Written By সম্পাদক
রাজনৈতিক নেতারা মাঝে মধ্যেই অসাধারণ কিছু কথা বলেন। কমে আসছে, তবুও কিছু নেতা, এখনও কিছু বলেন যার মধ্যে তাঁর মেধার ঝলক দেখা যায়। ক’দিন আগে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বললেন, দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার শিলান্যাস মোদীজি করেছিলেন, ৮ নভেম্বর ২০১৬। এতবড় সত্যি কথাটা বলার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ, যদিও আমরা অনেকেই এই কথাটা বহু আগে থেকেই বলে আসছি, কিন্তু ভালো লাগলো শিলান্যাস কথাটা, মোদীজির সঙ্গে কথাটা যায় ভালো, এক ধ্বংসের শিলান্যাস।
বেশ কিছু বিজেপি নেতা, ভক্ত, এমনকি অর্থমন্ত্রীও বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে কোভিড, লকডাউনের ফলেই আমাদের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে, কোভিড সরে যাচ্ছে, আমারা আবার আলোর দিকে এগিয়ে চলেছি। বোকাদের সমস্যা কি একটা? মানুষ মাত্রেই ভুল করে, টু এর ইস হিউমেন। বোকারাও ভুল করে। সমস্যা হল, বুদ্ধিমান মানুষ ভুল করলে জানার পর তা শুধরে নেবার চেষ্টা করে, বোকারা ভুল করতেই থাকে, একই ভুল বারবার করতেই থাকে, কারণ তারা যে ভুল করেছে, সেটা তারা বুঝতেই পারে না। মোদীজি আর তাঁর মন্ত্রীসভার সমস্যাটাও সেটাই, ডিমনিটাইজেশন যে এক বিরাট ব্লান্ডার ছিল, তার ফলেই যে আমাদের অধোগতি শুরু হয়েছিল, এটা তাঁরা এখনও বুঝতে পারেননি, বুঝলেও মেনে নেবার মত মেধা তাঁদের নেই, অতএব ভুল শুধু ভুল চলছে। অর্থনীতির প্রত্যেকটা প্যারামিটার বলে দিচ্ছে, যে কত বড় সর্বনাশ করেছে ডিমনিটাইজেশন, কেবল মোদীজি, তাঁর দল আর মন্ত্রিসভার মাথায় তা ঢুকছে না। এমনটা হয়, এবং তার জন্য মূল্য চোকাতে হয়, দেশ সেই দায় বহন করছে।
৮ নভেম্বর, ২০১৬ তে মোদীজির ঘোষণার পরে সারা দেশ থ মেরে গেছে, মানুষ ব্যাঙ্কে, এটিএমে লাইনে, এমন কি বাম দলগুলোও থম মেরে বসে আছে, তারাও বুঝতে পারছে না, এর ফল কী হতে পারে। তখন সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র প্রতিবাদ গিয়েছিল বাংলা থেকে, করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ৯ তারিখ সকালের নিউজ পেপার খুলে দেখুন, একমাত্র বিরোধিতার স্বর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল গান্ধীকে চিদাম্বরম বোঝাচ্ছেন যে এতে কালো টাকা উদ্ধার হবে, বিরোধিতা করলে মানুষ ভুল বুঝবে, কংগ্রেসের স্বর নিচুতে বাঁধা, এসপি, বিএসপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক দল একটা কথাও বলেনি, সিপিএম নেতা ইয়েচুরি দ্বিতীয় দিনে প্রতিবাদ জানালেন, বললেন এটা চমক, সঙ্গেই তৃণমূলের প্রতিবাদের সমালোচনাও করলেন। মমতা বললেন, এটা তুঘলকি ফতোয়া, অবিলম্বে এই নির্দেশ তুলে নিতে হবে। রাজনৈতিক দিক থেকে এক্কেবারে একলা, কিন্তু সেদিন প্রথম বিরোধিতা, তীব্র বিরোধিতার স্বর ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, বলেছিলেন, ন্যূনতম অ্যাকশন প্ল্যান ছাড়া এই নির্দেশ মানুষের সমস্যা বাড়াবে, আর এক সেকেন্ড ও এই সরকারের থাকা উচিত নয়, আজ এতদিন পরে প্রত্যেক বিরোধী দল এ বিষয়ে একমত।
শুক্রবার জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর জানালো, জুলাই সেপ্টেম্বরে দেশের অর্থনীতির সঙ্কোচনের পরিমাণ, ৭.৫%। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস, মানে এপ্রিল মে জুন এ এই সঙ্কোচনের পরিমাণ ছিল ২৩.৯%। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সঙ্কোচন, ২৩.৯%। কিন্তু তা ছিল লকডাউনের পরে, দীর্ঘ লকডাউনে অর্থনীতির সঙ্কোচন হবার কথা, হয়েছে। এটা বলার পর অনেকেই অন্য দেশের, এমন কি পড়শি দেশের দিকে আঙুল তুলে বলেছে, সেখানে হল না কেন? বাংলাদেশ, নেপাল ভুটান ও আমাদের থেকে ভালো অবস্থায় কেন? কারণটা কি লকডাউন? নাকি আমাদের দেশের অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য অন্য কোনও তথ্য জানা দরকার, যা আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি, নজর আন্দাজ করছি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরপর দুটি ত্রৈমাসিকে জিডিপি সঙ্কোচন হলে, তাকে ‘টেকনিক্যাল রিসেশন বা আপাত মন্দা’ বলা হয়। ১৯৯৬-এর পর এই প্রথম এমন আর্থিক সঙ্কোচনের মুখে পড়তে হল ভারতের অর্থনীতিকে। আর অন্য ধারে ২০২০-২০২১ অর্থবর্ষ শেষ হবার পাঁচ মাস আগেই রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ ১২০%। মানে কমবেশি ১০০ টাকা এসেছে, ১২০ টাকা খরচ হয়েছে। আরও সোজা করে বললে, সরকারের আয় উল্লেখযোগ্যভাবেই কমেছে, বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ৭.৯৬ লক্ষ কোটি টাকা হবার কথা বলেছিলেন নির্মলা সীতারমন, এরই মধ্যে সাত মাসেই, সেই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে, ৯.৫৩ লক্ষ কোটি টাকা। প্রথম সাত মাসে নিট কর আদায় প্রায় ১৬ % কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৭৬ লক্ষ কোটি টাকায়, আর খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬.৬ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী দাবি করেছিলেন বাজেট ঘাটতি জিডিপি র ৩.৫% এর মধ্যে থাকবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন তা ৮% গিয়ে ঠেকবে।
এসব তথ্য থেকে দুটো জিনিষ উঠে আসছে, তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
প্রথমত জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের এই পরিসংখ্যান হাতে আসার পরেই, কিছু আমলা বলতে শুরু করেছেন, যাক ফাঁড়া কেটে গেলো, এরপরের ত্রৈমাসিকে সঙ্কোচন তো হবেই না, উলটে জিডিপি’র পজিটিভ গ্রোথ হতে পারে, মানে যা এখন – ৭.৫%, তা এক দেড় পার্সেন্টে আসতে পারে। হরি নাম খাবলা খাবলা। যাঁরা একথা বলছেন, তাঁরা ভুলে মেরে দিয়েছেন যে, এই সময়ের মধ্যে আমাদের ফেস্টিভ্যাল গুলো গেলো, মানুষ যা হয় কিছু কেনাকাটা করেছেন, তার প্রভাব পড়বে এই পরিসংখ্যানে, তারপর কিন্তু অর্থনীতি আবার এক মন্দার দিকে এগোবে, বাজারও বলছে দেওয়ালির পর থেকে আবার বাজার ঠান্ডা। বেসরকারি কেনা বেচা, মানে আমি আপনি যা কিনি বা বিক্রি করি তা কিন্তু ১১.৫% কমেছে। এবং তার সঙ্গেই কমছে, কমবে সরকারি ব্যয়, কারণ রাজস্ব ঘাটতি। অথবা সরকার টাকা ছেপে ঘাটতি পূরণ করবে, ফলে অবধারিত মুদ্রাস্ফিতি, মূল্যবৃদ্ধি। অর্থাৎ আমাদের অর্থনীতি এক মন্দার মধ্যে ঢুকে পড়েছে, যা থেকে বের হওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু কঠিন। সেই বের হওয়ার আগে আমাদের ভুল কোথায় হয়েছিল, তা দেখতে হবে, ভুলটা জানতে পারলে তার সংশোধন করা যাবে, সমস্যাটা সেখানেই, এ সরকার এখনও তাদের ভুল চিহ্নিত করে উঠতে পারল না, বিশ্বের অর্থনীতিবিদ, ভারতের তাবত পন্ডিত অর্থনীতিবিদদের কথা শোনাটাকে তাঁরা অপমান বলে মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী তো মনেই করেন হার্ভাট ভারসেস হার্ড ওয়ার্কের তত্ত্বে তিনি হার্ড ওয়ার্ক এর দিকে, হার্ড ওয়ার্কের আগে সি পরিকল্পনা যে হার্ভাট থেকে আসতে পারে, তা তিনি বিশ্বাসই করেন না, অতএব অমর্ত্য সেন, রঘুরাম রাজন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়রা হার্ভাট, আর উনি হার্ড ওয়ার্কার। ব্যাস, যা হবার তাই হচ্ছে, কলুর বলদ চোখে ঠুলি এঁটে একই বৃত্তে ঘুরছে তো ঘুরছেই, পরিশ্রম করছে কিন্তু ফল নেই।
২০১৬, ৮ নভেম্বর মোদীজি ডিমনিটাইজেশনের ঘোষণা করলেন। ২০১৭ -২০১৮ জিডিপি কত? ৭.২%। ২০১৮ র প্রথম ত্রৈমাসিক ৮.২%, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক ৭.১ %, তৃতীয় ত্রৈমাসিক ৬.২%, চতুর্থ ত্রৈমাসিক ৫.৬ %। আসুন ২০১৯ এ, প্রথম ত্রৈমাসিক ৫.৭%, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক, ৫.২ %, তৃতীয় ত্রৈমাসিক ৪.৪ %, চতুর্থ ত্রৈমাসিক ৪.১%। এবার ২০২০ প্রথম ত্রৈমাসিক, এখানে কোভিডের প্রভাব নেই, ৩.১%। এরপর লকডাউন, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক -২৩.৯%, এরপর এল তৃতীয় ত্রৈমাসিকের হিসেব, -৭.৫%।
অর্থাৎ ২০১৭ থেকে লাগাতার অর্থনীতি নিচে নেমেছে, সরকার হার্ড ওয়ার্ক করছে, কলুর বলদের মত একই বৃত্তে ঘুরছে, ঘামছে কিন্তু বোঝার চেষ্টা করছে না, বুঝতে পারছে না। দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদদের কথা শুনতেই চাইছে না, তাঁদের লক্ষ ভোট, নির্বাচন, ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ, হিন্দুত্ব, দল ভাঙানো, আর কিচ্ছু নয়। বিক্রি হয়ে যাক স্বদেশ আমার, তাদের কিচ্ছু যায় আসে না, বেকার বাড়ুক, সবল হাতে কাজের বদলে আসুক গেরুয়া ঝান্ডা, আইটি টিমের হাজার দুই তিন ভিক্ষে, তাতেই চলে যাবে আরএসএস বিজেপির রথ। তাই সারা দেশ যখন ডুবছে, সারা দেশে বেকারি বাড়ছে, মুল্যবৃদ্ধি বাড়ছে, ঠিক তখন বিজেপির ব্যাঙ্কে টাকা যাচ্ছে অভূতপূর্ব পরিমাণে, দেশের হাতে গোনা কিছু শিল্পপতির সম্পদ বাড়ছে লক্ষ কোটির হিসেবে, মুকেশ আম্বানির সম্পদ বেড়েছে ৭৩%, মোট সম্পদ ৬ লক্ষ ৫৮ হাজার ৪০০ কোটি, আদানির সম্পদ বেড়েছে ৪৮%, ১লক্ষ ৪০ হাজার ২০০ কোটি টাকা, দামানিদের সম্পত্তি বেড়েছে ৫৬ %, ৮৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা, শিব নাদারদের বেড়েছে ৩৪%, এক লক্ষ ৪১ হাজার সাতশ কোটি টাকা, তার মানে কিছু শিল্পপতি দেশের এই দুর্দিনেও তাঁদের সম্পদ বাড়িয়েছেন, দেশের জিডিপি নামে নামুক। দেশের শিল্পপতিদের সম্পদ তো বাড়ছে, এটাই বিজেপির রাজনীতি, এটাই আরএসএসের দর্শন, তারই শিলান্যাস নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদী করেছিলেন ৮ নভেম্বর, ২০১৬। ওই নভেম্বর আসে আমেরিকা পেয়েছিল এক উদ্ধত শাসক ডোনাল্ড ট্রাম্পকে, ভারত পেয়েছিল ডিমনিটাইজেশন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বিদেয় হয়েছে, দেখা যাক এখানে কী হয়।