Written By দীপঙ্কর গুহ
জমে গেছে, গুরু - বাজার জমে গেছে। একটা আলোচনা বাজার জমিয়ে দিয়েছে। ‘সৌরভ কি ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে লড়ছেন?’ সকলে এই আলোচনায় উত্তর খুঁজছেন। কেউ কেউ সম্ভাবনা পক্ষে বলছেন, কেউ বা বিপক্ষে।
প্রায় ৩০ বছর সৌরভকে কাছ থেকে বা দূর থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় যা মনে হচ্ছে -সেটা প্রথমে লিখি। সৌরভ ‘লড়াই’ ভালোবাসেন। লড়াই করে ‘জিততে’ আরও বেশি ভালোবাসেন। সেসবই ক্রিকেট মাঠে। কিন্তু ‘লড়াই’ করে রাজনীতির কুশি-লবদের মাঝে ‘জিততে’ নামবেন না। হ্যাঁ-এটাই আমার বিশ্বাস।
তাহলে পশ্চিমবঙ্গের ‘মুখ্যমন্ত্রী’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে স্বপ্ন আমরা দেখবো না? ২০২১ এর জন্য উত্তরঃ – ‘না’। সৌরভ? আপনিও নিশ্চিতরূপে এ স্বপ্ন দেখছেন না। আপনার দিদিকে সরাতে নিশ্চয় মঞ্চে উঠবেন না।
তাহলে সৌরভকে জড়িয়ে হচ্ছেটা কী! মাসটা ডিসেম্বর। শীত পড়ছে। গা-গরম চলছে। নির্বাচনের বাকি আর মাস পাঁচ। এখনও মমতার বিকল্প নাম বিজেপি ভাসাতে পারেনি বিজেপি। সৌরভ কি তৃণমূলের রাজনীতি না করেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন? সৌরভের ডাকনামটা মনে আছে তো? ম-হা-রা-জ। ভারতীয়দের মধ্যে কপালওয়ালা সেলেবদের মধ্যে তিনি প্রথম তিনেই থাকবেন। তাই তো তিনি থমকে দাঁড়ান, আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছুটতে শুরু করেন। হোঁচোট খেয়ে পড়ে যান না। তাঁর ম্যান ম্যানেজমেন্ট স্কিল শুরু থেকেই ভালো। তাই দেশের সফলতম অধিনায়কের তালিকাতেও টপ থ্রিতে রয়ে যাবেন।
পরিসংখ্যান ঘাঁটুন। টিনএজার হয়ে জাতীয় দলে প্রথমবার সুযোগ পাওয়া আর ছিটকে পড়ার পর চার বছর বাদে ফিরে এসেই পর-পর দুটি টেস্টে সেঞ্চুরি - কোনও ভারতীয় ক্রিকেটারের নেই। তারপরের চার বছরের মধ্যেই দেশের নেতা হওয়ার দাবিদার। আবার অধিনায়ক থেকেই পুরো দল থেকে ছিটকে যাওয়া। আবার লড়াই। আবার জাতীয় দলে কামব্যাক। তারপর ছন্দ থাকলেও জাতীয় দলের জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া। কোনও পদে বসে প্রস্তুতি পর্ব না নিয়েই সি এবি'র সচিব পদে বসা। তারপর সভাপতি। তারপর? বিসিসিআই সভাপতি!
জীবনের গ্রাফটা দেখুন। ‘কপাল করিশ্মা’ তাক করার মতো।
অভিজ্ঞ রাজনৈতিক কর্তা তৃণমূলের সৌগত রায়- সৌরভের রাজনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছেন। মনে দিয়ে দু-তিনবার শুনলাম যা-যা বলেছেন। আর যা-যা বলেছেন সেগুলির ক'টি ঠিক, আর ক’টি বেঠিক? আসুন মত আদান প্রদান করি।
সৌগত: সৌরভ বড়লোকের ছেলে।
সৌগত: সৌরভ ক’জন গরীব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন?
সৌগত: ক’টা মিছিলে হেঁটেছেন?
সৌগত: এখন যা করছেন - ক্রীড়া প্রশাসনের ভূমিকা পালন। বাস্তব আর অবাস্তব ভাবনা কী বলে?
*হ্যাঁ, সৌরভ বড়লোকের ছেলে। তা হলে রাহুল গান্ধী কী? জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া? ইমরান খান? কেউ গরীব বলে তো জানা যাচ্ছে না।
* সৌরভ ক’জন গরীবের পাশে দাঁড়িয়েছেন-এর জুতসই উত্তর নেই সৌরভ শিবিরের। সচিন তেন্ডুলকরের মতো একটি এনজিও’র শ'খানেক কচিদের দায়িত্ব নিয়েছেন সৌরভ- এমন খবরও নেই। ময়দানে হাতে গোনা সৌরভ ঘনিষ্ঠরা হয়তো বলবেন, ওঁর থেকে ব্যাট - গ্লাভস - টি সার্ট পেয়েছেন। প্রয়াত ময়দানে পরিচিত ‘মাগুর’ এর পরিবার উল্টো কিছু বলেছিলেন একসময় এই প্রতিবেদককে। সাংসদ হয়ে শচিন কেরলের একটি গ্রামের যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সৌরভ এখনও সাংসদ হননি। বাম জমানায়, তখনকার পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের ডাকে ব্ল্যাড ক্যান্সারে আক্রান্ত এক শিশুর জন্য নিজের খেলার সাজ-সরঞ্জাম নিলামে চড়িয়েছিলেন তিনি। চিকিৎসার জন্য অর্থ তুলে দিয়েছিলেন বিদুরীনের পরিবারের হাতে। নিন্দুকরা বলে, মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য ঘনিষ্ঠতার জন্য সেদিন তিনি এমন মঞ্চে হাজির ছিলেন।
* রাজনৈতিক মিছিলে সৌরভ সত্যিই হাঁটেননি। রাজনীতিতে আসার আগে ক’জন সেলেব হেঁটেছিলেন? জয়ললিতা? সন্ধ্যা রায়-দেব? শতাব্দী-প্রয়াত তাপস পাল? লকেট-রূপারা? আসলে সৌরভ আলাদা করে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, বাম মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য, আরেক বাম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাদা করে একাধিকবার দেখা করছেন। ব্যক্তিগত কারণটা সেখানে বেশি। পালা বদলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর ‘দিদি’ বলেই পান সৌরভ। জগমোহন ডালমিয়া প্রয়াত হলে, তাঁর ‘দিদি’ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সৌরভকে সিএবি’র সর্বোচ্চ আসনে বাসান। দিদির ডাকে বেশ কিছু অনুষ্ঠানে দেখা মেলে সৌরভকে। যেমন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। নানান সংবর্ধনা মঞ্চে।
বাম শিবির একসময় সৌরভকে রাজনীতিতে চেয়েছিল। সৌরভের বাবা (দক্ষ ক্রীড়া প্রশাসক) তখন বেঁচে। সৌরভকে এগিয়ে দেননি। ঠিকই করেছিলেন। একটা প্রোডাক্টের প্রচার ট্যাগ লাইন ছিল... ‘এ স্বাদের ভাগ হয়না।’ সৌরভও হয়তো এই ট্যাগ লাইনে বিশ্বাসী। ‘সৌরভের ভাগ হয় না।’ রাজনীতিতে এলে সৌরভের ভাগ হয়ে যাওয়া নিশ্চিত। তাই বামে ‘না’ ছিল। তৃণমূল তাঁকে দলে চায়নি, অন্য দলেও দেখতে চায় না। কংগ্রেস রাজ্যসভায় চেয়েছিল। ‘কমলা ব্রিগেড’ এর জাল কেটে সৌরভ নিজেকে মুক্ত করেন কিনা-এটাই দেখার।
করোনার কলকাতা কম্পনের শুরুতে সৌরভ এদিক ওদিক নানান সাহায্য নিয়ে পৌঁছচ্ছিলেন। দু-তিন দিন এই কাজ চলে। কিন্তু তাঁর বাড়ির নিজের লোকেদের আপত্তিতে গৃহবন্দি হন। লকডাউনের ঠিক আগে সৌরভের বিসিসিআই আসনে বসে কলকাতায় দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ভারতের ওয়ান ডে ম্যাচ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ময়দানের ক্লাব কর্তাদের নিয়ে আলোচনায় বসে সেদিন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সৌরভের এমন সিদ্ধান্তের জন্য অসন্তোষ চেপে রাখেননি। সকলের সামনে মমতা ‘দিদি’ বলে দেন, সৌরভ এটা ঠিক করেননি। কলকাতা পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা না বলে যেটা করেছেন-ঠিক করেননি। টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার চলছিল। সৌরভ টের পান মাননীয়া দিদির অসন্তোষ। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ইডেনে ম্যাচ বাতিল করেন । তারপর বাতিলই হয়ে যায় গোটা সিরিজই।
সেই সময় থেকে সৌরভ - মমতার মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। মান-অভিমানের দূরত্ব। মমতা ‘দিদি’। ভাইয়ের খোঁজ নেওয়া ছাড়েননি। আমফান আর করোনা মোকাবিলা করতে ব্যস্ত ছিলেন মমতা। কিন্তু আনলক পিরিয়ড শুরু হতেই ফোনে ভাই সৌরভকে নিয়মিত সাবধান করতেন। বলতেন, অহেতুক না বেরুতে। সৌরভ দিদির কথা শুনেছিলেন।
আবার লকটাউনে সরকারের থেকে পাওয়া জমি সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে কথা বলতে সৌরভ তাঁর মা’কে নিয়ে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও আসেন। এটা ২-৩ নম্বর আনলক পিরিয়ডের সময় হবে হয়তো। অর্থাৎ সৌরভ রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে বাড়তি সম্মান দেন। গুরুত্বও দেন।
তাই মমতা বনাম সৌরভ - এমন ডুয়েলে সামিলই হবেন না মহারাজ। শিলিগুড়ির মেয়র, রাজ্যের প্রাক্তন বামফ্রন্ট মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। সৌরভের যদি কোনও রাজনৈতিক পরামর্শদাতা থেকে থাকেন, অশোকবাবুর নাম সকলের ওপরে থাকবে। আমার এই দুই ব্যক্তিত্বকেই চেনা। অশোকবাবু বামফ্রন্টে সৌরভকে নিতে পারেননি- বেহালার ছেলেটির মনের কথা বুঝে। কংগ্রেস দরবার করে - দরজা খোলেনি। আর তৃণমূল? শোনা যায়, সৌরভের পরমর্শে নাকি জগমোহন ডালমিয়ার কন্যা বৈশালী তৃণমূলের টিকিট পান। এরপর জেতেন বৈশালী। তিনিই একমাত্র তৃণমূল প্রার্থী যিনি নিজের এলাকায় ভোটের আগে সৌরভকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ ‘দিদি’ সৌরভের কথা সেদিন ফেলেননি। আর সৌরভ কিনা মমতার বিপক্ষে লড়বেন!
সৌরভ খুবই বুদ্ধিমান। জানেন কখন কোথায় কী করতে হবে। যেমন শেষবার জগমোহন ডালমিয়া যখন বিসিসিআইয়ের সভাপতি হন, বিপক্ষ শিবিরের সচিব অনুরাগ ঠাকুরকে জেতাতে বাম রাজ্যের ভোট হাইজ্যাক করেছিলেন। অনুরাগ তখন সর্বভারতীয় বিজেপি যুব সংগঠনের সভাপতি। এক বিজেপি কর্তাকে জেতাতে সৌরভ লড়াইয়ে নেমেছিলেন- এটা নিন্দুকরা এটা বলে। কিন্তু অনুরাগ দেশের ক্রিকেট দুনিয়ায় এক উজ্জ্বল নাম। এরপর সৌরভ বিসিসিআইয়ের সভাপতি হন। সেখানেও নাটকীয় পট পরিবর্তন ঘটে। সেই নাটকে অনুরাগ সমেত বিজেপি শাসিত উত্তর-পূর্ব ভারতের হেভিওয়েট এক কর্তা মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। কোনও নির্বাচনী লড়াই ছাড়াই গদি পান। সভাপতি হয়ে পাশে পান দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি’র আরেক স্তম্ভ অমিত শাহের ছেলে জয়কে। দু’জনের ঘনিষ্ঠতা বেড়েই চলেছে। কিন্তু সৌরভকে এখনও জয় বা অনুরাগ কিংবা সেই উত্তর-পূর্ব ভারতের বিজেপি শাসিত রাজ্যটির মন্ত্রীও কমলা শিবিরে নিয়ে যেতে পারেননি। পারবেন? সৌরভ যাবেন? যদি সৌরভকে ঠিকঠাক চিনে থাকি, উত্তর: না।
তাহলে সৌরভকে এই বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকায় দেখা যাবে না? সম্ভাবনা নেই, এটা বলছি না। আছে, কিন্তু নির্বাচন জিততে সকলের সঙ্গে খোলা ময়দানে লড়াইয়ে নামবেন না। হাওয়া বদলে গেছে দেখলে, তখন যেখান থেকে হোক জিতে যোগ দিতেই পারেন ক্ষমতায় আসা নতুন মন্ত্রীসভায়। তখন বিসিসিআইয়ের পদ ছাড়তে হবে। ক্রিকেট ঘিরে বাকি সব স্বপ্ন অধরা থাকবে। ক্রিকেটার -অধিনায়ক হয়ে বিশ্বকাপ জেতেননি সৌরভ। ভারতীয় দলের কোচ হয়ে এই খেতাব জয়ের সুযোগ এখনও আছে।
আমার বিশ্বাস ক্ষমতা বৃত্তে থাকা মহারাজ কারোর রংয়ে নিজেকে রাঙানোর রাস্তায় হাঁটবেন না। বরঞ্চ এই ভালো। সকলের ‘দাদা’। সৌরভের ভাগ নাই বা হল ভক্তদের মধ্যে।