Written By অনিরুদ্ধ সরকার
দেশজুড়ে, ৪ ডিসেম্বর বীরত্বের সঙ্গে পালিত হয় "নৌ-সেনাদিবস"। ১৯৭১ সালের ঠিক এই দিনে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়, ভারতীয় নৌ-বাহিনী আক্রমণ করেছিল পাকিস্তানের করাচি বন্দরের ওপর। সেই বীরত্বপূর্ণ আক্রমণের দিনটিকে ভারতীয় নৌ-সেনা, "নৌ-সেনা দিবস" হিসেবে পালন করে আসছে।
সেদিন গুজরাটের ওখা বন্দর থেকে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী আই.এন.এস ত্রিপাত, আই.এন.এস নির্ঘাত, আই.এন.এস বীর এই তিনটি জাহাজ পাকিস্তানের করাচি বন্দর আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় এবং আক্রমণ চালিয়ে করাচি বন্দরের একাংশ বিধ্বস্ত করে দেয়। এই যুদ্ধে সাড়ে ৩ হাজার পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভারতীয় নৌবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। ৫০০০ নৌ বৈমানিক শাখাসদস্য ও ২০০০ মেরিন কম্যান্ডো সহ প্রায় ৫৮,৩৫০ জন সক্রিয় সেনাকর্মী সম্বলিত এই নৌবাহিনী বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম।
সমুদ্র সুরক্ষায় বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশগুলির সঙ্গে প্রথম সারিতে নাম নেওয়া হয় ভারতের। ভারতীয় নৌ-বাহিনী পৃথিবীর অন্যতম সর্ববৃহৎ নৌ-বাহিনী। ভারতবর্ষের হাতে রয়েছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রণতরী "বিক্রমাদিত্য"। নৌ-বাহিনীর প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে,--- সাবমেরিন দমনকারী সামুদ্রিক যুদ্ধ অভিযান, স্থল যুদ্ধ দমনকারী সামরিক অভিযান, সামরিক অনুসন্ধান-নজরদারি, সমুদ্রসীমার সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক গতিবিধির প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা।
ভারতের সামরিক ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা যায় ভারতের নৌবাহিনী কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন। এদেশে প্রথম সেনাবাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায় বেদে। শুধু তাই নয় নৌ-সেনার উল্লেখ আছে 'রামায়ণ' ও 'মহাভারতে'ও। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার 'লোথালে' গড়ে উঠেছিল ভারতের প্রথম আধুনিক ডক। 'ঋকবেদে' বরুণদেবকে সমুদ্রপথের দেবতা বলা হয়েছে। পুরাণ ঘেঁটে জানা যায়, সেযুগে প্লব নামের একধরনের জাহাজ ছিল। আর তাতে এক প্রকার 'পার্শ্বপক্ষ' ছিল যা ঝড়ের মধ্যে জাহাজকে স্থির রাখতে সাহায্য করত। খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে 'মৎস যন্ত্র' নামে এক প্রকার যন্ত্র ছিল। যার ব্যবহার ছিল কম্পাসের মত। প্রাচীন বৈদিক যুদ্ধবিদ্যাই পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীকে আলোকিত করেছিল। আর এই যুদ্ধবিদ্যারই একটি অন্যতম অঙ্গ হল নৌ-যুদ্ধ। প্রাচীন যুগে "দিশাকাক" নামে এক ধরনের পাখি ছিল, যাকে নাবিকেরা জলযান থেকে উড়িয়ে দিয়ে অনুসরণ করে অগ্রসর হতেন।
বৈদিক ভারতবর্ষে নৌ-বাহিনী ব্যবহৃত হত মূলত নদী ও সমুদ্রপথে রাজ্যকে সুরক্ষা প্রদান করতে, বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে আর সেই সঙ্গে জলপথে যদি যুদ্ধ হয় তার জন্য প্রতিপক্ষকে জবাব দেওয়ার জন্য। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে একাধিক সমুদ্র যুদ্ধের উদাহরণ রয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মনু স্মৃতি থেকে একাধিক প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে ভারতীয় নৌসেনার।
খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মৌর্যদের দেশের প্রথম সুসংহত নৌ-বাহিনী গড়ে ওঠে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্যের "অর্থশাস্ত্র" গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে নৌ-অধ্যক্ষের অধীনে একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগের বর্ণনা পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে এবং "বৌধায়ন ধর্মসূত্র" নামক বৌদ্ধগ্রন্থে "সমুদ্রসাম্যনম" শব্দটি থেকে সে যুগে নৌ-অভিযানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।চোল রাজাদের সামুদ্রিক বাণিজ্য ও সমুদ্র অভিযান প্রশস্ত হয়েছিল চীন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে মারাঠা ও কেরল নৌ-বাহিনীর ধীরেধীরে সম্প্রসারণ ঘটে। তারা একাধিক ইউরোপীয় নৌ-বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। কাহ্নোজী আংড়ে ও কুজ্ঞলি মারাক্কার ছিলেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ দুই নৌ-যোদ্ধা।
ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে আধুনিক ভারতীয় নৌ-বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে। ভারতীয় নৌসেনাকে তখন বলা হত 'দ্য রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি'। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় নৌ-বাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটে। এই বিদ্রোহে ৭৮ টি জাহাজ, ২০টি-বন্দর প্রতিষ্ঠান ও প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ নাবিক অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৫০ এর ২৬ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতীয় নৌ-বাহিনীর নতুন নামকরণ হয় "ভারতীয় নৌ-বাহিনী"। ছত্রপতি শিবাজীকে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর পিতা আখ্যা দেওয়া হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর নীতিবাক্য: "শ নো বরুনঃ" অর্থাৎ "সমুদ্র দেব আমাদিগের সৌভাগ্য প্রদাতা হউন"।
২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে শক্তি ও বহরে ভারতীয় নৌসেনা সপ্তম বৃহত্তম। ৫৮ হাজার সেনা ও অফিসার রয়েছে এই বাহিনীতে। ২টি এয়ারক্রাফ্ট কেরিয়ার, ১টি ট্রান্সপোর্ট ডক, ১৯টি ল্যান্ডিং শিপ-ট্যাঙ্ক, ১০টি ডেসট্রয়ার, ১৫টি ফ্রিগেট, একটি নিউক্লিয়ার-পাওয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন, ১৪টি পাওয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন, ২৫টি করভেট, ৪৭টি প্যাট্রোল ভেসেল, ৪টি ফ্রিট ট্যাঙ্কার, ১টি মিসাইল সাবমেরিন রয়েছেন। ভারতীয় নৌবাহিনীর মার্কোস বা মেরিন কম্যান্ডোরা 'মগরমাছ' নামে পরিচিত। ভারতীয় নৌসেনার বিশেষ বাহিনী এটি। শুনলে অবাক লাগতে পারে ভারতীয় নৌসেনার সদস্যরাই সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রথম যারা ২০০৪ সালের ১৮ মে মাউন্ট এভারেস্ট অভিযান করে। সেই দলে ছিলেন সার্জন লেফটেন্যান্ট ভাইকিং ভানু, একজন নেভি চিকিৎসক, একজন রাকেশ কুমার, বিকাশ কুমার সহ অন্যান্যরা। এই দলটিই এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছয়। ২০০৮ সালে মুম্বই জঙ্গি হামলার সময় এই বাহিনী পণবন্দিদের ছাড়াতে মদত করে। সারা পৃথিবীতে সকল দেশের নৌসেনার মধ্যে মাত্র তিনটি অ্যাক্রোব্যাটিক দল রয়েছে। যার মধ্যে একটি ভারতীয় নৌসেনায় রয়েছে। ভারতীয় সেনায় এই দলটির নাম সাগর পবন।উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে সফল অভিযান সেরে ফিরেছে ভারতীয় নৌসেনা। ২০০৮ সালের ৯ এপ্রিল দশজনের ভারতীয় নৌসেনার দল ইতিহাস তৈরি করে উত্তর মেরুতে পৌঁছয়।
বর্তমানে ভারতীয় নৌ-বাহিনী পারমাণবিক শক্তি সম্পন্ন এবং অত্যাধুনিক মিশাইলে সজ্জিত। যা ভারতের শত্রু দেশের কাঁপুনি ধরাতে যথেষ্ট। সাম্প্রতিককালে পুলওয়ামার সন্ত্রাসবাদী হামলার প্রেক্ষিতে ভারতীয় বায়ুসেনার "বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক" এবং সেইসঙ্গে ত্রিস্তরীয় সমরসজ্জার জন্য বিভিন্ন ধরনের আয়তনের ৬০ টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হয় পাকিস্তানের দিকে তাক করে। পাশাপাশি ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- অস্ট্রেলিয়া-জাপান এই চারটি দেশ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন বন্ধ করতে একত্রিত হয়। এটিও ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি দুঃসাহসিক অভিযান। এই অভিযানকে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক নাম দিয়েছে "কার্যকারী মোতায়েন"। ভারত ভারসাম্যের নীতিতে বিশ্বাস করে এবং সেই কারণেই এই অভিযানে শামিল হয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় নৌ-সেনার ইতিহাসের প্রথা ভেঙে প্রথম যুদ্ধ জাহাজে নিযুক্ত হলেন দুই মহিলা অফিসার-- সাব-লেফটেন্যান্ট কুমুদিনী ত্যাগী এবং সাব-লেফটেন্যান্ট রীতি সিং। কোচিতে আই.এন.এস গরুড় যুদ্ধ জাহাজে একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাঁদের নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়। এখন প্রতি বছর, নৌসেনা দিবস উপলক্ষে মুম্বইয়ের 'গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া'য় নৌসেনার পক্ষ থেকে একটি বিটিং রিট্রিট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।