Written By সম্পাদক
২৫ ডিসেম্বর পরধান সেভক একটা বোতাম টিপে, ৯ কোটি কৃষককে ১৮ হাজার কোটি টাকা পাঠিয়ে দিলেন, বা বলা ভাল পাঠিয়ে দেওয়া হল ঘোষণা করলেন, সেদিন ছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিন। এই সরকার, মানে মোদী সরকারের এক বৈশিষ্ট্য হল, যা করেন, যে ঘোষণাই করেন, তার পুরোটাই নির্বাচনকে মাথায় রেখে, ভোট ব্যাঙ্ককে মাথায় রেখে। স্বভাবতই এই অনুষ্ঠান করা হল এই সময়কে মাথায় রেখে, যখন দুটো ঘটনা সমান্তরাল ভাবে ঘটে যাচ্ছে। প্রথমত দেশ জুড়ে কৃষক আন্দোলন, কৃষি বিল বাতিল করার দাবি তুলে লক্ষ লক্ষ কৃষক রাজপথে, দ্বিতীয়ত সামনে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন, বাংলা আমার চাই, বলেছেন অমিত শাহ। তো দুটো বিষয়কে মাথায় রেখেই প্রধানমন্ত্রী মাঠে নামলেন, আসবেন বোতাম টিপবেন, কৃষকরা টাকা পাবে, তিনি চলে যাবেন। চিত্রনাট্যটা তো এমন নয়। তিনি মধ্যে ভাষণ দেবেন, মিত্রোঁ। সেটাই আসল। তা প্রথমেই তিনি যে কৃষকের কত বড় বন্ধু, তার ব্যাখ্যা দিলেন, বললেন, এই কৃষিবিল লাগু হলে দেশের কৃষকদের কায়া পলট হয়ে যাবে, কৃষিতে বিরাট উন্নতি, ভোলাভালা কৃষকদের ভুল বোঝানো হচ্ছে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। মানে যে কৃষকরা ফসল ফলায়, আমাদের অন্ন যোগায়, যে অর্থনীতিকে ভাগাড়ে এনে দাঁড় করিয়েছেন মোদীজি, সেই অর্থনীতিতেও একমাত্র পজিটিভ গ্রোথ দেশের কৃষিক্ষেত্রের, সেই কৃষকরা নির্বোধ, অবোধ, তাঁরা কিছুই বোঝে না, যা বোঝার উনিই বোঝেন। এসব বলার পরেই তিনি পড়লেন পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে, আহা হা কত ভাল এই পিএম কিসান সম্মান যোজনা, কিন্তু পচ্ছিম বংগাল এর কৃষকরা এর সুবিধে পাচ্ছে না, আমি এত টাকা দেবার চেষ্টা করছি, মমতা দিদি, তা বংগাল কা কৃষকদের হাতে তুলে দিতে চান না, সামনে বাংলার নির্বাচন, উনি নির্বাচনে নেমে পড়লেন।
এই পি এম কিসান সম্মান যোজনাটা কি বস্তু? কৃষকদের একটা বড় অংশ, যাদের নামে কৃষি জমি আছে, তাঁরা ছোট বা প্রান্তিক চাষি, তাঁরা অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারি কর্মচারি নন, তাঁদের ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয় না, তাদের ১০০০০ টাকার বেশি পেনশন নেই, এইরকম লোকজন বছরে ৬০০০ করে টাকা পাবে, ২০০০ টাকা করে তিনটে কিস্তিতে। তো এর টাকা কোথা থেকে আসবে? পার্লিয়ামেন্ট এ তো ধান চাষ হয় না, শিল্প উদ্যোগও নেই। মানুষ ট্যাক্স দেয়, সেখান থেকে, রাজ্য থেকে জিএসটি পাওয়া যায়, পেট্রল ডিজেল থেকে এক্সাইজ ডিউটি পাওয়া যায়, সেই টাকা থেকে এইপি এম কিসান এর টাকা জোগানো হয়। তো পশ্চিমবঙ্গ সরকার বলেছিল, কৃষি তো রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত, টাকা পাঠান, আমরা বিতরণ করবো, আমাদের এখানে কৃষকরা নাম লেখান, আমরা বাছাই করে নিতে পারবো, যাতে সঠিক জায়গায় টাকা পৌঁছয়, যাতে সত্যিকারের যাদের এই টাকা পাওয়া উচিত, তাঁরা যেন পায়। কৃষক আমাদের রাজ্যে থাকে, যাচাই করবে কেন্দ্রীয় সরকার, তাও আবার কৃষি বিষয়ে, এ মানা যায় না। আটকে রইল, পড়ে রইল, প্রশ্নের জবাব নেই, বন্ধ রইল টাকা দেওয়া। এতদিন পর নির্বাচন দুয়ারে, তাঁরা ইস্যুটা গুছিয়ে রেখে দিয়েছিলেন, এবার মাঠে নেমেছেন। রাজ্য সরকার সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিলেন, বেশ, আপনারাই দিন, অন্তত রাজ্যের কৃষকরা টাকাটা পাক। প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, দেখা যাক কতদিনে এ টাকা পায় বাংলার কৃষক।
এদিকে এই মহান প্রকল্পের ঢাক ফেটেছে, এক দুষ্টু লোক আরটিআই করে জানতে চেয়েছিল, কী অবস্থা এই প্রকল্পের? কারা টাকা পাচ্ছেন? কত টাকা পেলেন? তার জবাবে কৃষি মন্ত্রকের যে জবাব এসেছে, তা দেখে শুনে তো কপালে হাত পড়বে, এও তো এক স্ক্যাম, পিএম কিসান যোজনার নাম করে কাদের হাতে টাকা তুলে দেওয়া হচ্ছে? তারা কারা? কিভাবে জালিয়াত, জোচ্চররা টাকা পাচ্ছেন? কেন তাদের তালিকা যাচাই করা গেলো না। প্রকল্প শুরুর সময়েই এই কথাটাই তো তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন, বলেছিলেন, নাম রেজিস্ট্রেশনটা রাজ্যের মাধ্যমে হোক, এই জাল জোচ্চুরি আটকানোর জন্যই এই কথা বলেছিলেন, এখন দেখা যাচ্ছে, এক আধ কোটি নয়, পুকুর চুরি হয়েছে, চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে।
প্রথম চুরিটা অবশ্য ধরা পড়েছে ক’দিন আগে তামিলনাড়ুতে, তখন কোভিড নিয়ে ব্যস্ত ছিল সরকার, মানুষজন। সেই সময়ে কৃষি আধিকারিকের কাছে এক হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ আসে, সেখানে লেখা ছিল, পিএম কিসান নিয়ে দুর্নীতি চলছে, নজর দিন। মিথ্যে তালিকা তৈরি করে কিছু লোকজনকে টাকা পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে, দেখুন। ৬ আগস্ট এই মেসেজ পাওয়ার পরেই ওই কৃষি আধিকারিক, ওই অতিমারীর মধ্যেও কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়েব সাইট থেকে তথ্য নিয়ে যাঁচ পড়তাল শুরু করেন, এপ্রিল জুলাইয়ের তালিকা যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেলো, মার্চের ২ লক্ষ কৃষকের জায়গায় জুলাইয়ে ৬ লক্ষ কৃষকের নাম রেজিসস্ট্রেশন হয়েছে, ৪ লক্ষ বেশি, আরও তলিয়ে দেখা গেলো, মোট ৫.৫১ লক্ষ ভুয়ো বা যাদের এই টাকা পাবার যোগ্যতাই নেই, তেমন কৃষকদের নাম এই তালিকায় ঢোকানো আছে, এদিকে কেন্দ্র সরকারের ব্যবস্থা মত এই তালিকা তাঁরাই তৈরি করছেন, তাঁরাই ঝাড়াই বাছাই করছেন, তাঁরাই টাকা পাঠাচ্ছেন, তাজ্য কৃষি আধিকারিকদের তাঁরা কোনও দায়িত্ব দেননি, অথচ একটা রাজ্যেই পাওয়া গেলো ৫.৫১ লক্ষ ভুয়ো প্রাপক, যারা মোট ১১০ কোটি টাকা পেয়েছেন। কার টাকা? চা বিক্রি করে বা কুমির শিকার করে তো এ টাকা আসেনি? এ টাকা আমার আপনার, সে টাকা নয় ছয় হচ্ছে, কে করছেন? দেশের প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী, তাঁর নামেই এই প্রকল্প, সেই প্রকল্পের নামেই চলছে লুঠমার। কেমন করে? গ্রামে গ্রামে কিছু লোকজন যাচ্ছেন, কম্পিউটার ল্যাপটপ নিয়ে, তাঁরা রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দেবেন, লোকাল নেতারাও থাকছেন, কৃষকরা তাঁদের কাগজ নিয়ে আসছেন, ব্যাস আর কি চাই, যেমন ইচ্ছে তেমন ফর্ম ভরা হচ্ছে, শাসকদলের এমএলএ, মন্ত্রীর দেখ রেখেই এই ভুয়ো বিতরণ চলছে, প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে বোতাম টিপছেন, এখানে ভুয়ো প্রাপকদের অ্যাকাউন্টে টাকা, জয় শ্রী রাম। সম্ভবত সেই কারণেই তাঁরা এই রেজিস্ট্রেশন রাজ্যের হাতে দিতে রাজি নন, দেশ জুড়ে এরকম লুঠমার চলে থাকতে পারে ভেবে একজন, বড্ড দুষ্টু লোক একটা আরটিআই করলেন, বেরিয়ে এসেছে আরও অনেকটা সত্য, দুর্নীতির আরও অনেকটা বড় চেহারা, কিন্তু আমি নিশ্চিত, আরও বড় দুর্নীতি আছে, সময়ে তাও বের হবে। আপাতত আরটিআইয়ের ফলে যা বেরিয়ে এল, তা দেখা যাক। পঞ্জাবে ২৩ %, মহারাষ্ট্রে ১৭%, অসমে ১৪%, গুজরাটে ৮%, উত্তরপ্রদেশেও ৮% এমন অ্যাকাউন্টে টাকা গেছে, যা হয় ভুয়ো, না হলে সেই কৃষকরা এই টাকা পেতে পারেন না। ২০ লক্ষ এমন মানুষকে এই টাকা দেওয়া হয়েছে, যারা ইনকাম ট্যাক্স দেন, সেই অর্থের পরিমাণ, ১৩৬৪ কোটি টাকা।
সর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে থাকে, আছেও। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা এগুলো জানতেন, বুঝতেন। তাই আলাদা দায়িত্বের তালিকা করা হয়েছিল, কেন্দ্র সরকারের তালিকা, রাজ্যের তালিকা আর যুগ্ম তালিকা। তাঁরা জানতেন পঞ্জাব বা তামিলনাড়ূর কৃষি আধিকারিক, পুন্ডরিকাক্ষ পুরকায়স্থকে খোঁজার আগেই দাঁত হারিয়ে ফেলবেন, তাই কৃষি, যেখানে কৃষকদের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ দরকার, যেখানে মাটি, জল বা বৃষ্টির ভিন্নতায় আলাদা আলাদা ফসল হয়, সেখানে কৃষি রাজ্যের হাতেই থাকা উচিত, এই সরকার তা চায় না। সংবিধান প্রণেতারা জানতেন যে পাগলা ইয়াসিন আলি, যতই চিৎকার করুক, “বোম মেরে উড়িয়ে দেবো”, তার কথা কানেও নেবে না প্রাণকেষ্ট দারোগা। কিন্তু দিল্লির এনআইএ’র কর্তা কুলভূষণ সিং, পাগলা ইয়াসিন আলিকে ইউএপিএতে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে, সেই জন্যেই আইন শৃঙ্খলাকে রাজ্য তালিকায় রাখা হয়েছে, যদি কোনও কর্তা দিল্লি থেকে এসে এখানকার কাউকে গ্রেফতার করতেও চায়, তাহলেও তাকে লোকাল অফিসার মানে ওই প্রাণকেষ্ট দারোগার সঙ্গে কথা বলতে হবে, কিন্তু কেন্দ্র সরকার চায় না। বিজেপি আদর্শগত ভাবেই এই ফেডারেল স্ট্রাকচারের বিরুদ্ধে, তাই তারা সবই নিয়ে যেতে চায় তাদের অধিকারের আওতায়, ফলে এনআইএ জন্ম অবধি এক পাগলকে ধরে নিয়ে যায় দেশদ্রোহী, আলকায়দা বলে, আর পাগল সেখানে কেবল খেতে চায়, হাত পা নাড়িয়ে বোঝায়, তার খিদে পেয়েছে। ঠিক সেই কারণেই কৃষক রেজিস্ট্রেশন নিজেরা করতে গিয়ে মানুষের হাজার কোটি টাকা উবে যায়, ভুয়ো তালিকায় দেশের টাকা চলে যায়, যা উদ্ধার করা অসম্ভব।
পরিকল্পনাটা দারুন, আমরা টাকা দিচ্ছি, পিএম টাকা দিচ্ছে, নরেন্দ্রভাই টাকা দিচ্ছে, কেন্দ্র সরকার টাকা দিচ্ছে, নাম লেখান, ভুয়ো অ্যাকাউন্টে টাকা চলে যাবে, কারা পাবে জানা কথা, সত্যি জরুরি যাদের কাছে তারা টাকা না পেলে বলেই দেওয়া যায়, ওই যে রাজ্য সরকার, তারা দায়ী। ল্যাটা চুকে গেলো।
পিএম কিসানের দুর্নীতির টিপ অফ দ্য আইসবার্গ ধরা পড়েছে, সামান্য অংশ বোঝা গেছে, এখানেই সে নাটক থামবে না, আরও অনেক সত্যি বের হয়ে আসবে, আরও অনেক বড় মাপের দুর্নীতি এই প্রকল্পকে ঘিরে চলছে, এটা নিশ্চিত। আমরা যারা আমাদের দেশের ভাষা, খাদ্য, পরিধান, পছন্দের বৈচিত্রকে মাথায় রেখে এক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা বলি, তাদের প্রত্যেকের কাছে বিজেপি আরএসএস এক বিপদ, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বাঁচাতেই আরএসএস বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, এখনই।