Written By সম্পাদক
‘২০১৬র ইলেকশনের আগে, আমি নন্দীগ্রাম থেকেই, আমি আমার ইলেকশন ঘোষণা করেছিলাম, আমি আজকেও এসেছি নন্দীগ্রামে, নন্দীগ্রাম থেকে ২০২১ এ তৃণমূল কংগ্রেস জিতবে, এবং ২০২১ মনে রাখবেন, নন্দীগ্রাম থেকেই শুরু হল জেতার পালা, তাই তৃণমূল কংগ্রেস এই নির্বাচনে জিতবে, নন্দীগ্রাম থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা সিটে, তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হবে ও জয়লাভ করবে। আর নন্দীগ্রামের সিটে আমি কারোর নাম এখনই বলছি না, পরে বলবো। বাট আমি মনে করি নন্দীগ্রাম সিটে ভালো মানুষ দেবো, যিনি সত্যি আপনাদের কাছে পড়ে থেকে, যিনি কাজ করবেন। আর নন্দীগ্রাম সিট, এমনিতে এটা জেনারেল সিট, কাজেই কোনও অসুবিধে নেই, এমনকি আমিই যদি নন্দীগ্রামে দাঁড়াই, তাহলে কেমন হয়? ভাবছিলাম, কথার কথা, একটু বললাম, একটু ইচ্ছে হল, একটু গ্রামীণ জায়গা, একটু আমার মনের জায়গা, একটু আমার ভালবাসার জায়গা, আমি হয়তো ওই ইলেকশনের সময় অত টাইম দিতে পারবো না, কারণ আমাকে তো ২৯৪ সিটে লড়তে হবে, সেইজন্য আপনারা কিন্তু কাজটা করে দেবেন, কিন্তু তারপরের যা কাজ আমি কিন্তু সব করে দেবো। ঠিক আছে?’
না, একটা অক্ষরও স্ক্রিপ্টেড নয়, এ পরিকল্পনা প্রশান্ত কিশোরের নয়, এ কথা আধ মিনিট আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও ভাবেননি, বলে ফেললেন, ২০২১ নির্বাচনের গেমপ্ল্যানের সবথেকে বড় মাস্টারস্ট্রোক দিলেন, এই মেজাজটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এই সাহসটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ডিফেন্সের কোনও প্রশ্নই নেই, বল নিয়ে সোজা প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের সামনে মারাদোনা, গোলকিপার এক মুহূর্ত আগেও ভাবেনি এই সঙ্কটের কথা, নে এবার কী করবি কর, এই আকস্মিকতার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
যা মোদী কেন্দ্রে করেন, লোকসভা নির্বাচনে করেন, তিনি এজেন্ডা সেট করে দেন, মিত্রোঁ………… এবার তার জবাব দিতে দিতে প্রতিপক্ষরা হাল্লাক, তিনি একটা করে এজেন্ডা তৈরি করবেন, বিরোধীরা তার জবাব দেবে, একটার পর একটা।
বোল জামুরা,
জী উস্তাদ!
নাচোগে?
জী উস্তাদ!
গানা গাওগে?
জী উস্তাদ!
সাব কো সলাম করোগে?
জী উস্তাদ!
সাব কো পরণাম করোগে?
জী উস্তাদ!
মানে উনি ওস্তাদ, বিরোধীরা চ্যালা, উনি কিছু বলবেন, বিরোধীরা তার জবাব দেবে, সেই খেলা জানেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কাল থেকে সেই খেলা শুরু। এজেন্ডা তিনি সেট করবেন, কিসের এজেন্ডা? কী এজেন্ডা? তিনি নন্দীগ্রাম থেকে দাঁড়াবেন, মানে আগামী নির্বাচনের সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে গেলো নন্দীগ্রাম, জমি আন্দোলনের লড়াই, কৃষকদের লড়াই, সংখ্যালঘু মানুষদের লড়াই, বামফ্রন্টের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে লড়াই। তার সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই জুড়ে গেলো এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবথেকে বড় গণ আন্দোলন, কৃষি বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা, বিজেপি নাকানি চোবানি খাচ্ছে এই বিল আর আন্দোলন নিয়ে, সেই ইস্যু বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচন হবে না। এটাই মাস্টারস্ট্রোক, একটা চাল, আঘাত দশ জায়গায়। মারবো এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে।
রিঅ্যাকশন দেখেই পরিস্কার হয়ে যাবে, মমতা কতটা সফল। যখন বিভক্ত বিরোধীরা এক সুরে কথা বলে, তখন মানুষের কাছে আবছা হয়ে যায় তাদের আহ্বান, তৃণমূল বিরোধী ভোট এক জায়গায় নয়, ভাগ হয়ে যাবে, লাভ তৃণমূলের। গতকাল ভ্যাবাচাকা খাওয়া কং নেতা আব্দুল মান্নান, সিপিআইএম নেতা সুজন চক্রবর্তী, আর বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের বক্তব্য ছিল হুবহু এক। দিদি ভয় পেয়েছেন, তাই ভবানীপুর থেকে পালাচ্ছেন নন্দীগ্রাম। তিন বিরোধী দলকে এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর সেট করা এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকল বাম, কং, বিজেপি। ভেবেছিলাম একটু পরিণত মান্নান সাহেব বলবেন, ওনার দল কী করবে, উনি কী করবেন, তা ওনাদের ব্যাপার, ভেবেছিলাম উনি ডাক করবেন এই বাউন্সারটা, তিনিও সমস্বরে প্রতিক্রিয়া দিলেন। অন্যদিকে, কাঠপিঁপড়ের কামড় খাওয়ার মত তীব্র প্রতিক্রিয়া শুভেন্দুর, জানালেন কেবল দাঁড়াবেন না, ৫০ হাজারের বেশী ভোটে জিতবেন এবং না জিততে পারলে রাজনীতিই ছেড়ে দেবেন, মানে জেতা হারা তো পরের ব্যাপার, আজ থেকে নন্দীগ্রামের বাইরে থাকলেই ঘুণপোকা কামড়াবে, কট কট, কট কট, সবে দলবদল, এতদিন সভায় সামনের চেয়ার বরাদ্দ ছিল, এখানে এখনই পেছনের চেয়ারে বসানো শুরু হয়ে গেছে, হেরে গেলে প্যারাশুট ছাড়াই প্লেন থেকে লাফ মারা হয়ে যাবে, এটাই মাথায় ঘুরবে। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক এটাই করলেন, বিজেপির পোস্টার বয়ের মাথায় চাপালেন যে বোঝা তা থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব, প্রতিদিন প্রতিটা মুহূর্ত শুভেন্দু অধিকারী, দল নয়, রাজ্য নয় কেবল নন্দীগ্রাম নিয়েই চিন্তিত থাকবেন, কারণ প্রতিপক্ষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ফালাকাটা, ক্যানিং, পারা, মেমারি, কান্দি, যেখানেই ভাষণ দিন, তা হেডলাইন হবে, প্রচার হবে, নন্দীগ্রাম জানবে, মানুষ জানবে। শুভেন্দু কত জায়গায় যাবেন? অমিত শাহ, মোদী, নাড্ডা, বিজয়বর্গীয়, স্মৃতি ইরানি, রাজনাথ সিং বা আদিত্যনাথ যোগী যখন আসবেন, তখন কে থাকবেন প্রথম পাতায়? আর নন্দীগ্রাম মমতার লড়াই নয়, এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব? যে আন্দোলন দেশের জমি অধিগ্রহণ আইন পালটে দিয়েছে, সে আন্দোলনের আসল হকদার শুভেন্দু অধিকারী, একথা শুনলে তো ঘোড়ায় হাসবে! তাই না। অতএব, উলটা গিনতি চালু করে দিন মিঃ পোস্টার বয়।
সারা রাজ্যে কৃষদের আন্দোলন যদি এজেন্ডা হয়, অন্নদাতাদের লড়াই যদি সামনের সারিতে চলে আসে, বিজেপির বক্তব্য কী হবে? সারা দেশের কৃষক যখন রাজপথে, যখন ১০ হাজার ট্রাক্টর নিয়ে মিছিল হবে ২৬ তারিখে, তা নিয়ে কি বলবে বিজেপি? হ্যাঁ কর্পোরেটরা চাইছে কৃষি আইন, চেম্বার অফ কমার্স চাইছে কৃষি আইন, আইএমএফ চাইছে কৃষি আইন, কৃষকরা তো চাইছে না। তাহলে কৃষকদের কী বোঝাবেন? স্মৃতিতে আনুন, বামফ্রন্ট ২৯৪ এ ২৩৫, টাটার মত বড় বিজনেস গ্রুপ, পিছোতে হয়েছিল, কৃষকদের আন্দোলনের সামনে মাথা নোয়াতে হয়েছিল, ইতিহাসের থেকে এই শিক্ষা নেয়নি বিজেপি, এবার নেবে। আর নন্দীগ্রামকে সামনে এনে, সেই ইস্যুকেই জীবন্ত করে রাখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কী বলবে বিজেপি? যারা সেদিন নন্দীগ্রামে মমতার লড়াইকে সমর্থন করছিল, তাঁদের নেতা এসে দেখা করছিল মমতার সঙ্গে, তাঁরা বলবেন আজ যে, ওই আন্দোলনের নেতা তো ছিলেন শুভেন্দু, বলতে পারবেন? বললে মানুষ বিশ্বাস করবে? মঞ্চে তো বসেই ছিল, সেদিনের শহিদ পরিবারের প্রত্যেকে, কই তাঁরা তো শুভেন্দুর দিকে গেল না? কেন গেলো না? শুভেন্দু তার জবাব বহু আগেই বার বার দিয়েছেন, বলেছেন আমি তৃণমূলের একজন সৈনিক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৈনিক। এক সৈনিক যখন সেনানায়কের খেতাব ছিনতাই করতে যান, তখন তাঁকে বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয় বৈকি, শুভেন্দু তাই হচ্ছেন, সারাটা নির্বাচন পর্ব জুড়ে তাই হবেন, প্রত্যেকদিন, প্রতিটা মুহূর্ত।
বাংলার নির্বাচন, এখানকার রাজনীতির সঙ্গে দেশের আর পাঁচটা রাজ্যের তুলনা করবেন না, তুলনা হয় না। আমাদের এখানে কেবল জাতপাতের সমীকরণ বদলালেই সরকার গড়ে কিম্বা ভাঙে না, আমাদের এখানে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মুসলমান ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনের জামানত জব্দ হয়, হয়েছে। আমাদের এখানে নেতা দল বদলালেই ভোটাররা দল বদলায় না, আমাদের রাজ্যে পালাবদল হয়েছে গণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, পালাবদলের পালার পেছনে খাদ্য আন্দোলন, শিক্ষকদের আন্দোলন, বাস ভাড়ার আন্দোলন, জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন, জমি দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলন। সে যুক্তফ্রন্ট, বামফ্রন্ট বা মমতার সরকার, যেদিকেই তাকাবেন, তাদের গোড়ায় আছে এক বিশাল গণ আন্দোলন আর তার প্রেক্ষাপটে অসংখ্য মানুষের লড়াই, তাঁদের ভূমিকা, মমতা লড়ে যাচ্ছিলেন, সেই কবে থেকে। পরিবর্তন আসেনি, এল সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের হাত ধরে, কেন? কারণ বাংলায় পরিবর্তন গণ আন্দোলনের হাত ধরে আসে। বিজেপির গণ আন্দোলন? এ রাজ্যে? কোন ইস্যুতে? দুটো ঢিল ছোঁড়া নিয়ে তো গণ আন্দোলন হয় না, আর সেরকম সাকসেসফুল হিংসাও লাগানো যায় নি, তাহলে? আপাতত বিজেপির মুখে তৃণমূলের দুর্নীতির কথাও শোনা যাচ্ছে না, শুভেন্দু বা শোভন উঠে বলবেন কী? তাদের ভিডিও তো এই দিলীপ ঘোষই মানুষকে দেখিয়েছেন, সারদা নিয়ে কথা বললে আঙুল উঠবেই মুকুল, শোভনের দিকে। তাহলে ইস্যু কী? মতুয়া নিয়ে এরই মধ্যে ল্যাজেগোবরে, এনআরসি লাগু করার থেকে পিছিয়েছেন, সিএএও আপাতত বন্ধ, তাহলে কী বলবেন সেখানে?
সুজন চক্রবর্তীও ইদানিং খেই হারিয়ে ফেলছেন, কালকের পরে ওনার প্রতিক্রিয়া, মুখ্যমন্ত্রী ভয় খেয়ে পালাচ্ছেন, তা জ্যোতি বসু সাতগাছিয়া গিয়েছিলেন বরাহনগর থেকে, ভয় পেয়ে? বুদ্ধ ভট্টাচার্য, কাশীপুরে হেরে যাদবপুর, ভয় পেয়ে? ওনাদের কাছে ইস্যু ২০১৬র আগের নারদা সারদা, তারপরে বিধানসভা, লোকসভার নির্বাচন হয়েছে, বামের ভোট ৭% এর কম, তৃণমূলের ভোট বেড়েছে, আর এই ১০ বছরে রাজ্যে শ্রমিক বা কৃষকদের নিয়ে গণআন্দোলন? কই? কোথায়? ইনফ্যাক্ট গত ১০ বছরে সেই অর্থে ভাঙড় জমি রক্ষা আন্দোলন ছাড়া লড়াই কোথায়? সে লড়াইয়ের কৃতিত্বও তো সিপিএম এর নয়, হান্নান মোল্লা রাজস্থান থকে লাখো কৃষকের মিছিল নিয়ে যেতে পারেন দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ক’জন গেলেন, মিছিল করে? তার মানে গণ আন্দোলনে ব্যর্থ সিপিএম কি ২১ এ রাম ২৬ এ বাম এই বিশ্বাস করে? সেই কবেই নকশালদের রাজনৈতিক ভাবে লড়াই করতে না পেরে, কংশাল বলে চিহ্নিত করে দায় সেরেছিল সিপিএম, আজও বিজেমূল এর তত্ত্ব দিয়ে মাঠে নেমে নিজেদের হাস্যস্পদ করা ছাড়া আর কিছুই তো করছে না সরকারি বামেরা, সম্ভবত তাঁদের মাথায় ফ্যাসিস্ট শক্তির এই বাড়বাড়ন্ত এখনও মাথায় ঢোকেনি, আর আমরা তো জানিই, বহু পরে ভুল স্বীকার করাটাই সরকারি বামেদের ঐতিহ্য।
নন্দীগ্রামে কে লড়বে? কে দাঁড়াবে কেবল তাই নয়, গতকাল নির্ধারণ হয়ে গেলো ২০২১ বাংলার নির্বাচনের এজেন্ডা, এবার জমির লড়াই, কৃষক আন্দোলন, মমতার লড়াইয়ের ইতিহাস নিয়েই ব্যস্ত থাকবে বিরোধীরা, সেখানেই লেখা থাকবে জয় পরাজয়ের কারণ, এই তারিখ মনে করে রাখুন, নির্বাচনের পর মিলিয়ে নেবেন।