Written By দীপু গুহ
শুরুতেই শুভেচ্ছা জানাই শুভেন্দুবাবু। আবার দলবদলের জন্য। ফুটবলার আর আপনাদের তো পারফরমেন্সের ভিত্তিতে দলবদল হয়। দলবদলে ফুটবলারদের বাজার দর ঝালিয়ে নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। আপনিও নিশ্চিতভাবে সেটাই করলেন এবার। তাই তো? নাকি, অন্য কোনও কারনে - সে কি অাদৌ আপনি কখনো বলবেন? মনে বললেও মনে হয় না মুখে বলবেন। স্কিল সর্বস্ব পেশাদার ফুটবলারদের সঙ্গে দেখছি আপনার একটা বড় ফারাক। ওঁরা পেশাদার বলে ফেলা আসা দলকে ‘পচা’ দল অন্ততপক্ষে বলেন না। তাই তো মেসিরা মহান হন। শুভেন্দু- ক্ষমতার অধিকারের লিপ্সায় সেই কাঁথিরই ‘শুভেন্দু অধিকারী’ হয়েই হয়তো থেকে যাবেন।
শুভেন্দু ফুটবল ভালোবাসেন নিশ্চয়ই। তারকাদের ফুটবলারদের খেলা দেখেন কিনা জানি না। মেসিকে নিশ্চয় চেনেন। না চিনলে- এমন যুব নেতাকে জননেতা বলতে হোঁচট খেতাম। খাচ্ছি না। কারণ - উনি চেনেন। আচ্ছা, মেসিকে দেখেও কিছু শিখলেন না! ‘জাত ফুটবলার’ আর ‘জননেতার’ মধ্যে অদ্ভুত এক মিল আছে। প্রচূর ফ্যান ফলোয়ার। বার্সেলোনা আর মেসির সম্পর্ক কতো বছরের শুভেন্দু জানেন বলেই মনে হয়। মেসি বার্সায় পা রাখেন ২০০৪ য়ে। আজ ২০২০। ষোল বছর! ১৩ টি সিজন খেলেছেন। শুভেন্দু - বাবা শিশির বাবু'র সঙ্গে ১৯৯৮ সালে জাতীয় কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। ২২ বছরের সম্পর্ক ছিঁড়ে দলবদল করলেন। হয়তো মেসিও পরের বছর দলবদল করবেন। কিন্তু এইবছর তো ছাড়তে পারতেনই। মেসিকে দলে চেয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু মেসি শেষ পর্যন্ত চাননি। বার্সা ছাড়বেন জেনে মেসির সন্তানরা কান্নাকাটিও করে। তাঁর বাবা (যিনি মেসির ম্যানেজার বা এজেন্ট ) বার্সা ও অন্য ক্লাবের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে বোঝেন-লড়াই আদালতে গড়াবে। অনেক কাদা ঘাঁটাঘাঁটি হবে। মেসিকে বলেছিলেন, বার্সা ক্লাবের সঙ্গে এসব কি করতে চান? মেসি একরাত সময় নিয়ে ভেবেছিলেন। বুঝেছিলেন, নিজের অতীতকে কালি দিয়ে লেপা হবে-নিজের স্বার্থের জন্য। ক্লাবই তো তাঁকে আজকের এল এম -টেন বানিয়েছে। তাই সব কিছু যন্ত্রনা মেনে নিয়ে বার্সার হয়েই এখনও মাঠে নামছেন। সেরাটা দিচ্ছেন। হলফ করে বলতে পারি, মেসি কাল বা পরশু বার্সা ছেড়ে গেলেও মিডিয়ার সামনে বা খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে গলা ফাঁটিয়ে বলবেন না- বার্সা ‘পচে গেছে’।
এই প্রতিবেদন এই পর্যন্ত যাঁরা পড়লেন তাঁরা প্লিজ এই প্রতিবেদককে ক্ষমা করবেন। মহান মেসির পাশে ফেলে এই বাংলার এক রাজনীতির ব্যাপারিকে মাপার জন্য। মেসির মতন ১০% স্কিল বা মানসিকতা এই দেশের কোনও রাজনৈতিক নেতার-নেত্রীর নেই। নেই নৈতিকতা। উল্টে আছে, চাচা-আপন প্রাণ বাঁচা মানসিকতা। আহা - মেসির আদর্শটা কেন শুভেন্দু অনুসরণ করতে পারলেন না ? এর উত্তর কি এটাই, ‘ক্ষমতা চাই, আরও ক্ষমতা! ‘আরও বড় কেবিন চাই!’ ‘আরও স্যালুট চাই’। নাকি - সুদীপদা, মদনদা, তাপসদা বা কুনাল হতে চাননা! শুভেন্দু নিজের সঙ্গে একা কিছু সময় কাটিয়ে হয়তো এর উত্তর এরই মধ্যে পেয়ে গেছেন। আরও কিছু উত্তর হয়তো বাকি।
বিজেপিতে যোগ দিয়ে সমস্ত জল্পনার অবসান যেমন ঘটালেন নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী, তেমনি জন্ম দিলেন আরেক নয়া বিতর্কের । শনিবারের বারবেলা পেরিয়ে গেরুয়া শিবিরে যোগ দিলেও এই যোগাযোগের সূত্রপাত হয়েছিল কয়েক বছর আগেই। সেকথা নিজেই স্বীকার করে বসলেন শুভেন্দু। চার বছর আগে আলোচনার টেবিলে শুভেন্দু বসেছিলেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহার সঙ্গেও। কেন? কিসের জন্য সেদিন দিল্লিতে অমিত শাহকে ‘মিট’ করেছিলেন। কোন ‘ডিল’ নিয়ে ‘সেটিং’ ছিল? সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় মাথা নোয়াননি। তাপস পাল, মদন মিত্রও তা করেননি। কুনালও নন। ইডি’র ডাকে শুভেন্দুকে কেন যেতে হয়েছিল? কেন বড় বিপদ বুঝে মুকুল একূল ছেড়ে ও-কূল গেলেন? শুভেন্দু শনিবার মঞ্চ থেকে মুকুলের ডাকের কথা শোনালেন। এ তো সেই ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’! তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে মুকুলের মতো শুভেন্দু যাদের তোলাবাজ আজ বলছেন, তিনি তাদের চেয়েও বড় ‘বাজপাখি’।
লক্ষ্মণ শেঠের পর ওই এলাকায় দশকের বেশি সময় ধরে রাজ করেছেন শুভেন্দু। আমার এক অতি ঘনিষ্ঠ এক পারিবারিক বন্ধু ‘যথাযথ আর্থিক ভেট’ দিতে না পারায়, মেদিনীপুরের এক পুরসভার চেয়ারম্যান হতে পারেননি। অথচ যোগ্য ব্যাক্তি তিনিই ছিলেন। পরে ভাইস চেয়ারম্যান হলেন। কিন্তু শুভেন্দু’র কোর কর্মীই হলেন রিমোট কন্ট্রোলার। টেন্ডার প্ল্যানিং থেকে সাফাই কর্মী নিয়োগ, সেই কুর্তা -কর্তাটিই ঠিক করতেন।
আরও আছে। শুভেন্দু পরিবহন দফতরে বসতেই সিএসটি সিআরসিটিসিতে কন্ট্রাকচুয়াল কর্মীদের (কন্ডাক্টরদের) পদে ঢোকালেন এক ঝাঁক অভাবী (?) পরিবারের তাঁর ক্যাডারদের। এমনকি রাজ্যের অধিকাংশ জেলায় জল পরিবহন নিগমে তাজা তরুণ মুখের ভিড়। অধিকাংশই মেদিনীপুরের। একসময় রেল মন্ত্রী হয়ে গনি সাহেব গোটা রাজ্যে অনেকের চাকরি করে দিয়েছিলেন বলে শুনে এসেছি। তা শুধুমাত্র মালদা বা উত্তরবঙ্গে আটকে থাকেনি। যাই হোক, শুভেন্দু কয়েকটি পরিবারের জন্য তো করেছিলেন। আচ্ছা, এই ‘পচা’ দলটির মন্ত্রীমশাই না হলে তিনি কি এসব করতে পারতেন? উত্তর শুভেন্দু জানেন। আচ্ছা, এই কন্ট্রাকচুয়াল কর্মী ভাইদের এরপর ভবিষ্যৎ কী? সে উত্তরও শুভেন্দুই দিতে পারবেন। কিন্তু এঁদের জন্য তিনি একবারও ভাবলেন না! দলটাকেই ছাড়তে হল? কিন্তু এসব কর্মী নিয়োগ নিয়ে ‘পচা’ দলের কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন? তোলা উচিৎ ছিল। উত্তরটা- শুভেন্দু জানেন।
পরিবহন মন্ত্রী হয়ে শেষ পর্যায়ে কলকাতা ময়দানে দফতরের বিলাস বহুল তাঁবুতে (তাঁর নির্দেশে যা সত্যি দারুণ এক তাঁবু-বাগান নিয়ে সেজে ওঠে) বসে ফাইলে সই করতেন। বলতেন, করোনা মুক্ত হয়ে কাজ থেকে ছুটি নেননি- বাকি কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা ভেবেই নাকি এই ব্যবস্থা। সত্যি? নাকি সেই সময় দর কষাকষির খেলা ময়দানে বসে খেলতে আনন্দ পাচ্ছিলেন।
শুভেন্দুবাবু তো এখন একের পর এক সভা সারবেন। প্লিজ এইসব সভাতে বলবেন কি- কোন কোন কাজ আপনাকে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী করতে দেননি। আর কোন কোন কাজ আপনি বিনা অনুমতি নিয়ে করে নিয়েছেন। আচ্ছা, সব সরকার চাকরির সুযোগ দেখলেই স্বজন-পোষণ করে। এই ‘পচা’ দলও নিশ্চয় করেছে। শুভেন্দুবাবু- আপনি ‘পচন’ রুখতে কি সচেষ্ট ছিলেন?
সূত্র বলছে, ‘পচা’ দলের কাউকে-কাউকে তোলাবাজ বলেছেন আপনি। তোলাবাজের সংজ্ঞা কী? ‘বাজপাখীর নিশানায় খাওয়ার তুলে নিয়ে যাওয়া’? - এটা যদি তোলাবাজের সংজ্ঞা হয়, তাহলে কতো খিদে থাকতে পারে এসব বাজপাখীর? বিরামহীন হয়তো। তাই দলবদল করতে হয়।
লেখক-গায়ক নচিকেতাও এই ‘পচা’ দলের সৈনিক। একটা গান ওঁর সেই কবে গাওয়া। কাঁথি থুড়ি মেদিনীপুরের অধিকারী বাড়ির রাজনৈতিক কুশি-লবদের দেখে এতো দিন গানটা মনে কিছু করাতো না। আজ করছে। হঠাৎ শুনতে মন চাইলো গানটা। এক বাবার ছেলেকে ডাক্তার -উকিল না বানিয়ে মন্ত্রী বানানোর ইচ্ছের সে গান। সেখানে দুটি লাইন আছে, ‘...আগে থেকে সবকিছু রিহার্সাল করে রাখবো; দরকার হলে প্রাইভেট টিউটর এক্স মন্ত্রী রাখবো’। শুভেন্দু নচিকেতাতে আর হলদিয়া উৎসবে গানের আমন্ত্রণ জানাবেন? নাকি....