Written By সম্পাদক
“টেকনোলজি কে মাধ্যম সে ভি, কালচার, এক ইমোশনাল রিচার্জ কি তরহ, কাম করতা হ্যায়” মানে কী? মানে টেকনোলজি দিয়ে সংস্কৃতিকে মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে, বলছেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী। তিনি এই বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র প্রধান, যিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে ভয় পান। খুব দরকারে তাঁর কৃপাধন্য কয়েকজনের মধ্যে থেকে একজনকে ডাকেন, যা বলার বলেন, তারা, আপনি এই ১৮ ঘন্টা, ২০ ঘন্টা কাজ করার এনার্জি কোথা থেকে পান? মার্কা প্রশ্ন করেন, আপনার ওই প্রজেক্টে মানুষের খুব উন্নতি হয়েছে, সেটা নিয়ে যদি কিছু বলেন মার্কা প্রশ্ন করেন, উনি স্মিত হাসি ঠোঁটের ডগায় ঝুলিয়ে রেখে, উত্তর দেন, আম চুষে খান? না কি কেটে খান মার্কা প্রশ্ন করার জন্য তো অক্ষয় কুমার আছেন, নরেন্দ্র মোদীর যা বলার তা তিনি বলেন, সবটাই ওয়ান ওয়ে কমিউনিকেশন, তিনি বলবেন, না, কোনও প্রশ্ন নয়। উট কাঁটা বেছে খায় কি না, সে প্রশ্নও করা যাবে না। তিনি মাঝে মধ্যে মন কি বাত করেন, সেই ওয়ান ওয়ে কমিউনিকেশন, তিনি বলবেন, আপনাকে শুনে যেতে হবে, যে কোনও স্বৈরতান্ত্রীক শাসকের মতন, তিনি প্রশ্নকে ভয় করেন। মনে আছে তো? ওরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত বেশি প্রশ্ন করে।
তো সেই নরেন্দ্র মোদী, তাঁর এবারের মন কি বাত এ বললেন, টেকনোলজি দিয়ে সংস্কৃতিকে মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে, কোন সংস্কৃতি? ব্রাজিলের জনাস চ্যাসিটি, ইদানিং তাঁর নাম বিশ্বনাথ। তিনি ৪ বছর দক্ষিণ ভারতে বেদ বেদান্ত পড়ে, আপাতত ব্রাজিলে বেদান্ত পাঠের আসর খুলেছেন। করোনার সময় এই বেদান্ত নাকি দারুণ সাহায্য করেছে, আপনার প্রশ্ন থাকতেই পারে, ক্যামনে? বোঝান, করোনা সারাতে বেদান্ত? উত্তর পাবেন না, কারণ তিনি শুধু বলেন। উত্তর দেন না, তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না। এর পরে তিনি আর এক জনের নাম নিয়েছেন, ডঃ গৌরব শর্মা, তিনি নিউ জিল্যান্ডে সদ্য নির্বাচিত সাংসদ, তিনি নাকি সংস্কৃত ভাষায় শপথ নিয়েছেন, তার জন্য মন কি বাত এ তিনি ডঃ শর্মাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। মোদীজির দলের নেতারা উর্দুকে মুসলমানদের ভাষা মনে করেন, মোদীজি সংস্কৃতকে হিন্দুদের ভাষা মনে করেন। তাই উনি সংস্কৃততে শপথ নিয়েছেন শুনেই উল্লসিত, খবর নিলে জানতে পারতেন যে ডঃ গৌরব শর্মা প্রথমে নিউ জিল্যান্ডের আদিবাসীদের ভাষা মাওরিতে শপথ নিয়েছেন, তারপর সংস্কৃততে শপথ নিয়েছেন, দুটো প্রাচীন ভাষার প্রতি সম্মান জানাতে তিনি এই কাজ করেছেন, তিনি নিউ জিল্যান্ড লেবার পার্টির নেতা, যে দল গণতান্ত্রিক সমাজবাদে বিশ্বাস করে, যে দলের নেতারা অস্ট্রেলিয়াতে আদানি পাওয়ারসের বিরোধিতা করেছে, যে দলের প্রধানমন্ত্রী মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর গুলিচালনা আর নিহতের খবর পেয়েই ছুটে গেছেন সেখানে, জড়িয়ে ধরেছেন, তাঁদের আত্মীয় স্বজনদের, ওই ঘটনার পরে নিউ জিল্যান্ডের অস্ত্র আইনের খোল নলচে বদলে দেওয়া হয়, নিউ জিল্যান্ড লেবার পার্টি আক্ষরিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাদের অন্যতম নীতি হিসেবে মেনে চলে, এগুলো মোদীজি জানেন? মোদীজি জানেন নিউ জিল্যান্ডের লেবার পার্টি, যে দলের নেতা ওই ডঃ গৌরব শর্মা, সেই দলের সংবিধানে কী লেখা আছে? According to its constitution, the party accepts democratic socialist principles, including
The management of New Zealand's natural resources for the benefit of all, including future generations.
Equal access to all social, economic, cultural, political, and legal spheres, regardless of wealth or social position.
Co-operation as the main governing factor in economic relations, to ensure a just distribution of wealth.
Universal rights to dignity, self-respect, and the opportunity to work.
The right to wealth and property, subject to the provisos of regarding people as always more important than property and the obligations of the state to ensure a just distribution of wealth.
The promotion of peace and social justice throughout the world by international co-operation.
Equality in human rights regardless of race, sex, marital status, sexual orientation, gender identity, age, religious faith, political belief or disability. এগুলোর কথাও বলুন, কেবল সংস্কৃতের কথা বলে গেলেই হবে। সংস্কৃত এক প্রাচীন ভাষা, গবেষণা আর বিশেষ শিক্ষার জন্য, ব্যবহারিক কাজের জন্য নয়, যদি হতো তাহলে আপনিই সংস্কৃততে কথা বলতেন।
এরপরেও তিনি মন কি বাত এ গুরু পূর্ণীমার কথা বললেন, গুরু নানক, গুরু গোবিন্দ সিংয়ের কথা বললেন, তিনি কবে লখপতের গুরুদ্বারা রিনোভেশনের কথা বললেন, গুরু নানক লঙ্গর চালু করেছিলেন, তার কথা বললেন। গুরু নানক কিভাবে তাঁর জীবনের প্রেরণা তাও বললেন। বললেন না, দিল্লির উপকণ্ঠে লক্ষ শিখ ঠান্ডায় রাস্তায় আছে, তাঁদেরও আজ গুরু পূর্ণীমা, তাঁদের কথা মুখেও আনলেন না। অথচ সেই পঞ্জাব দ্য পুত্তরেরা সেদিনেও লঙ্গর চালিয়েছে, খাইয়েছে পুলিশ, প্যারা মিলিটারিকে যারা সেদিন ওঁদেরই আটকাতে ব্যারিকেড তৈরি করেছিলেন। গুরু পূর্ণিমা শিখদের অন্যতম ধার্মিক উৎসব, তাঁরা জলকামানের জলে ভিজে, টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় মুখ ঢেকে, এই প্রচণ্ড শীতে রাস্তায়। দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন কী বাত এ তাদের জন্য একটা শব্দও বললেন না। এতটা অসংবেদনশীল, উদ্ধত সরকার এর আগে ভারতবাসী দেখেনি।
এদিকে দেশের তিনটে বৃদ্ধির দিকে মানুষের নজর আছে, প্রথমটা হল মূল্যবৃদ্ধি, সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে অচ্ছে দিন কাকে বলে বুঝতে পারছেন। দ্বিতীয় বৃদ্ধি হল, আম্বানি, আদানি, টাটা বিড়লা ইত্যাদিদের সম্পদ। দেশের জিডিপি কমলেও ওনাদের সম্পদ বেড়েই চলেছে। আর তৃতীয় যা বাড়ছে, তা হল প্রধানমন্ত্রীর দাড়ি। তাঁর চেহারায় জৌলুশ মুখ্যমন্ত্রী হবার পরেই এসেছিল, এখন তাঁর পরিচিত দাড়ি বেড়েই চলেছে। অনেকে বলছেন বাংলার নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে নাকি তাঁর দাড়ি বাড়ানো হচ্ছে, হতে পারে। বাংলায় বহু মনীষীর দাড়ি ছিল, কিন্তু তাদের জীবনদর্শন মোদীজির সঙ্গে তো মিলবে না। ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মোদীজি মাঝে মধ্যে ওনারও দু তিনটে কবিতা আওড়েছেন, মানে বুঝেছেন বলে তো মনে হয়নি। সাম্প্রদায়িকতার তীব্র বিরোধী আমাদের ঠাকুরের সে সব কথা ওনার ভালো লাগার কথাও নয়। ভাল লাগবেই না তাঁর জাতীয়তাবোধ নিয়ে কথাবার্তা, সে বিশ্ব মানবের একমাত্র দাড়িই যদি তুলনীয় হয় তাহলে তাকে রামছাগলের সঙ্গেই তুলনা করা ভালো। আশা করবো প্রধানমন্ত্রী দাড়ি বাড়িয়ে রবি ঠাকুর হবার চেষ্টা করছেন না। এরপর দাড়ি যাদের ছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রী অরবিন্দ, এ বাংলায় মানুষ অরবিন্দ বলতে এক বিপ্লবীর কথাই মনে রেখেছে, বাংলার বিপ্লবীদের প্রথম গুরু হিসেবেই তিনি চিহ্নিত, জেল খেটেছেন ইংরেজদের তাড়ানোর জন্য, শেষ দিন পর্যন্ত ইংরেজরা কড়া নজরে রেখেছিল শ্রী অরবিন্দকে। তিনি মুচলেকা দেননি, সাভারকারের মত, তিনি ইংরেজদের হয়ে ওকালতি করতে নামেননি। অরবিন্দের সে ইতিহাস আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জানা আছে? একটা ১৫ মিনিটের বক্তৃতায় প্রথমে বেদান্ত, তারপরে সংস্কৃত, তারপরে গুরু নানক, তারপরে অরবিন্দ এবং সবটাই হিন্দু ধর্মকে সামনে রেখে। কোভিডের ভ্যাক্সিন নিয়ে মানুষ জানতে চাইছে, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মানুষ, বিপর্যস্ত, কৃষি বিল নিয়ে কৃষকরা রাস্তায়, ক’দিন আগে শ্রমিকরা ধর্মঘট করলেন। প্রধানমন্ত্রীর মন কি বাত সকালবেলার গুরুবচন, ধর্ম ছাড়া আর কোনও বিষয় নেই। আর শেষে নিশ্চিত বাংলার নির্বাচনকে মাথায় রেখেই এক বাঙালি কবিতা পড়লেন, “ছুঁচসুতো পয়মন্ত, আসে তুঙ্গ হতে / দিয়াশলাই কাঠি, তাও আসে পোতে / প্রদীপ টি জ্বালিতে, খেতে, শুতে যেতে, কিছুতে লোক নয় স্বাধীন।’’ এখন কবিতার লাইন বললে কার কবিতা সেটা বলতে হয়, তিনি বললেন না। তাঁকে যা লিখে দেওয়া হয়েছে, তা অতি বাজে যতিচিহ্ন ভুলে পাঠ করলেন মাত্র। যিনি মোদীজির বক্তৃতা লিখেছেন, তিনিও মনমোহন বসুর কবিতা লেখা কতটা পড়েছেন সন্দেহ আছে, মনমোহন বসু হিন্দু মেলার সমর্থক ছিলেন, এইটুকু জেনেই তাঁর কবিতা কোট করে দেওয়া হল। তাহলে আসুন মনমোহন বসুর একটা কবিতা যা আজকের ভারতবর্ষের জন্য এক্কেবারে লাগসই সেটা পড়া যাক।
হায় দেশের হল কী? সব দেখি মেকি।
প্রবল ধলোর নকল শিখে, দুর্বল কালোর বুজরুকি
সেই কালোর গায়ে ধলোর পোষাকে, ময়ূর পাখ, যেন দাঁড় কাকে
সেই বিটকেল জন্তু দেখে বিজ্ঞ লোকে হয় দুখী
দেখে, কেউবা হাসে,কেউবা দোষে, কেউ রোষে দেয় গালি
ঘৃণায় কেউ বা ভাবে, মরণ আর কি, কেউ বা দেয় হাততালি।
এখন ন্যাশন্যালিটি আর লিবার্টি, কথায় কথায় কয়
কিন্তু কাজের বেলা বিজাতী চাল, স্বজাত, ঠেলা রয়
যাদের নকল করে তাদের ঘরে, এমন কি কেউ সয়?
তোদের নেশন, কই তার ন্যাশনালিটি?তোরাই তো মজালি ঘরটি
ভ্যাজাল দিয়ে খাঁটিকে মাটি, করলি রে ঘরের ঢেঁকি
রাজ্যে, রাজকীয় লিবার্টি খাঁটি, পাবার জো তো নাই
কাজেই সখ টি তার মীটাবার পথ টি ঘরেই করা চাই
অন্যে সবে না হাঁপ, গরীব মা বাপ আছে ফেলতে ছাই
ও তাই বুড়ো বাপ মার বুকে ঘাড়ে, ন্যাশনালিটির নিশানটি গাড়ে
তাদের সাধ্য নাই যে ঘাড়টি নাড়ে, স্নেহে- হায় বাঁধা টিকি
সে তো লিবার্টি নয়, লাইসেন্স চোর, আর নেমক হারামি
আসল স্বেচ্ছাচার, অত্যাচার, সে সব শুধু ভন্ডামি, ষন্ডামি।
কি কেলেঙ্কারি ভাবুন তো মোদীজি, বাংলার কবিদের ঘাঁটাবেন না, তারা ছত্রে ছত্রে যা লিখে গিয়েছেন তার বেশিরভাগটাই আপনাদের বিরুদ্ধ।
আর সেই দীর্ঘ মন কি বাতের শেষে মোদীজি মনে করিয়ে দিয়েছেন, গত বছরে প্রায় এই সময়ে পৃথিবীতে কোভিড এসেছিল, যার সংক্রমণ আজও পৃথিবীর মানুষের প্রাণ কাড়ছে। তা মোদীজি, তখন আপনি কী করছিলেন? আপনার মন কি বাত আর্কাইভ ঘেঁটে দেখলাম, ২০১৯ ডিসেম্বার তো বাদই দিলাম ২৬ জানুয়ারি ২০২০ র মন কি বাতে, অনেক বড় বড় কথা বললেও, আপনি কোভিডের কথা, সংক্রমণের কথা বলেননি, সেদিন আপনার অতিথি ছিল ব্রাজিলের বলসেনারো, তিনিও তাঁর দেশের মানুষকে তখনও একটা কথাও বলেননি। এর পরের মন কি বাত ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোভিড সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে, আর আপনি অন্যের লিখে দেওয়া তথ্য নিয়ে মন কি বাত বলেই চলেছেন। আর বিভিন্ন জনসভাতে আপনি যাকে পাপ্পু বলে তাচ্ছিল্য করেন, সেই রাহুল গান্ধী কিন্তু ওই ২০২০ র ১২ ফেব্রুয়ারি ট্যুইট করছেন, The Corona Virus is an extremely serious threat to our people and our economy. My sense is the government is not taking this threat seriously. Timely action is critical. বলছেন যে করোনা ভাইরাস দেশের মানুষ এবং অর্থনীতির ওপরে এক ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলবে। আমার মন বলছে, সরকার বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। হ্যাঁ দেশের বিরোধী দলের নেতা ১২ ফেব্রুয়ারি যা বুঝেছিলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী সেটা বোঝেননি।
কেবল মনের কথা বলাটা জরুরি নয়, কাজের কথা বলুন প্রধানমন্ত্রী, সেটাই মানুষ আশা করে, ওয়ান ওয়ে কমিউনিকেশন ছেড়ে বেরিয়ে আলাপ আলোচনায় বসুন সেটা মানুষ আশা করে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলছে, আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে কেবল বক্তৃতা দিতে অভ্যস্থ আমাদের মোদীজি কথা শোনার অভ্যেস ত্যাগ করেছেন বহু আগে। তাঁর মন কি বাত তাই এক মনোলগ, যা শুনে রবি ঠাকুরের কথায় বলাই যায়, ‘‘অনেক কথা যাও যে বলে, কোনও কথা না বলি, তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।’’