Written By কৌশিক মাইতি
বাঙালি কি অন্য রাজ্যে রাজ্য সরকারি চাকরি পায়? অন্য রাজ্যে পিএসসিতে কি চাকরি পাওয়া সম্ভব বাঙালির? অন্য রাজ্য থেকে কেউ এসে বাংলায় WBCS বা WBPS হতে পারে?
অধিকাংশ বড় পদের রাজ্য সরকারি অফিসার ও কর্মচারী নিয়োগ হয় পিএসসি’র (Public Service Commission)মাধ্যমে। এই অফিসার ও কর্মচারীরাই অনেক ক্ষেত্রেই রাজ্যের নীতি নির্ধারণে সক্রিয় ভূমিকা নেয় এবং বাংলার মানুষকে পরিষেবা দেন এনারাই। UPSC র মাধ্যমে IAS, IPS হওয়া এখন বাঙালি সহ অহিন্দি জাতিগুলোর কাছে অলীক স্বপ্ন, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ অহিন্দি জাতির স্বপ্ন ধ্বংস করছে। UPSC র প্রিলিমস হিন্দি-ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ভাষায় দেওয়ার সুযোগ নেই, অর্থাৎ বাঙালি ছেলেমেয়েদের ইংরেজিতে পরীক্ষা দিতে হয়, আর হিন্দিভাষীরা নিজেদের মাতৃভাষায় পরীক্ষা দেয়। গতবছর ৮১২ জন UPSC পাশ করেছে, যারা নানা রাজ্য সহ সারা ভারতের নীতি নির্ধারণ করবে, তাদের ৪৮৫ জন হিন্দি মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রী। এছাড়া ইংরেজি মাধ্যমে পড়া হিন্দি-ঊর্দুভাষী ছাত্র-ছাত্রী আছে অনেক। মানে বাঙালি আইএএস, আইপিএস হতে পারবে না, শুধু বাঙালি না প্রায় প্রতিটা অহিন্দি জাতির ভবিষ্যৎ এভাবে ধ্বংস করেছে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ।
আইএএস-আইপিএস হতে পারবে না বাঙালি, কিন্তু WBCS-WBPS বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করতে পারে বাঙালি। এগুলো আমাদের নিজস্ব চাকরি, আমাদের রাজ্য সরকারি চাকরি। IAS-IPS রা বহিরাগত(মূলত উত্তর ভারতীয়) হওয়ায় তাঁরা বেশিরভাগই বাঙালি বিদ্বেষী, তাঁরা বাংলা ও বাঙালির স্বার্থ বিরোধী কাজ করে। নানা চাকরিতে বিহার-ঝাড়খণ্ড-উত্তর প্রদেশ থেকে ছেলেমেয়ে ঢোকায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা না থাকায় আমাদের রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীরা এসব খেয়াল রাখেন না, তাঁরা এসব নিয়ে ভাবেনও না৷ ফলে বাঙালি বিরোধী IAS-IPS চক্র সহজেই বাঙালির ক্ষতি করতে পারে।
IAS-IPS আমাদের হাতে নেই। কিন্তু আমাদের এলাকার বিডিও কি বিহার থেকে আসা কোনো বাঙালি বিদ্বেষী হবে? বাংলার কৃষকদের স্বার্থ দেখবে উত্তর প্রদেশ থেকে এসে WBCS পাশ করা কোনো কৃষি আধিকারিক? বিডিও অফিস বা অন্যান্য সরকারি অফিসে গিয়ে হিন্দি-ঊর্দুতে কথা বলবে বাঙালি সহ রাজ্যের সকল ভূমিপুত্র? তাঁরা বাঙালির কষ্ট বুঝবে? বাংলার মাটি তাঁরা চেনে?
এটা পরিষেবার প্রশ্ন, রাজ্যের ভূমিপুত্রদের স্বার্থের প্রশ্ন। বাঙালি সহ কোনো ভূমিপুত্রকে বঞ্চিত করা চলবে না। বাংলা ভাষার ভিত্তিতে তৈরি রাজ্য, বাংলায় ৮৬% বাঙালি (২০১১ র আদমশুমারি অনুযায়ী), এ রাজ্যের মূল সরকারি ভাষা বাংলা।
বাংলায় পিএসসির নানা পরীক্ষা বাংলা, হিন্দি, ঊর্দু, সাঁওতালি ও নেপালী সহ নানা ভাষায় দেওয়া যায়, অর্থাৎ বাংলা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক না। ফলে বিহার বা ইউপি থেকে এসে কেউ বাংলায় WBCS অফিসার হয়ে বাঙালিকে শাসন করতে পারে। গত বছর ডব্লুবিসিএস পরীক্ষায় ষষ্ঠ হয়েছেন বিহারের এক হিন্দিভাষী। যে কেউ এসে বাংলায় বড় বড় চাকরি দখল করতে পারে৷ কিন্তু বাঙালি কি অন্য রাজ্যের সরকারি চাকরি পায়? অন্য সব রাজ্যের সরকার যে রাজ্যের মানুষের স্বার্থ দেখে, ভূমিপুত্রদের পক্ষে সব রাজনৈতিক দল। সব রাজ্যেই পিএসসি পরীক্ষায় সে রাজ্যের মূল সরকারি ভাষায় ১০০ বা ১৫০ নম্বরের পেপার বাধ্যতামূলক আছে। যে রাজ্য থেকে এসে বাংলায় চাকরি-কাজ-এলাকা-মাটি দখল করছে, সেই বিহারে পিএসসিতে ১০০ নম্বরের বাধ্যতামূলক হিন্দি পেপার আছে। বাঙালি বিহারে চাকরি পায় না, পাবেও না। মহারাষ্ট্রে ১০০ নম্বরের মারাঠি, কর্ণাটকে ১৫০ নম্বরের কন্নড় পেপার বাধ্যতামূলক৷ অন্ধ্রপ্রদেশে তো আবার আইন করে ভূমিপুত্র সংরক্ষণ হয়ে গেছে সরকারি ও বেসরকারি সব চাকরিতে৷ পাশের রাজ্য ওড়িশা ও বাম শাসিত কেরালায় পিএসসির পরীক্ষায় বসতে গেলে যথাক্রমে ওড়িয়া ও মালয়ালম মাধ্যমে পড়াশোনা করতে হবে বা মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে একটা বিষয় হিসাবে ওড়িয়া ও মালয়ালম থাকতেই হবে। বুঝতেই পারছেন, অন্যান্য রাজ্য থেকে গিয়ে এইসব রাজ্যে কেউ চাকরি দখল করতে পারবে না। তামিলনাড়ুতে রাজ্য সরকারি চাকরির কথা অন্য রাজ্যের কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, তামিলনাড়ুর প্রতিটা দল তামিল জাতির স্বার্থ দেখে, কারণ তামিলরা সচেতন। এবার আসি মহান রাজ্য গুজরাটের কথায়। আপনাকে গুজরাটিরা শেখায় বাংলা বাংলা বা বাঙালি বাঙালি কোরো না, এগুলো প্রাদেশিকতা, আগে ভারতীয় হও। তাঁরা আবার এক সপ্তাহে ৫০ হাজার বিহারীকে বিহারে ফেরত পাঠিয়ে দেয়, কেউ প্রাদেশিকতা বা উগ্র জাতিবাদ বলে হাউকাউ করে না, কারণ তাঁরা গুজরাটি। ভারত স্বাধীন করা বাঙালিকে রাষ্ট্রপ্রেমের শিক্ষা দেওয়া গুজরাটি শাসকদের গুজরাটে পিএসসি মেইনস পরীক্ষায় ১৫০ নম্বরের গুজরাটি পেপার বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ আপনাকে বোকা বানিয়ে তাঁরা নিজেদের স্বার্থ গুছিয়ে নেয়। আর আপনি নিজের অধিকার ভুলে দুহাত তুলে নৃত্য করেন, আপনার মাথায় বেল ভেঙে খায় হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীরা। বাঙালি ছেলেমেয়েরা অন্য রাজ্যে চাকরি পায় না, পাওয়া সম্ভবও না। সর্বোপরি বাঙালি সহ সকল ভূমিপুত্ররা নিজের রাজ্যেই বঞ্চিত, বাধ্যতামূলক বাংলা বা সাঁওতালি পেপার না থাকায়। গত সত্তর বছর ধরে আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে আমাদের রাজ্য সরকার, এটা লজ্জার। শাসক দল বদলেছে, কিন্তু বাংলার ভূমিপুত্রদের স্বার্থ কেউ দেখেনি। নেতা-মন্ত্রীরা যাদের ভোটে নির্বাচিত, তাঁদের কথাই ভাবে না, সে চেতনাই নেই। অন্যান্য সব রাজ্যে এক নিয়ম, কিন্তু বাংলায় আলাদা। সব রাজ্যে এক নিয়ম চলে, বাংলায় তা চলে না কেন? বাংলা কি ধর্মশালা? বাংলা কি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র? অন্যান্য রাজ্যের মতো এখানে একই নিয়ম নেই কেন?
নিজের মাটিতে বাঙালি এভাবে কতদিন বঞ্চিত হবে? লাখ লাখ ভূমি সন্তানের ভবিষ্যতের স্বার্থে, রাজ্যে সরকারি পরিষেবার স্বার্থে, সর্বোপরি বাংলা ও বাঙালির স্বার্থে বাংলায় পিএসসির সব পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের বাংলা/সাঁওতালি পেপার বাধ্যতামূলক চাই। এটা সকল ভূমিপুত্রের দাবি, এটা বাংলার দাবি, এটা সময়ের দাবি। এই দাবি ঝড়ে পরিণত হচ্ছে, বাংলার চাকরি প্রার্থীরা ক্ষোভে ফুঁসছেন। রাজ্য সরকার বাংলার মানুষের স্বার্থে, রাজ্যের স্বার্থে পিএসসির সব পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের বাংলা পেপার বাধ্যতামূলক করুক, না হলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।