Written By রাহুল মজুমদার
তাঁর পরিচালনা মানেই দর্শকের ভাবার ও আনন্দের খোরাকের পাশাপাশি বক্স অফিসে ঝড়। মূলত তাঁর সাম্রাজ্য বড়পর্দায়। তবে এবারে সেই সাম্রাজ্য বাড়ানোর তালিকায় যোগ হয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মও। তাঁর পরিচালিত প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘ফেলুদা ফেরত ' আড্ডাটাইমসে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে। তিনি সৃজিত মুখোপাধ্যায়। তাঁর পরিচালিত অন্যান্য সিনেমাগুলোর মতোই ' ফেলুদা ফেরত ' ও নাম ঘোষণার দিন থেকেই ছিল চর্চার বিষয়। পোস্টার মুক্তির সময়েও সেই বহুচর্চিত ' ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হওয়া ' প্রবাদ আরও একবার নিজেকে সত্যি প্রমাণ করেছিল। তবে শেষপর্যন্ত আড্ডাটাইমসে স্ট্রিমিং হওয়ার পর এই ফেলুদা সিরিজের প্রথম ছবি ' ছিন্নমস্তার অভিশাপ ' নিয়ে দর্শক ও ছবি সমালোচকদের দল কিন্তু বেশ খুশি। বাকিদের কাছে যে নালিশ জমে নেই তা নয় তবে তাঁর পরিচালনায় ফের একবার নতুন ফেলুদাকে দেখার জন্য অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস কিন্তু বাড়ছে। শুক্রবার দুপুরে ' ফেলুদা ফেরত ' নিয়ে সৃজিত মুখোপাধ্যায় মুখোমুখি হলেন কলকাতা টিভি-র। শুনলেন রাহুল মজুমদার।
প্রশ্ন : ' ফেলুদা ফেরত ' এর নাম ঘোষণা থেকে শুরু করে পোস্টার মুক্তি পর্যন্ত যেভাবে এই ছবিকে ঘিরে বির্তক এবং আগ্রহ হাত ধরে এগিয়েছে তা এককথায় অবিশ্বাস্য। যদিও এ আপনার বরাবরেরই অভিজ্ঞতা। তবু,কেমন লাগছে ?
সৃজিত : ভালো তো লাগছে অবশ্যই। তবে আমার মনে হয় যদি ভাবনাচিন্তা সৎ থাকে, যদি কাজ মন থেকে করা হয় পরিশ্রমের সঙ্গে এবং তার মধ্যে ভালোবাসা থাকে তাহলে সফল হওয়ার পর ভালোলাগাটা ভারি আরাম দেয়। আর জানেন তো কোথাও গিয়ে ভালোবাসাটা ভীষণ জরুরি। বলতে চাইছি, আমি একজন ফেলুদার প্রচন্ড ভক্ত হয়ে সেই ভালোবাসা থেকে ফেলুদা বানালাম আর ফেলুদা সাংঘাতিক জনপ্রিয় বলে তাই তার ছবি বানালাম,এই দুটো ব্যাপারের মধ্যে সবসময় তফাৎ থেকে যায়। এটা শুধু ' ফেলুদা '-র ক্ষেত্রে নয়,যেকোনও সাহিত্যধর্মী ছবি বা যেকোনও কিছু যা তৈরির মধ্যে যদি ভালোবাসা পোরা থাকে,যত্ন থাকে তা কিন্তু ক্যামেরার সামনে ধরা পরে যায় ।পরতে বাধ্য।তাই আমি জানতাম মানুষ ফেলতে পারবেন না। বলতে চাইছি, শুরুতেই এই ছবিকে ঘিরে যে নানান বিতর্ক তৈরি হয়েছিল যার অনেকটাই ইচ্ছেকৃত!এরকম প্রচুর 'সেকশন' রয়েছে যারা এই কাজ করে থাকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কাজ কথা বলেছে। আমি সেটা নিজেও ভীষণভাবে মনে করি যে ' কাজ '-কে কথা বলতে দেওয়া উচিৎ। ক্রিকেটের ওই প্রবাদের মতো,'লেট দ্য ব্যাট ডু অল দ্য টকিং ' ।এক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। মানুষ বুঝতে পেরেছেন এই ছবি গভীর ভালোবাসা ও যত্নে মুড়ে বানানো। সঙ্গে অবশ্যই রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা। সত্যজিৎ রায় তাঁর গল্পে,অলঙ্করণে যেভাবে ফেলুদাকে তুলে ধরেছেন এক্কেবারে সেভাবেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফেলুদাকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন : আপনার ট্রিবিউট জানানোর কথার জের টেনে বলি, ' ছিন্নমস্তার অভিশাপ ' এর একাধিক সিকোয়েন্সে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত দুই ফেলুদা ছবির একাধিক শট এবং সংলাপ জায়গা করে নিয়েছে। ' যত কান্ড কাঠমান্ডুতে -ও কি ফের একবার এরকম ট্রিবিউটের কোলাজ দেখতে পাবেন দর্শক ?
সৃজিত : একশোবার পাবেন! ( বেশ জোরের সঙ্গে ) এটা মাথায় রাখতে হবে যে ফেলুদা কিন্তু শুধুই একটি চরিত্র নয়। আদতে ফেলুদা একটা টাইম ফ্রেমকে প্রতিনিধিত্ব করে,একটা সেন্সিবিলিটির প্রতিনিধিও বটে। তাই আমার কাছে ' ফেলুদা ' বলতে শুধুই ফেলুদা চরিত্রটিতে তাঁর পরিচয় ফুরিয়ে যাচ্ছে না। আমার কাছে ফেলুদা বলতে সত্যজিৎ রায়,বড় হয়ে ওঠা। ' ফেলুদা ' বলতে সত্যজিতের নানান ছোট গল্পের সংকলন। বলতে চাইছি এই যে আমার পুরো বড় হয়ে ওঠার সময়টার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি ' প্রদোষ চন্দ্র মিত্র ' .তাই আমার ফেলুদার ছবিতে সত্যজিতের নানান গল্পের সংলাপ কিংবা হয়তো সিকোয়েন্স ওনার প্রতি ট্রিবিউট হিসেবে আসতেই থাকবে। এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলতে চাই। ' ছিন্নমস্তার অভিশাপ ' এ জটায়ু যখন চৌকিদারকে ' ছা -উ -খি -ডা -র ' বলে ডাকছেন সেই সংলাপটাও কিন্তু সত্যজিৎবাবুর লেখা হরর গল্প ' নীল আতঙ্ক ' এর মুখ্যচরিত্র অনিরুদ্ধ বোসের মুখের সংলাপ। আমি কিন্তু সেটা এখানে রেখেছি। অবশ্যই সত্যজিৎবাবুর প্রতি ট্রিবিউট হিসেবে। ভবিষ্যতে এমন ছোটখাটো ব্যাপার আরও থাকবে।
প্রশ্ন : এবার আসি ' যত কান্ড কাঠমান্ডু '-র প্রসঙ্গে। ছিন্নমস্তার অভিশাপ ' এর টাইম ফ্রেম রাখা হয়েছিল সাতের দশক। আবার ' যত কান্ড কাঠমান্ডু '-র ট্রেলার দেখে বোঝা যাচ্ছে এই ছবির গল্পকে বোনা হয়েছে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে। ব্যাপারটা যদি একটু খুলে বলেন।
সৃজিত : কারেক্ট। ' ছিন্নমস্তার অভিশাপ ' যেরকম পিরিয়ড পিস ছিল, সেখানে ' কাঠমান্ডু ' কনটেম্পোরারি। এবং আরও একটা কথা বলি এই ফরম্যাটেই আমরা ফেলুদার বাকি সিজনগুলোও করব। একটা পিরিয়ড অন্যটি আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে।এটাই আমাদের প্ল্যান!
প্রশ্ন: তার মানে আপনার হাত ধরেই ফেলুদার আরও সিজন আসছে ?
সৃজিত : নিশ্চই! ( জোর দিয়ে ) যা বলছিলাম ফেলুদার সিজন থ্রি পিরিয়ড হবে আবার সিজন ফোর কনটেম্পোরারি। ফের সিজন ফাইভ পিরিয়ড এইভাবেই এগোবে। তবু এটকু বলবো ' যত কান্ড কাঠমান্ডু '-র টাইম ফ্রেম বর্তমান সময়ে ফেলা সত্ত্বেও এই এই উপন্যাসে ঠিক যেরকম ইলাস্ট্রেশনস করেছেন,বর্ণনা দিয়েছেন ঠিক তেমন অনুসরণ করেই করা হয়েছে। জানিয়ে রাখি ওনার এই ' বর্ণনা ' পুঙ্খানুপুঙ্খভাবেই অনুসরণ করেই আমরা বাকি ফেলুদা সিজনগুলো পরিচালনা করব। তবে এটা কিন্তু শুধুই সত্যজিৎ রায়ের প্রতি আমার ট্রিবিউট নয়। সেইসব সমস্ত বাঙালির প্রতি এটি আমার ট্রিবিউট যাঁরা সেইসব শীতকালের দুপুরবেলাগুলো হয়তো হারিয়ে ফেলছেন, যেই বাঙালিরা পৃথিবীর নানান এসে বসে নানান কাজে ব্যস্ত। ' ফেলুদা '-র ওই আড়াই ঘন্টার মাধ্যমে তাঁরা যেন তাঁদের স্মৃতির সরণিতে ফিরে যেতে পারে সে চেষ্টাও আমরা পুরোপুরি করব।
প্রশ্ন : আরেকটা কথা। ' যত কান্ড কাঠমান্ডু '-র বইয়ে সত্যজিৎ রায় যে বিভিন্ন ইলাস্ট্রেশনস করেছেন তার বেশ কিছু রূপায়ণ আপনি এই ছবিতে যে রেখেছেন তা ট্রেলারেই দেখা গেছে। যেমন এক সরু গলির ধরে বাড়ির বারান্দায় বসে সারিন্দা বাজাচ্ছেন এক বৃদ্ধ নেপালি। এরকম আরও কিছু তাঁর করা স্কেচের টুকরো কোলাজ কি এই ছবিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ?
সৃজিত : হ্যাঁ,হ্যাঁ একদমই। ভীষণভাবে রয়েছে।
প্রশ্ন : মানে লুম্বিনী হোটেল, শূকর গলি,কালভৈরবের মূর্তি ....
সৃজিত : সব,সব। এর সঙ্গে যোগ করুন জপযন্ত্র,পাটন শহর, ওঁ মণিপদ্মে হুম এবং অবশ্যই মগনলাল মেঘরাজ।
প্রশ্ন : আপনি নিজে একজন বিরাট ফেলুদা ফ্যান। অন্যান্য ছবির সঙ্গে ফেলুদার তফাৎ কোথায় ?
সৃজিত : সে অর্থে দেখতে গেলে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ও অন্যান্য লেখার মতোই ' ফেলুদা '-র মধ্যেও বিনোদনের সঙ্গেও একটা শিক্ষা থাকে। সেটা ভ্রমণকাহিনীর জায়গা থেকে হোক বা কিংবা থ্রিলার,শিক্ষা কিন্তু থাকে। সেই শিক্ষার পার্সোনিফিকেশনই হয়তো ফেলুদার সৃষ্টির অন্যতম কারণ। তাই ফেলুদা যখন কোনও একটা বিষয়ে তোপসে বা লালমোহনবাবুকে জানাচ্ছেন তার সঙ্গে তিনি কিন্তু সেটা গোটা বাঙালি জাতিকেই জানাচ্ছেন।
প্রশ্ন : ফেলুদা হিসেবে টোটাকে কত নম্বর দেবেন ?
সৃজিত : সৌমিত্রবাবু আমার কাছে বেস্ট ফেলুদা আর টোটা ফিটেস্ট ফেলুদা।
প্রশ্ন : টোটার ফেলুদা হয়ে ওঠার পিছনে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের কোনও বিশেষ নির্দেশ ছিল কী ?
সৃজিত : উমমম...দেখুন অভিনেতা হিসেবে টোটার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে যেটা সব অভিনেতারই থাকে। আমার কাজটা হলো টোটার স্ট্রেংথগুলোকে সামনে আনা, তাঁর দুর্বল জায়গাগুলোকে যতটা সম্ভব ক্যামেরার সামনে কম আসতে দেওয়া ততটা টোটা এবং তাঁর চরিত্রায়ণের পক্ষে ভালো। টোটার ক্ষেত্রে আমাকে কখনোই অভিনয় করে দেখিয়ে দিতে হয়নি বরং আমি কিছু রেফারেন্স দিয়েছি তাঁকে। টোটাকে আমি বলেছিলাম,ফেলুদার স্কেচের সঙ্গে তোমার সবথেকে বেশি মিল। ফেসিয়াল স্ট্রাকচারের দিক থেকে তুলনা করলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের থেকেও বেশি মিল। তবে ফেলুদা হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে ম্যাজিক ক্রিয়েট করে গেছেন তাতে ওনাকে দেখেই মনে হয় ইনিই তো ফেলুদা।আর উনিই সেরা ফেলুদাই থাকবেন। তাঁর অভিনয় এত পাওয়ারফুল ছিল যে ফেলুদা ছবির বেশ কিছু ক্লোজ শটে যখন তিনি কিছু একমনে চিন্তা করছেন আমি যেন তাঁর 'ব্রেন টিকিং ' এর শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছি! সেই অভিনয়ের জায়গা থেকেই টোটাকে বলেছিলাম ফেলুদার যে যে সিকোয়েন্সে মগজাস্ত্রের ব্যবহার বা রহস্য সমাধানের অভিনয় করতে হচ্ছে চোখ কান বুঝে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তোমার একমাত্র রেফারেন্স।আর কিচ্ছু ভেবো না! কারণ ওই ব্যাপারে ওঁনার থেকে ভালো কেউ অভিনয় আর কেউ করেননি। অন্তত আমার দেখা নেই। তবে টোটাকে আরও বলেছিলাম,ওনাকে নকল করো না কিন্তু ওঁনার ওই জায়গায় যে অভিনয়ের দর্শন সেটাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করো। তবে ফেলুদা হিসেবে ভয়েস প্রোজেকশনের জায়গায় সব্যসাচী চক্রবর্তীকে অনুসরণ করো ( হাসি )।
প্রশ্ন : আপনার পরিচালকের জীবন শুরু বেঙ্গালুরুতে ' ফেলুদা ফেরত ' নাটক পরিচালনার মাধ্যমে। সেখানে অবশ্য ফেলুদা বৃদ্ধ ছিলেন।ফিরে এসেছিলেন যৌবনের একটি আনসলভড কেসের সমাধান করার জন্য। ভবিষ্যতে এরকম কী কিছু সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় দেখা যেতে পারে ? কারণ ইতিমধ্যেই বৃদ্ধ ব্যোমকেশকে নিয়ে কিন্তু দর্শক ' বিদায় ব্যোমকেশ ' দেখে ফেলেছেন ।
সৃজিত : আই উড লাভ টু ডু দ্যাট! কিন্তু নানারকম আইনি সমস্যা রয়েছে তো তাই এইমুহূর্তে হয়তো করে হয়ে ওঠা উঠবে না। তবে ভবিষ্যতে কী হবে দেখা যাক ( হাসি ) তবে ' ফেলুদা ফেরত ' নাটকের সেই স্ক্রিপ্ট কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা রয়েছে। ওই নাটকেও ফেলুদার একমাত্র আনসলভড কেস চন্দননগরের জোড়া খুনের মামলার কথার উল্লেখ রয়েছে।
প্রশ্ন : শেষ প্রশ্ন। আপনি ' কাকাবাবু ' নিয়েও বড়পর্দায় ছবি তৈরি করেছেন এবং করছেন। পাশাপাশি এবার শুরু হল ফেলুদা। কে বেশি কাছের ?
সৃজিত : ' কাকাবাবু ' আমার কাছে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ আর ' ফেলুদা ' আমার কাছে ' লাভ ম্যারেজ '! ( হাসি )