Written By রাহুল মজুমদার
অপলক দৃষ্টিতে সাদা কালো রঙের যুবক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সল্ট লেকের বাসিন্দা প্রবীরবাবু। সত্তরোর্ধ ওই বৃদ্ধ এক মনে দেখছেন তা। অনেকক্ষণ ধরে,প্রায় অপলকভাবে। চোখে মুগ্ধতার সঙ্গে যা লেগে রয়েছে সাদা বাংলায় তাকে বলে ভক্তি। ‘ইশ্বর’-কে যেভাবে ভক্ত দেখে,অনেকটা সেরকম। একমনে দেখেই যাচ্ছে দেখে কৌতূহলী হয়েই আলাপ করলাম।
তখন আলতো পায়ে সন্ধ্যে নেমেছে নন্দন চত্বরে। গিজগিজে না হলেও জমজমাট ২৬তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এবারের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অন্যান্যবারের মতো না হলেও উৎসবের মান কিন্তু এতটুকু কমেনি। তবে এই আলো,আনন্দ মাখা উৎসবে কোথাও যেন ছুঁয়ে রয়েছে ' তাঁর ' না থাকার বিষাদের সুর। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর গলাতেও শোনা গেছিল একই সুরে,' খানিক আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনতে শুনতে মন ভালো হয়ে গেছিল কিন্তু এরপরেই সৌমিত্রবাবুর ক্লিপিংস দেখার সময়ই মন ভার হয়ে যায়। ' আর হবে নাই বা কেন 'সৌমিত্র' মানে তো শুধুই সিনেমার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা একটি চরিত্র নয়,তার সঙ্গে আরও অনেককিছু। বাঙালির আবেগ। সদ্যপ্রয়াত এই কিংবদন্তি অভিনেতার স্মৃতি যেন রোলের গায়ে মোড়া সাদা কাগজের মতো মোলায়েম করে জড়িয়ে রেখেছে ফিল্ম উৎসবকে। চলে যাওয়াও কত রোম্যান্টিক হতে পারে!
গগনেন্দ্র প্রদর্শনীশালাকে ডান হাতে রেখে একটু এগিয়ে ফের একবার ডান দিক ফিরতেই পাওয়া গেল বরাবরের সেই চেনা দৃশ্য। আলোয় মুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নন্দন। বিখ্যাত চত্বরটা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মূল দরজার সামান্য আগে টিকিট ঘরকে বাঁ পাশে পাশ কাটিয়ে গেলেই চোখে পড়বে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রদর্শনীর গেট। পেরোলাম। আর ঢুকতেই ফের চেনা সৌমিত্র ম্যাজিক। 'নন্দন -২ ' প্রেক্ষাগৃহ যাওয়ার গোটা প্যাসেজটাই এককথায় হয়ে উঠেছে ' সৌমিত্রময় '। দু'পাশের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে তাঁর নানান সাইজের ছবির কাট আউট। কোনওটায় তিনি ' উদয়ন পন্ডিত',কোনওটায় ' ফেলুদা ' আবার কোনওটায় বা ' অমল '। আবার এক কোণে ধরা দিয়েছেন ' রাজা লিয়র ' এর সাজে। একরাশ মুগ্ধতা আর আচ্ছন্নতা নিয়ে ঘাড় সামান্য হেলাতেই চোখ আটকে যাবে ' বেলাশেষে '-র বিশ্বনাথ মজুমদারের দিকে। বরাবরের মতো ধন্দ লাগবে ' এঁরা ' কি সব একই ব্যক্তি না কি.... শুধু তাই নয়, রয়েছে দেওয়াল জুড়ে টিভিও । সেখানে অবিরামভাবে চলছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মঞ্চ অভিনয়ের বিখ্যাত সব সিকোয়েন্সের ‘ক্লাসিক’ মুহূর্তগুলো । বিস্ময়ের আমেজ আরও ঘন হবে যখন কানে এসে পৌছবে প্রয়াত এই কিংবদন্তির সেই জলদমন্দ্র গলার স্বর। মিউজিক সিস্টেম থেকে অক্লান্ত ভাবে ভেসে আসছে তাঁর আবৃত্তি করা বিভিন্ন সব কবিতা,কখনও বা ছবির বিখ্যাত কিছু সংলাপ। প্যাসেজের নীলচে-সাদা আলো এবং সেই বিখ্যাত গলার নিটোল উচ্চারণ শুনে মনেই হতে পারে নিজেকে কবিতা কিংবা স্বপ্নের কাছাকাছি কোনও অংশ।
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে পারতো যদি তিনি সৌমিত্র না হতেন। ছবির পাশাপাশি 'মঞ্চাভিনেতা ' সৌমিত্রর নজির বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে নিভৃতে,নিশ্চুপ হয়ে। আলো ছায়ার কাটাকুটির নিচে হ্যাঙ্গারে সগর্বে টাঙানো প্রয়াত অভিনেতার মঞ্চ জীবনের অভিনীত কিছু সেরা নাটকের চরিত্রের পোষাক। রয়েছে ' রাজা লিয়ের '-এর সেই কুচকুচে কালো জোব্বা ও শিরস্ত্রাণ,পাশেই ' হোমাপাখি '-র সেই লাল রঙের পোলো স্ট্রাইপড টি-শার্ট। তাদের যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে 'কালমৃগয়া '-র সেই রঙিন তাপ্পি লাগানো আলখাল্লা ও ' নীলকন্ঠ '-র ধুতি পাঞ্জাবি। চোখ টানে, ' রাজা লিয়র ' এর ফাঁকা রাজ সিংহাসনখানাও।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এসব দেখছি এমন সময় কানে এল দুই তরুণ-তরুণীর নিচু স্বরে কথোপকথন। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়া সেই জুটি যে পরস্পরের ভালোবাসার মানুষ তা বুঝতে সময় লাগলো কয়েক সেকেন্ডের একটু বেশি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই তরুণী একদৃষ্টে সাদা কালো যুবক সৌমিত্রর হাসিমুখের ছবির দিকে তাকিয়ে প্রেমিকের প্রতি ছদ্ম আফসোস, ' আমার দিকে একটু এরকম করে তাকিয়েও তো হাসতে পারিস। ' খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কাঁচুমাচু স্বরে প্রেমিকের জবাব,' সম্ভব না রে। কারণ আমার নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নয়!' বুঝলাম ছয় সাতের দশকের তরুণ-তরুণীদের মনে ট্যুইস্ট এর মৌতাত ধরিয়ে দেওয়ার কাজটা আজ এত বছর পরেও নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে ধরানোর কারিগরিতে তিনি একইভাবে পটু। জীবনের মঞ্চ থেকে বিদায় নেওয়ার পরেও। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম কবি ও শিল্পী সৌমিত্রর নানান কবিতাগুচ্ছের কোলাজ ও বিভিন্ন আঁকার ফ্রেম আটকে থেকে দেওয়ালের সৌন্দর্য্য বাড়াচ্ছে স্বমহিমায়। পায়ে পায়ে এগোলাম সেদিকে। পিছন থেকে নিরলসভাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘পারফর্ম’ করে যাচ্ছেন অবিচলিতভাবে।
ফের ফেরা যাক শুরুতে। আমার প্রশ্নের জবাবে সল্ট লেকের বাসিন্দা প্রবীরবাবু চশমা ঠিক করে নরম স্বরে জানালেন তাঁর বাংলা সিনেমার প্রতি ভালোবাসার মূল কারণের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছোট্টবেলার নায়ককে দেখে ট্যুইস্ট নকল করা থেকে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘এক্ষণ’ গোগ্রাসে গিলতেন একসময়। ছোট্ট অথচ দৃঢ়ভাবে জানালেন, ' যেদিন উনি চলে গেলেন অসুস্থ শরীর নিয়েও শশ্মান গেছিলাম। আজও এসেছি।’ আলতো হেসে বললেন, ‘ ঈশ্বরের প্রতি একটা কর্তব্য থাকে তো নাকি! '
এবারের চলচ্চিত্র উৎসব ‘ইশ্বরময় !’