Written By সম্পাদক
আপনি খবরের কাগজ খুলুন বা আপনি খবরের টেলিভিশনের চ্যানেল দেখুন, দেখবেন, একের পর এক ঢেউয়ের মতো খবর আসছে। বড় খবর, ব্রেকিং নিউজ, এক্সক্লুসিভ খবর, রাজনীতির খবর, অকিঞ্চিৎকর ছোট খবর, যা আপনি দিন-রাত্তির শুনছেন, তার কিছু মনে থাকে কিছু আপনি ভুলে যান। আমরা আজ গত ১৫-২০ দিনে ঘটে যাওয়া কিছু তথাকথিত বড় খবর, কিছু তথাকথিত ছোট খবর নিয়ে কথা বলব। আলোচনা করব, ওই সব খবরের পিছনে কী লুকিয়ে আছে। যেমন ধরুন গত ২৩ নভেম্বরের একটা ছোট্ট খবর। খবরের কাগজে লেখা হয়েছে, ‘বেপরোয়া গতিতে বাইক চালাতে গিয়ে একটি হাতে টানা রিকশাকে ধাক্কা মারায় জখম হলেন রিক্সার আরোহী। ২৩ নভেম্বর, শনিবার বিকেলে ঘটনাটি ঘটেছে পশ্চিম বন্দর থানার লোহাগেটের কাছে। পুলিশ জানিয়েছে আহত সওয়ারির নাম খেয়ালি সাউ। তিনি একবালপুরের বাসিন্দা’। আমরা সবাই জানি, টানা রিক্সা এই শহর থেকে উঠে গিয়েছে দীর্ঘকাল। আর আমরা সবাই জানি, উঠে গেলেও, কলকাতার কোনও কোনও অঞ্চলে সামান্য কিছু রিক্সা, বিরল প্রজাতির পাখির মতো এখনও রয়ে গি্য়েছে। কলকাতায় যদি আপনি ঘোড়ায় টানা গাড়ি দেখতে চান চলে যান রাজাবাজারে বা ভিক্টোরিয়ায়। ট্রাম উঠি উঠি করেও এখনও রয়ে গিয়েছে। কলকাতায় বহু মানুষ আছেন তাঁরা চান ট্রাম যেন এই শহরে থাকে। এসব কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, এই শহরটার চরিত্রই এমন। এখানে উবের-ওলা-টানা রিকশা- এক্কাগাড়ি-ট্রাম-হলুদ ট্যাক্সি- এসি-বাস-সাধারণ বাস-এল-বাস-অটো সব চলে। পালকি বাদে যত যানবাহন এই শহরে একবার এসেছে, সব থেকে গিয়েছে। এখানে সবার কদর রয়েছে। এই জিনিস ভারতের আর কোনও শহরে নেই। এ হল কলকাতার চরিত্র। এত গেল শহরের কথা। এমন রাজ্য কি দেশে আরেকটা আছে? যেখানে ছ’ছ’খানা নোবেল পুরস্কার এসেছে। বা যার আছে ১৯ শতকের নবজাগরণের ইতিহাস। দেশ স্বাধীন করতে এত আত্মত্যাগ, পঞ্জাব ছাড়া আর কোন দেশের আছে! বাঙালির এই অহঙ্কারকে খাটো করে দেওয়ার একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে। দিলীপ ঘোষ বলছেন, কিছু বাঙালি নেতা পেছন পেছন হ্যাঁ-হ্যাঁ বলা সং-এর মতো ধুয়ো দিচ্ছেন, এবার নাকি তাঁরা বাঙলাকে গুজরাট বানাবেন। গুজরাটকে আমরা কী ভাবে চিনি? কল কারখানা আছে বলে? সে তো আরও বহু রাজ্যে আছে। আর? আমূল কো-অপারেটিভ। ওটা কোনও গুজরাটবাসীর কৃতিত্ব নয়। ভার্গিস কুরিয়ান গুজরাটের মানুষ ছিলেন না। আর? গান্ধী? গুজরাটের শাসন ভার যাদের হাতে, যারা বাংলাকে গুজরাট বানাতে চায়, তাঁরা তো গান্ধী হত্যাকারীর নামে জয়ধ্বনি যারা দেন, তাদের বিরুদ্ধে কখনও একটা কথাও বলেন না। গান্ধীর খুনির নামে জয়ধ্বনি দিলে বিজেপিতে যে গুরুত্ব বাড়ে, তা তো আমরা সাধ্বী প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে দেখেছি। বল্লভভাই প্যাটেল? প্যাটেল ছিলেন দিলীপবাবুদের রাজনীতির ঘোরতর বিরোধী। তিনি কখনও বাংলাকে গুজরাট বানাতে চাননি। বরং প্যাটেলই তো নেহরুকে নোট দিয়ে জানিয়েছিলেন, গান্ধী হত্যার খবরে উল্লসিত আরএসএস, মানে দিলীপবাবুরা যে সংগঠন থেকে এসেছেন, তাঁরা, রাস্তায় মিষ্টি বিলি করেছিল। আর? আর সারা দেশ জানে ২০০২ সালে গুজরাটের সংখ্যালঘু নিধনের কাহিনি। প্রায় একহাজার সংখ্যালঘুকে খুন করা হয়েছিল। যে হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে দেশের এক প্রাক্তন সেনাকর্তা লিখে গিয়েছেন, সেনাকে হিংসা থামানোর জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন দিতে তৎকালীন মোদী সরকার ২৪ ঘণ্টা দেরি করেছিল। সেই লেফট্যান্যান্ট জেনারেল জামিরুদ্দিন শাহ, তাঁর বইয়ে আক্ষেপ করে লিখেছেন, সেনা সময় মতো যানবাহন পেলে হয়তো মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমানো যেত। তা দিলীপবাবুরা পশ্চিমবঙ্গকে কোন গুজরাট বানাতে চান? ইতিহাস না-জানা, আত্মবিস্মৃত কিছু বাঙালি হয়তো জয় শ্রী রাম বলে হুঙ্কার ছাড়বেন এই কথা শুনে কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পরবেন, গুজরাট কখনো বাঙালির মডেল হতে পারে না। রামমোহন থেকে শুরু করে বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, স্বাধীনতা আন্দোলন, বন্দেমাতরম, জনগনমনঅধিনায়ক, বাঙালি ভারতকে যত দিয়েছে, ভারত বাঙালিকে তার কিছুই দেয়নি। বাউল গানের শহর, রবীন্দ্র সঙ্গীতের শহর, লিটল ম্যাগাজিনের শহর, জীবনানন্দ, সুনীল, শক্তির শহর, সত্যজিৎ, ঋত্বিকের এই কলকাতা শহরকে, হয়তো গুজরাটওয়ালারা এরপর বলবেন, আহমেদাবাদ বানাবো। বাঙালির যেন এই দুর্দিন না-আসে। কথা শুরু করেছিলাম নানা রকমের খবর নিয়ে। সেখানেই ফিরে আসা যাক। তার আগে একটা প্রশ্ন। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কি বাড়িতে কলাপাতায় লাঞ্চ-ডিনার করেন? তাঁর বাড়িতে যদি প্রধানমন্ত্রী যান, তিনি কি কলাপাতায় খেতে দেবেন? প্রশ্নটা এই কারণেই যে, আমরা খবরের কাগজে, টেলিভিশনে ছবি দেখলাম, গত ৫ নভেম্বর বাঁকুড়ায় এসে অমিত শাহ চতুরডিহি গ্রামের আদিবাসী বিভীষণ হাঁসদার বাড়িতে কলাপাতায় দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। পাশে, দেখে মনে হচ্ছে নতুন কাঁসার গেলাসে তাঁকে জল দেওয়া হয়েছে। এর আগেও তাঁকে আদিবাসীদের ঘরে কলাপাতায় খেতে দেখা গিয়েছে। কেন কলাপাতায়? আদিবাসীদের বাসনে খেতে কোনও অসুবিধে আছে? এর উত্তর আমাদের জানা নেই। শুধু আমরা এটুকু বলতে পারি হলফ করে, বাড়িতে তিনি কলাপাতায় খাবার খান না। ফলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আদিবাসী বিভীষণ হাঁসদার বাড়িতে খাবার খাচ্ছেন, খবর শুধু সেটুকুই নয়। খবর এটাই যে, তিনি আদিবাসী বিভীষণ হাঁসদার বাড়ির বাসনে নয়, কলাপাতায় করে দুপুরের খাবার খেয়েছেন। এমনও হতে পারে যে বিভীষণ হাঁসদা নিজেই তাঁকে জোর করে কলাপাতায় করে খাইয়েছেন, অমিত শাহ রাজি ছিলেন না, কিন্তু বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছেন। হতে পারে, কিন্তু হয়েছে কি না তা আমরা জানি না। সাংবাদিকরা অমিত শাহকে এই প্রশ্ন করেননি। ফলে এর জবাব আমাদের জানা নেই। বাঁকুড়া নিয়ে যখন কথা হচ্ছে তখন বাঁকুড়ার আরও দুটো মন ভালো করে দেওয়া খবর বলে নিই আপনাদের। খুব ছোট করে, গুরুত্বহীন ভাবে, এই দুটি খবর কোনও কোনও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আপনাদের নজরে পড়েছে কি না আমি জানি না। প্রথম খবর, গত ২৪ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঁকুড়ায় গিয়ে বলেছেন, বাংলার গর্ব বিষ্ণপুরের বালুচরি শাড়িতে যুগ যুগ ধরে সুতো দিয়ে একই ধরনের নকশা এঁকে চলেছেন তাঁতিরা। পৃথিবী অনেক বদলে গিয়েছে। বালুচরির আকর্ষণ বাড়াতে আধুনিক, শিল্পসম্মত নকশা কী কী করা যায়, কী ভাবে করা যায়, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের ভাবনা-চিন্তা করতে বলেছেন। সামনে ভোট, সারা দেশের মতো করোনায় আক্রান্ত রাজ্য, এমন সময়ও সরকারি কাজে গিয়ে বালুচরির নকশা আধুনিকীকরণের কথা ভাবতে পারা, সম্ভবত এখানেই একজন বাঙালি মুখ্যমন্ত্রীর অনন্য। শুধু এটুকুই নয়। মুখ্যমন্ত্রী বাঁকুড়ায় থাকাকালীন আরও একটা তথাকথিত ছোট, আসলে খুবই বড় খবর হয়েছে। সেটা হল, বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত, ষোড়শ শতাব্দীর, তালপাতা এবং ভুর্জপত্রে লেখা কয়েক হাজার পুঁথি ডিজিটাইজ করা হবে। সারা পৃথিবীর গবেষকদের কাছে অনলাইনে এই অমূল্য সম্পদের দরজা খুলে যাবে। আসুন আবার আমরা ফিরে যাই রাজনীতির খবরে। এই ক’দিন আগে বিহারে ভোট হয়ে গেল। বিজেপি বিহারের ভোট নিয়ে তাদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে বলল, বিজেপি জিতলে বিনা পয়সায় বিহারবাসীকে কোভিডের টিকা বা ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। প্রশ্ন উঠেছিল জীবনদায়ী ওষুধ নিয়ে এই ধরনের রাজনৈতিক প্রচার করা যায় কি না! নালিশ গিয়েছিল নির্বাচন কমিশনে। নির্বাচন কমিশন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছে, এর মধ্যে দোষ কিছু নেই। কিন্তু এর পর দুটো জিনিস ঘটল। এক, সরকারি ভাবেই বলা হল, টিকা সারা দেশের মানুষই পাবেন বিনা পয়সায়। দুই, মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, টিকা কবে আসবে তা তিনি জানেন না। তার মানে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব জানেন না টিকা কবে আসবে, অথচ ভোটের প্রচারে বলা হল বিহারে তাঁদের জেতালে বিনামূল্যে টিকা। দ্বিতীয়ত, যে টিকা সবাইকেই বিনামূল্যে দেওয়া হবে বলা হচ্ছে, সেটা বিহারবাসীর পাওয়ার জন্য বিজেপিকে ভোট দিতে বলা হল কেন? এ অনেকটা সেই ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ গল্পের মতো মিথ্যা কথা হয়ে গেল না! যাকে বলা হয়, অর্ধসত্য। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবরা জানতেন অস্ত্রগুরু দ্রোণ দুর্দমনীয়। তাঁকে বধ করার জন্য পাণ্ডবদের ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কৃষ্ণের প্ররোচনায় দ্রোণকে তাঁর পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ শোনানো হয়। বাস্তবে নিহত হয়েছিল অশ্বত্থামা নামের একটি হাতি। যুধিষ্ঠীর দ্রোণকে চিৎকার করে বলেন, ‘অশ্বত্থামা হত’। কিন্তু নিজের সত্যবাদিতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য খুবই মৃদুস্বরে উচ্চারণ করেন— ‘ইতি গজ’। সত্যবাদী যুধিষ্ঠীরের চরিত্রে ‘অর্ধসত্য’ কথনের কলঙ্ক এসে লাগে। আর এই কারণেই তাঁকে একবারের জন্য নরকদর্শন করতে হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য এমন কিছু ঘটেছে বলে আমাদের কাছে কোনও খবর নেই। কথা হচ্ছিল কোনটা খবর তা নিয়ে। কোন খবরকে আপনি কী চোখে দেখবেন, তাই নিয়ে। ধরুন সিএএ বিরোধী আন্দোলনের কথা। আন্দোলনকারীদের পোশাক দেখে চেনা যায় বলে হুমকি দিলেন প্রধানমন্ত্রী। ধরা যাক শাহিনবাগের জমায়েতের কথা। যে জমায়েতকে উদ্দেশ্য করে বিজেপি নেতা মন্ত্রী এবং সমর্থকেরা আওয়াজ তুললেন, গোলি মারো শালোকো। আর ওই জমায়েতের অনত্যম মুখ ৮২ বছরের বিলকিস বানো বা দাদিকে পৃথিবীর মানুষ কী চোখে দেখেন, তা জানা গিয়েছে দুনিয়ার অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যম টাইম ম্যাগাজিন, এবং বিবিসির সমীক্ষায়। দেশ বিদেশের খবরের কাগজে লেখা হয়েছে, ভারতে সম্প্রতি যে আন্দোলনগুলো বড় আকার ধারণ করেছিল, তার মধ্যে অন্যতম নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)-বিরোধী বিক্ষোভ। ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টে এই আইন পাস হয়। এরপর দেশজুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। রাজধানী নয়াদিল্লির শাহিনবাগের বিক্ষোভ সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। এই বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন নারীরা। এই নারীদের মধ্যে বয়স্ক কয়েকজন নারী ছিলেন আলোচনার কেন্দ্র। তেমনি একজন নারী এবার টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় স্থান পেয়েছেন। ৮২ বছর বয়সী এই নারীর নাম বিলকিস। তাঁর আরেকটি পরিচয় তিনি শাহিনবাগের‘দাদি’। আরেকটি সাম্প্রতিক খবরে বলা হয়েছে, এ বছর বিশ্বের অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে বিবিসি। এই তালিকায় ভারত থেকে রয়েছেন ‘শাহিনবাগ দাদি’ নামে পরিচিত বিলকিস বানো, তামিলনাড়ুর গায়িকা ইসাইবানি, প্যারা ব্যাডমিন্টনে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মানসী যোশি এবং পরিবেশকর্মী ঋদ্ধিমা পাণ্ডে। পৃথিবীর মানুষ যে আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণার উৎস বলছেন, আপনি তাঁদের গদ্দার বলবেন না কুর্নিশ করবেন? ভেবে দেখুন। ভেবে দেখার আরও বিষয় আছে। সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। বিজেপির বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে সিএএ নিয়ে। কৃষিবিল নিয়ে বিক্ষোভ এখনও চলছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। মোদী সরকার মানুষের প্রতিবাদে কান দিচ্ছে না। বহু বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। উল্টো দিকে কেরলের বামপন্থী সরকারের দিকে তাকান। কেরলের বাম সরকার ‘Publishing and Disseminating offensive content’, অর্থাৎ ইন্টারনেটে সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর প্রচার আটকাতে একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, এর উদ্দেশ্য আসলে ইন্টারনেটে স্বাধীন মতামত প্রকাশে বাধা দেওয়া। প্রতিবাদ হয় দেশের বিভিন্ন জায়গায়। সেই প্রতিবাদকে সম্মান জানিয়ে কেরলের বাম সরকারের প্রধান, মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছেন তাঁরা ওই অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। সিএএ, কৃষিবিল নিয়ে মানুষের প্রতিবাদের মুখে মোদী সরকারের ভূমিকা আর অধ্যাদেশ নিয়ে মানুষের প্রতিবাদের সামনে কেরলের বাম সরকারের প্রতিক্রিয়া, দুটোর মধ্যে আপনারা নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন, আকাশ পাতাল ফারাক। কোন সরকারকে আপনি মানবিক বলবেন, কোন সরকারকে আপনি সিভিলাইজড বলবেন, আপনি ঠিক করুন। এবার লাভ-জিহাদ প্রসঙ্গ। প্রেম ভালোবাসায় নাক গলাতে চায় রাষ্ট্র। হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েদের মধ্যে যাতে বিয়ে না হয়, তাকে ঠেকাতে কড়া আইন করতে চলেছে যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ সহ বেশ কয়েকটি বিজেপি শাসিত রাজ্য। গত ২৩ নভেম্বর মঙ্গলবার যোগী আদিত্যনাথের সরকার রাজ্য ক্যাবিনেটের জরুরি বৈঠকে এই অর্ডিন্যান্সটি পাস করিয়েছে। ওই অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছে শুধুমাত্র একটি মেয়ের ধর্ম পরিবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে দুই ধর্মের মধ্যে কোনও বিয়ে হলে দোষী ব্যক্তির দশ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড দেওয়া হতে পারে। অর্ডিন্যান্সটিতে আরও বলা হয়েছে, এই ধরনের ধর্মান্তরণের প্রমাণ পাওয়া গেলে সেই বিয়ে বাতিল বলে বিবেচিত হবে। প্রসঙ্গত, ১৯৩৪ সালে নাৎসি জার্মানিতে ইহুদীদের সঙ্গে তথাকথিত এরিয়ান বা আর্য বংশোদ্ভূতদের বিয়ে ও যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রায় এই ধরনের একটি আইন আনা হয়েছিল। হিটলারের ওই আইনে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অনেক ইহুদীকে জেলে যেতে হয়েছিল। কারও মতে ওই বন্দিদের অনেকে শেষ পর্যন্ত হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রাণ হারান। এই যে লাভ জিহাদের খবর, যোগী সরকারের অধ্যাদেশ জারির খবর, এর পাশাপাশি কিন্তু আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে। গেরুয়াধারী আদিত্যনাথ, যিনি নিজেকে সন্ন্যাসী বলে দাবি করেন, তাঁর সরকারের আনা এই অর্ডিন্যান্সকে আদালত কার্যত সংবিধান বিরোধী বলে দিয়েছে। ইলাহাবাদ হাই কোর্টের মতে, দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি নিজেরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তাঁরা কে কোন ধর্মের, এই বিষয়ে পরিবার, রাষ্ট্র কেউই মাথা গলাতে পারে না। ভিন্ন ধর্মের বিয়ে নিয়ে একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতিরা বলেছেন, আমরা প্রিয়ঙ্কা খাড়োয়াড় এবং সালামত আনসারিকে হিন্দু-মুসলিম হিসেবে দেখছি না। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে দেখছি। তাঁরা দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজেদের ইচ্ছায় গত এক বছর ধরে শান্তিপূর্ণ ভাবে একসঙ্গে সুখে-শান্তিতে বাস করছেন। সংবিধান তাঁদের এই ব্যক্তি স্বাধীনতা দিয়েছে। রাষ্ট্র এর ভেতরে নাক গলাতে পারে না। আদালতের এই রায়ের পরেও কিন্তু যোগী আদিত্যনাথ সরকার এই ধরনের সম্পর্কে নাক গলাতে অর্ডিন্যান্স পাশ করিয়েছে। আরও একটা কথা। এরকম ভাবার কোনও কারণ নেই যে এই লাভ জিহাদ ব্যাপারটা যোগীর আবিষ্কার। মোটেই নয়। এটা আসলে বিজেপিরই অ্যাজেন্ডা। লাভ-জিহাদের আওয়াজ প্রথম তুলেছিলেন প্রাক্তন আরএসএস সদস্য, রামসেনা সংগঠনের প্রধান প্রমোদ মুথালিক। ২০০৭ সালে গুজরাটে। তারপরের ঘটনা ২০০৯ সালে কেরলে এবং কর্ণাটকে। নেতৃত্বে সেই প্রমোদ মুথালিক। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কয়েক মাস পরে, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আরএসএসের দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা অর্গানাইজার এবং পাঞ্চজন্যে দুটি কভারস্টোরি প্রকাশ করা হয় লাভ- জিহাদ নিয়ে। কভারস্টোরির নাম ছিল, ‘পেয়ার অন্ধা ইয়া ধান্ধা’? সিএএ-র সময়ই স্পষ্ট হয়েছিল, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন হিন্দুত্ববাদীরা। আদালতের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশ সহ বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে লাভ জিহাদ আইন পাশ করানোর উদ্যোগ দেখে আরও স্পষ্ট হচ্ছে, ভারতে পাকা-পোক্ত হয়ে উঠছে হিন্দু রাষ্ট্রের আদর্শ। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, আপনি কোনদিকে? ভারতের সংবিধান, যা হাজার হাজার মনুষের আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে জন্ম দিয়েছিল, সেই দিকে? না আপনি, যারা কখনও স্বাধীনতা আন্দোলন করেননি, আদালতের রায় দেখেও, আদালতের রায়-বিরোধী অর্ডিন্যান্স পাশ করিয়ে নিচ্ছেন শুধুমাত্র সংখ্যার জোরে, সেই দিকে? আপনি ঠিক করুন, আপনি কোন পক্ষে থাকবেন।