বিপ্লবীর ছিটকে যাবার পরেও, মূল স্রোতের বামেরা ৭৭ এ এককভাবেই ক্ষমতায়। এরপর অপারেশন বর্গা, তারপর? ভুল, বিলকুল ভুল হয়ে গেল সবকিছুই। সরকারকে যে কোনও মূল্যে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে, সরকারে যাবার মূল কারণগুলো হারিয়ে গেলো, উবে গেলো। সাতটা বাম সরকার তৈরি হল পশ্চিমবঙ্গে, সাত সাতটা। তারা কী করলো? রাস্তা, শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্য, গণবন্টন ব্যবস্থা? হ্যাঁ সবই খানিকটা খানিকটা হল, কোনওটা কম কোনওটা বেশি। তা অন্যান্য রাজ্যে কী হল? সেখানেও খানিক শিল্প হল, কৃষি হল, শিক্ষা স্বাস্থ্য, গণ বন্টন, সবই হল। সে সব রাজ্যে কমিউনিস্টরা নেই, তাও হল। আসলে এগুলো করার জন্য কমিউনিস্ট হতে হয় না, দিল্লির সরকারও অনেক কাজ করেছে, মহারাষ্ট্রে অনেক শিল্প হয়েছে, মণিপুর বা নাগাল্যান্ডে শিক্ষিতের হার অনেক বেশী, এসবের জন্য কমিউনিস্ট হতে হয় না, কমিউনিস্টদের আরও কিছু কাজ ছিল, তাদের এক বিকল্প রাজনীতি তুলে ধরার কথা ছিল, যে রাজনীতি সারা দেশে এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে, এবং তারপর সারা দেশের মানুষ সেই কমিউনিস্টদের সরকার চাইবে। তা তো হলই না, উলটে বিহার, অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব এমন কি উত্তর প্রদেশে যে কমিউনিস্ট দলের সংগঠন ছিল, তাও শেষ হয়ে গেলো। সাত সাতটা বাম সরকার হল এই বাংলায়, প্রথমটা বাদ দিলে নির্বাচনের শ্লোগান কী? লড়াইটা কোথায়? কার সঙ্গে? কিছুদিন পর থেকে মনে হল বামফ্রন্টের লক্ষ উন্নয়ন এবং উন্নয়ন, আর কিচ্ছুটি নয়। আর এই কাঠামোতে উন্নয়ন আরও উন্নয়নের চাহিদার জন্ম দেয় মাত্র, কিছুদিন পরে সেই চাহিদার চাপ মেটাতে আরও দ্রুত উন্নয়ন, কৃষকের জমি কেড়ে নিয়েও উন্নয়ন। অতএব অনেকদিন পরে জমির লড়াই, জমি কেড়ে নেবার বিরুদ্ধে লড়াই, লড়ছে কে? তৃণমূল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এক্কেবারে ১০০% রাজনৈতিক প্রশ্নে নির্বাচন, ভোটের চরিত্রও পালটে গেলো, সেই সংখ্যালঘু, যারা এখনও মূলত বাংলার প্রান্তিক চাষি, মজুর তাঁরা এবার কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে, সাধারণ হিন্দু ছোট চাষি, আদিবাসীদের বড় অংশ, গরীব বস্তিবাসি, শ্রমিক এবার কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে, সরকারে এলে তৃণমূল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর্থন ভূমি? সংখ্যালঘুদের অপার ভরসা, আদিবাসী মানুষদের সমর্থন, জমির প্রশ্নে, বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে, সাধারণ নিম্নবিত্ত, গ্রামের গরীব মানুষ জন, শহর, মফস্বলের শ্রমিক, মধ্যবিত্ত মানুষজনের এক বড় অংশ, যারা ডাইরেক্ট ট্রান্সফারের সুবিধেভোগী, টাকা, সাইকেল, রেশন, বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধে। হিসেব বলছে মমতা সরকার কমবেশি ৭৮% মানুষকে সরাসরি কিছু দিয়েছে। এদেরই এক বড় অংশ, আজকে মমতার সমর্থন ভূমি। অন্যদিকে অবাঙালি হিন্দু, বাঙালি উচ্চবিত্তের বিরাট অংশ, মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালি, বিশেষ করে যারা বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসেছেন, তাঁদের একটা অংশ আপাতত বিজেপির সমর্থনে আছেন, এরসঙ্গে আছে আদিবাসিদের এক অংশ, সবমিলিয়ে ভোটারদের সেই অংশের অনেকটা, যারা এক সময়ে বামেদের সমর্থন করতো। ওদিকে কংগ্রেস তার পকেটের বাইরে কোথাও নেই, মুর্শিদাবাদ, মালদা আর রায়গঞ্জ জেলার মধ্যবিত্ত, সংখ্যালঘু মানুষ, বাঙালি উচ্চবিত্তের একটা অংশ, এছাড়া কংগ্রেস নেই, হতেই পারে তাদের সংসদের সংখ্যা সিপিএম এর থেকে বেশি, এমনও হতে পারে যে বিধানসভাতেও তাদের বিধায়ক দু একটা বেশিই জিতে আসলো, কিন্তু জনাধার, মানুষের সমর্থন বলতে যা বোঝায়, তা ওই পকেটের বাইরে কোথাও নেই, যা আছে সেটাও তৃণমূলেই চলে যাচ্ছে বা বিজেপি তে। বামেদের সমর্থন এই মুহূর্তে তাদের পুরনো কিছু সমর্থক, আর বিভিন্ন কারখানায় দফতরে শ্রমিক কর্মচারীদের এক অংশ। তাঁদের আগের বিরাট সমর্থনভূমী কবেই বিলুপ্ত, সাংগঠনিক ক্ষমতায় যেটুকু সঙ্গে রাখা গেছে, তার বাইরে কিছুই নেই। ঠিক এরকম একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচন আসছে, যেখানে পরিস্কার তিনটে শিবির, তৃণমূল, বিজেপি আর বাম কংগ্রেস। এর বাইরে ভোট কাটুয়া হতে পারে, ধর্ম বা জাতের নামে কিন্তু মূল শিবির তিনটে। বাকি ছোটখাটো রাজনৈতিক শক্তি এই তিনটে শিবিরের একজনের সঙ্গে থাকতে বাধ্য, না থাকলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। ধরা যাক পাহাড়ের কথা, এই মুহূর্তে সেখানে বিমল গুরুং তৃণমূল ঐক্য সম্ভব, সে ঐক্য না হলে গুরুংও জানেন অসুবিধে আছে, বিনয় তামাংয়েরও তাই। এবার আদর্শগত, যার যা অবস্থান তার জরিপ করা যাক। বাম কংগ্রেস এখনও পর্যন্ত চূড়ান্তভাবেই তৃণমূল, বিজেপি বিরোধী। বাংলার মাটিতে নেমে দেখলে তৃণমূল বিরোধিতাই চোখে পড়বে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপির বিরুদ্ধে। মানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে এক রাজনৈতিক অবস্থান, সারা দেশ জুড়ে, কিন্তু এ রাজ্যে তৃণমূলও তাদের সমান শত্রু, রাজ্য কংগ্রেসের এসব নিয়ে কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই, কারণ নির্বাচনের পরে হাই কমান্ড যদি তাঁদের তৃণমূলকে সমর্থন করতে বলে, তাহলে পরদিন সকালেই অন্য বিবৃতি দিয়ে তাঁরা কালিঘাটে যেতেই পারেন, সিপিএমের কাছে সেটা সমস্যার। তাহলে সিপিএম বা কংগ্রেস থেকে যারা বিজেপিতে যাচ্ছেন, তাঁরা বিজেপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা দেখেই যাচ্ছেন, কোনও আদর্শ ইত্যাদির ব্যাপার নয়। রিঙ্কু নস্কর ইত্যাদিরা আদর্শ নয়, শত্রু চিহ্নিত করেছেন তৃণমূলকে, তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিজেপিতে যাচ্ছেন, এর বাইরে কিছু নয়। যারা বাম কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যাচ্ছেন, তাঁরাও শিবির বদল করছেন ক্ষমতার জন্যেই। বিজেপি থেকে আপাতত অন্য দলে যাবার ঢেউ নেই, জেতা দলে লোকজন আসে, দল থেকে চলে যায় না। রইল তৃণমূল। তৃণমূলের যাঁরা বিজেপিতে যাচ্ছেন, বা যাবার জন্য পা বাড়াচ্ছেন, তারাও ১০০% ক্ষমতার জন্যেই যাবেন, অন্য কোনও কারণে নয়। তৃণমূলে অনেক বড় বড় নেতা আছেন, কিন্তু প্রত্যেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোয় আলোকিত, যত বড়ই নেতা হন না কেন, নিজের দায়িত্বে ১০ জন বিধায়ক বের করে আনবেন, এমন নেতা একজনও নেই। কাজেই ওসব আদর্শ ইত্যাদি ছেঁদো কথা, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার লড়াইয়ে ঝুঁকি নিচ্ছেন মাত্র। তিন শিবিরের নেতাদের যে যেদিকেই যাক, সমর্থন ভূমির খুব একটা হেরফের হবে না, দু তিনটে আসনে হেরফের হতে পারে, তার চেয়ে বেশি কিছু হবে না তার কারণ সমর্থনের জায়গাটা তৈরি হয়ে গেছে, সমর্থনের কারণগুলোও তৈরি হয়েই আছে, এখন শুধু সমর্থনকে ইভিএমে এনে ফেলা। ধরা যাক মুকুল রায় তৃণমূলে এলেন, কী হবে? প্রায় কোনো প্রভাবই পড়বে না, রাহুল সিনহা এলেও না, কংগ্রেসের দু’জন বিধায়ক বিজেপিতে চলে গেলেন, কী প্রভাব পড়বে? প্রায় কিছুই নয়। তৃণমূলেরও যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁদের দু এক জনও যদি বিজেপিতে যান, মাটিতে তার প্রভাব কিছুই পড়বে না। তার সবচেয়ে বড় কারণ এবারের নির্বাচন দীর্ঘ দিনের মেরুকরণের ফল, দোদুল্যমান ভোটারের সংখ্যা ভীষণ কম, বামেদের ভিত্তিভূমির খানিকটা পুনরুদ্ধার তৃণমূলের জয়কে ল্যান্ডস্লাইডে পরিণত করতে পারে মাত্র, এর বাইরে খুব একটা বিরাট পরিবর্তন অপেক্ষা করে নেই।