Written By রাহুল মজুমদার
শেষবার ' জটায়ু 'কে বড়পর্দায় দেখা গেছিল ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া সন্দীপ রায় পরিচালিত ছবি ' রয়েল বেঙ্গল রহস্য ' ছবিতে। সেই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন স্বর্গীয় অভিনেতা বিভু ভট্টাচার্য। এরপর দীর্ঘ বিরতি। তারপর বড়পর্দায় একাধিকবার ফেলুদা ফিরলেও ফেরেননি 'লালমোহন গাঙ্গুলি'। স্বভাবতই ' তাঁর ' জন্য বাড়ছিল প্রতীক্ষা। অবশ্য সম্প্রতি সেই প্রতীক্ষা শেষ হয়েছে। পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে পর্দায় ফেলুদা ফেরার পাশাপাশি ফিরেছেন জটায়ুও। তা সে ফেরা হোক না যতই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। দর্শক সাদরে গ্রহণ করেছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ' ফেলুদা ফেরত ' ওয়েব সিরিজকে। এই ওয়েব সিরিজের প্রথম সিজন ' ছিন্নমস্তার অভিশাপ ' ছবিতে ফিল্ম সমালোচকদের প্রশংসা ও হাততালি দুইই কুড়িয়েছেন ' জটায়ু ' চরিত্রে অভিনয় করেছেন যিনি,সেই অনির্বাণ চক্রবর্তী। তাঁর অভিনয় দেখে ফেলুদাপ্রেমী দর্শকদেরও মুখের হাসিও হয়েছে চওড়া। ইতিমধ্যেই মুক্তি পেয়েছে ' ফেলুদা ফেরত ' এর পরবর্তী সিজনের ছবি ' যত কান্ড কাঠমান্ডু '-র ট্রেলার। সেই ট্রেলারের অনেকটা জুড়েই রয়েছেন অনির্বাণ । থুড়ি,'জটায়ু '! সম্প্রতি, 'ফেলুদা ফেরত ' নিয়ে এক প্রচার অনুষ্ঠানে কলকাতা টিভির সঙ্গে গল্প-আড্ডায় মেতে উঠলেন এই অভিনেতা। আড্ডার সঙ্গী হলেন রাহুল মজুমদার।
কলকাতা টিভি : জটায়ুর ভাষায় এইমুহূর্তে আপনাকে ফেলুদাপ্রেমী দর্শকরা ' কাল্টিভেট ' করতে চাইছেন। কেমন লাগছে গোটা বিষয়টা ?
অনির্বাণ : ভালোই লাগছে। তবে বেশ ভালো লাগছে শুনে যে দর্শকরা বলছেন ' জটায়ু' চরিত্রে আগে যেসব বাঘা বাঘা অভিনেতারা অভিনয় করেছেন,আমি তাঁদের অনুসরণ না করে নিজের চেষ্টায় যেভাবে এই চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি সেটা তাঁদের ভালো লেগেছে। এটুকুই ( হাসি )
প্রশ্ন : ' একেনবাবু '-র মুক্তির পরে একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ভবিষ্যতে জটায়ুর চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেলে খুশি হবেন। কাট টু প্রেজেন্ট,এখন আপনিই ফেলুদাপ্রেমীদের কাছে ' জটায়ু '।
অনির্বাণ : জানেন তো ' একেনবাবু '-তে অভিনয় করার আগে আমার নিজেকে কখনও মনে হয়নি যে আমাকেও জটায়ুর মতো দেখতে লাগতে পারে। তা জটায়ুর জন্য কাস্টিংয়ে ডাক পাবো সেকথা ভাবা তো দূরের ব্যাপার ( হাসি ) .বরং ছোটবেলায় ফেলুদার উপন্যাস পড়ে মনে মনে তোপসের ভূমিকায় অভিনয় করতে চাইতাম। ঘুনাক্ষরেও নিজেকে জটায়ু হিসেবে কল্পনা করিনি কোনওদিন। তা হলো কী,'একেনবাবু ' মুক্তি পাওয়ার পর অনেক মানুষ বলতে শুরু করেন যে আমাকে জটায়ু হিসেবে মন্দ লাগবে না। এরপর তো সৃজিত এই চরিত্রের অফার করল। সো অবভিয়াসলি, ' জটায়ু ' হতে পেরে ভীষণই ভালো লাগছে।
প্রশ্ন : এই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য অভিনেতা হিসেবে আলাদা কোনও প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ? কারণ একে ফেলুদার ছবি তার ওপর ' জটায়ু '-র চরিত্রে অভিনয়। খানিকটা চাপ ছিল তো নিশ্চয়ই ?
অনির্বাণ : হ্যাঁ খানিকটা চাপ তো ছিলই। তবে আমার না একটা সুবিধে রয়েছে যে একদম চাপ নিই না আমি। যেখান থেকে চাপটা আসছে ওখানেই রেখে দি। তবে হ্যাঁ, আপামর ফেলুদাপ্রেমী দর্শকদের মননে জটায়ু বলতেই যাঁর মুখ ভেসে ওঠে, তিনি সন্তোষ দত্ত।আমিও তাই মনে করি।এটাই স্বাভাবিক। তবে ' জটায়ু ' চরিত্রে অভিনয় করার সময় সেই চিন্তাটা যাতে গাঢ় না হয়ে যায় সে ব্যাপারে প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলাম। তাই ফেলুদার সবকটি উপন্যাস পড়া থাকলেও, ' ফেলুদা ফেরত ' এর শ্যুটিং শুরুর আগে আমি ফের একবার সব উপন্যাসগুলো পড়ে ফেলেছিলাম জটায়ু চরিত্রটিকে আরও একটু চিনব বলে,আরেকটু বুঝব বলে।কারণ চরিত্রটাকে চিনতে পারলে সে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ঠিক কী করবে,কীরকম রিয়্যাক্ট করবে এই ব্যাপারগুলো অভিনয় করার সময় ভীষণ সহজ হয়ে যায় অভিনেতার পক্ষে। ও হ্যাঁ, শ্যুটিং শুরুর আগে আমি কিন্তু আর কোনও ফেলুদা ছবি দেখিনি। এখানে আরও একটা কথা বলতে চাই।
অনির্বাণ : সৃজিত যেদিন ' ফেলুদা ফেরত ' এর চিত্রনাট্য পড়ে শুনিয়েছিল আমি ভীষণ মন দিয়ে শুনেছিলাম। সৃজিত ঠিক কী চাইছে,জটায়ুকে কীভাবে প্রজেক্ট করতে চাইছে তা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম সেদিনই। জটায়ুকে নিয়ে আমার যেরকম ধারণা ছিল,দেখলাম হরেদরে সৃজিতের চাহিদাও তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : আপনার কথার জের টেনেই জিজ্ঞেস করি, ' জটায়ু '-কে ঠিক কী রকম মানুষ হিসেবে আপনি চিনলেন,বুঝলেন ?
অনির্বাণ : জটায়ু হচ্ছে একজন অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ যে ভিতরে ও বাইরে একরকম। যাঁর মনে কোনওরকম জিলিপির প্যাঁচ নেই। যে ধরণের মানুষ আজকের দিনে বিরল। এবং অত্যন্ত রসিক। তাঁর মধ্যে কিছু ছেলেমানুষি রয়েছে। তবে আমি কিন্তু এই চরিত্রটিকে শুধুমাত্র ' কমিক রিলিফ হিসেবে ভাবি না।আমার মনে হয়েছে জটায়ু একজন আদ্যপান্ত মধ্যবিত্ত বাঙালি যে সরল,রসিক,খেতে ভালোবাসে তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে জানার একটা আগ্রহ রয়েছে। এবং বন্ধুবৎসল তো বটেই!
প্রশ্ন : আচ্ছা, রিল লাইফের জটায়ুর সঙ্গে কী কোথাও নিজের কোনও মিল খুঁজে পেয়েছেন ?
অনির্বাণ : এই রে ( জোরে হাসি). একটা জিনিষ হয়তো...উমমম...বলতে পারি। জটায়ুর মতো আমিও জীবনকে খুব সহজভাবে দেখতে ভালোবাসি,পারতপক্ষে জটিলতা এড়িয়ে চলি।
প্রশ্ন : জটায়ু হিসেবে আপনার প্রিয় ফেলুদা উপন্যাস কী ?
অনির্বাণ : যত কান্ড কাঠমান্ডুতে! কারণ এই উপন্যাসে জটায়ুর কিন্তু শুধু বড় নয় তার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গল্পের একটা অংশে তোপসের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে ফেলুদা ছাড়াই সে এডভেঞ্চারে নেমে পড়ে যা রহস্য উদঘাটনে ফেলুদাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছিল। কাকতালীয়ভাবে পাঠক হিসেবে আরও একটি আমার প্রিয় ফেলুদা উপন্যাস ' ছিন্নমস্তার অভিশাপ ' .তা সেটাও তো করা হয়ে গেছে।
প্রশ্ন : পরিচালক জানিয়েছেন ভবিষ্যতেও ফেলুদা ফেরত এর একটি সিজন হবে পিরিয়ড পিস,পরেরটি কনটেম্পোরারি। সেক্ষেত্রে যেহেতু টাইম ফ্রেম বদলে যাচ্ছে,জটায়ু কি কোথাও একটু বদলাবে ?
অনির্বাণ : দেখুন, ' ছিন্নমস্তার অভিশাপ 'কে ফেলা হয়েছিল সাতের দশকে আর ' যত কান্ড কাঠমান্ডু '-র প্রেক্ষাপট রাখা হয়েছে বর্তমান সময়ে। দুটো সিজনে অভিনয় করার সুবাদে বলছি দুটো ছবির টাইম ফ্রেম বিভিন্ন সময়ের হলেও ক্যারেক্টারগুলো কিন্তু এক্কেবারে এক থেকে গেছে। ধরুন, ' কাঠমান্ডু '-তে যখন অভিনয় করছি তখন আমাকে জটায়ু হিসেবে ' ছিন্নমস্তা'-র থেকে কোনোকিছু আলাদা করতে হয়নি। দরকারই পড়েনি। এই কথাটা ফেলুদা,তোপসে,জটায়ু সবার ক্ষেত্রেই খাটে। এমনকি মগনলালের জন্যও প্রযোজ্য। চরিত্রগুলোর বেসিক নেচার একই থেকে গেছে। সত্যজিৎবাবু এঁনাদের ইলাস্ট্রেশনস যেভাবে করেছিলেন ঠিক সেই অনুযায়ীই দেখা যাবে এঁদেরকে।
প্রশ্ন : তাহলে বলছেন জটায়ু যদি ২০২১ সালে থাকেন তাহলে তিনি এখনও সবুজ রঙের অ্যাম্ব্যাসেডর গাড়িই ব্যবহার করবেন। এই তো ?
অনির্বাণ : ( হাসি ) না,না অতটাও নয়। বলতে চাইছি,এখন তো আর অ্যাম্ব্যাসেডর গাড়ির চলই নেই প্রায়। তাই এখন জটায়ু থাকলে তিনি হয়তো অন্য গাড়ি ব্যবহার করবেন কিন্তু তাঁর প্রিয় রং যদি সবুজ হয় তবে গাড়ির রং তাইই থাকবে। আরও একটা কথা। এই ধরুন আজকাল আমরা তো আর সারাক্ষণ কেউ ধুতি পরে থাকি না তাই জটায়ু থাকলে তিনি হয়তো পাঞ্জাবির সঙ্গে পাজামা পরবেন। এটুকুই পার্থক্য। তাই বলে টি শার্ট,জিনস পড়বে না।
প্রশ্ন : ' ছিন্নমস্তার অভিশাপ ' এ জটায়ু ও তোপসের বেশ দারুণ রসায়ন কিন্তু চোখ টেনেছে দর্শকদের। স্নেহশীল অভিভাবকের মতো তোপসে ধূমপান করে কি না তাও খোঁজ নিচ্ছেন জটায়ু।
অনির্বাণ : হ্যাঁ কারেক্ট,কারেক্ট। আসলে কী বলুন তো জটায়ু ও তোপসের মধ্যে কিন্তু প্রথম থেকেই একটা সুন্দর মিষ্টি সম্পর্ক রয়েছে। যেখানে বন্ধুত্ব রয়েছে,খানিকটা স্নেহ রয়েছে,প্রশ্রয় রয়েছে। তোপসেও কিন্তু জটায়ুর প্রতি যথেষ্ট কেয়ারিং,আগলে রাখে। এখানে দু'জনের বয়সের ফারাকটা তাঁদের বন্ধুত্বের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি।
প্রশ্ন : পর্দায় আপনার,টোটা ও কল্পনের এই তিনজনের রসায়ন হিট করার পিছনে রহস্যটা ঠিক কী ? পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্ব কি বহু আগে থেকেই ?
অনির্বাণ : ( হাসি ) না,না। আমাদের তিনজনেরই আলাপ,পরিচয় সবই ' ফেলুদা ফেরত ' করতে এসে। স্ক্রিপ্ট সেশনেই প্রথম দেখা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে শুরুর দিন থেকেই আমাদের তিনজনের পরস্পরের সঙ্গে একটা দারুণ বন্ডিং তৈরী হয়ে গেছে। এর পিছনে কী রহস্য আছে সেটা কিন্তু আমিও জানি না। পরবর্তী সময়ে যখন পর্দার সামনে তিনজনে একসঙ্গে দাঁড়িয়েছি তাতেও হয়তো এই বন্ধুত্বটা ফুটে উঠেছে।
প্রশ্ন : ভবিষ্যতে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ' জটায়ু ' ছাড়াও অনির্বাণ চক্রবর্তীকে অন্যান্য চরিত্রে দেখার জন্য কিন্তু দর্শক অপেক্ষা করছেন।
অনির্বাণ : হ্যাঁ, সৃজিতের পরিচালনায় ' কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ' এ রয়েছি। ছবিতে আমার অভিনীত চরিত্রটি যে বেশ অন্যরকম আপাতত এটুকু বলতে পারি। এছাড়া সৃজিতের পরবর্তী ওয়েব ছবি ' রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি '-তে একটি চরিত্রে অভিনয় করছি। চরিত্রটি ছোট্ট হলেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : অভিনেতা হিসেবে কোন ধরণের চরিত্র আপনাকে আকর্ষণ করে ?
অনির্বাণ : বিভিন্ন লেয়ার্ড রয়েছে কিংবা খুব ধূসর কোনও চরিত্র।
প্রশ্ন : শেষ প্রশ্ন, কে বেশি কাছের ' একেনবাবু ' না ' জটায়ু '?
অনির্বাণ : এটা কিন্তু মোটেই ঠিক হচ্ছে না! ( জোরে হাসি ) কী বলি বলুন তো ? ভীষণ মুশকিলে ফেললেন। আমার কাছে না এই দুটোর মধ্যে একটা বাছা সত্যি মুশকিল। একটু বুঝিয়ে বলি। দুটো চরিত্র পছন্দ হওয়ার দুটো ভিন্ন কারণ রয়েছে আমার কাছে। দেখুন,আমার আগে ' একেনবাবু ' চরিত্রে আগে কেউ কখনও অভিনয় করেননি। তাই একেনবাবু মানেই দর্শকের কাছে আমার অবয়ব,ম্যানারিজম সেটা। তাই একেনবাবু আমার কাছে একটু ইমোশনাল বিষয়। অন্যদিকে, 'জটায়ু 'নিজগুণেই এত বিখ্যাত একটি চরিত্র,তার ওপর সব কিংবদন্তি অভিনেতারা এই চরিত্রে অভিনয় করে গেছেন। স্বাভাবিকভাবেই 'জটায়ু ' চরিত্রে অভিনয় করতে পেরে তাই ভীষণ খুশি হয়েছি।