Written By সম্পাদক
“আমার স্বদেশ বোবা হয়ে গেছে, আমার স্বদেশের ল্যারিংগো ট্রাকিয়াল চেম্বারে ভয়ঙ্কর ক্যান্সারের বীজ, তবুও আমার স্বদেশ, মাগো জমিয়ে রাখো একদলা থুতু, কফ বা পানের পিক, ছুঁড়ে দাও রাসপুটিন বিশ্বাসঘাতকের দিকে, যারা তোমাকে নিলামে চড়িয়েছে খোলাবাজারে, তাদের জন্য।’’
আজ এক রাসপুটিনের গল্প, সে গল্প বলতেও লজ্জা হয়, কারণ তার গায়ে আছে সাংবাদিকতার চাদর, মুখে টিভি অ্যাঙ্করের মাস্ক। হ্যাঁ অর্ণব গোস্বামীর কথাই বলছি, দু’দিন হল তাঁর এবং বার্কের প্রাক্তন প্রধান পার্থ দাসগুপ্তের মধ্যে করা হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ সামনে এসেছে। এনেছেন, বিখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ। মুম্বই পুলিশের দেওয়া ৪০০ পাতার চার্জশিটের ৫০ পাতাই নাকি, এই মেসেজ। কী জানা যাচ্ছে? পরিস্কার জানা যাচ্ছে যে, তেনারা দু’জনে মিলে রিপাবলিক ইন্ডিয়া বা রিপাবলিক ভারতের টিআরপি রেটিংয়ে, কারচুপি করেছিলেন। অন্য চ্যানেলকে ব্লক করা হয়েছিল, অন্য চ্যানেল যাতে দর্শক দেখতেই না পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, এবং তার বিনিময়ে কেবল পয়সা নয়, প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া অ্যাডভাইজর হবার আকাঙ্ক্ষা আর প্রতিশ্রুতিও ছিল। কার আকাঙ্খা? বার্কের কর্তা পার্থ দাসগুপ্তের, প্রতিশ্রুতি অর্ণব গোস্বামীর। কেবল এইটুকুর জন্যই তাকে হাজতে পোরা উচিত, যেমন পোরা হয় রেলে, কেন্দ্র সরকারের দফতরে, সরকারি যেকোনও অফিসে চাকরি করে দেবার জন্য প্রতিশ্রুতি দেওয়া দালালদের, এক্ষেত্রে অপরাধ আরও বড় কারণ এখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী, যিনি নিজেকে দেশের চৌকিদার বলে ঘোষণা করেছেন, যিনি বুক বাজিয়ে না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গার কথা বলেছেন। কোনওটাই হয়নি, কারণ অর্ণব এ যুগের রাসপুটিন, ক্ষমতার অন্দরমহলের দালাল, ক্ষমতার শীর্ষ শিখরে বসে থাকা মানুষগুলোর অনুগত, তাদের পয়সায়, দেওয়া সুযোগ সুবিধে দ্বারা লালিত, পালিত। তাদের হোয়াটস অ্যাপ বার্তায় প্রমাণিত যে তারা ক্ষমতার করিডোরের প্রত্যেকের সঙ্গে সাবলীল, তাদের হোয়াটস অ্যাপে যে নাম উঠে এসেছে তার মধ্যে প্রয়াত অরুণ জেটলি, স্মৃতি ইরানি, সাংবাদিক রজত শর্মা, প্রাইম মিনিস্টারস অফিসের নাম এসেছে, বার বার নাম করা হয়েছে এক এ এস এর, যিনি ক্ষমতার শিখরে বসে আছেন, সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা যার কাছে জানানো যায়, যিনি সিদ্ধান্ত নেবার মালিক। এই এ এস কে? অমিত শাহ? বা একটু অন্য দিক থেকে ধাঁধাটা সলভ করার চেষ্টা করা যাক, অমিত শাহ যদি না হন আর কে হতে পারেন এই সর্বশক্তিমান এ এস? প্রশ্ন আর উত্তর দুটোই সহজ, দুটোই জানা। কি অনায়াসে এই কথোপোকথনে বলে দেওয়া হল, রজত শর্মা তো পিএমওতে পৌঁছতেই পারেন না, বলা হল প্রকাশ জাভড়েকর কোনও কাজের নয়, বলা হল পিএমওতে অর্ণবের কি অনায়াস যাতায়াত, যোগাযোগ, ক্ষমতার অলিন্দে তিনি কত বড় মুরুব্বি তা প্রকাশ করলেন। জানা গেলো টেলিকম অথরিটিজ অফ ইন্ডিয়া যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা অমান্য করার, তাকে বাতিল করার সিদ্ধান্ত তৈরি হচ্ছে কোথা থেকে, কিভাবে কারা কারা মিলে এই প্রস্তাবকে ভূমিষ্ঠ হবার আগেই শেষ করে দেবে! তাহলে এই সংস্থার থাকার দরকারটা কী? আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় সংস্থা তৈরি হবে, সংস্থা কাজ করবে, আমাদের পয়সায় তাদের বেতন, অফিস, গাড়ি। অথচ তাদের প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ দুটো তিনটে মানুষের হাতে, তারা চাইলে রাখবে না চাইলে বাতিল করে দেবে। ওদিকে বার্কের কর্তা, বার্কের গোপন চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন অর্ণবের কাছে, মিলিভগত, কনাইভেন্স, আমরা বাংলায় বলি, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। একে অন্যের হয়ে কাজ করছেন, সুবিধে দিচ্ছেন, সুবিধে নিচ্ছেন। ওই যে থেকে থেকে চিৎকার করে ওঠা, আমাদের চ্যানেল হল এক নম্বর, আমাদের চ্যানেলের টিআরপি সব্বার থেকে বেশি, এই চিৎকারের পেছনে আছে জালিয়াতি, এই হোয়াটস অ্যাপ চ্যাটে তা পরিস্কার।
এতক্ষণ যা বললাম, তাতে ক্ষতি কার? লাভ কার? লাভ পার্থ দাসগুপ্তের, তিনি টাকা পেয়েছেন, তা দিয়ে সোনা ইত্যাদি কিনেছেন, যা মুম্বই পুলিশ বাজোয়াপ্ত করেছে, অর্ণবের লাভ, তার চ্যানেল এক নম্বর হয়েছে পেছনের দরজা দিয়ে, নিউজ ব্রডকাস্টারস অ্যাসোসিয়েশনের ক্ষতি, কিছু চ্যানেলের ক্ষতি, তারা বিজ্ঞাপন কম পাবে, শাসকদলের লাভ, তাদের পোষা মিডিয়া তৈরি হচ্ছে, তারা প্রচার করছে, তাদের ঢাক পেটাচ্ছে। আম জনতা সত্য খবরের থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এই মাত্র। আর কিছু নয়। সরাসরি আমজনতার গায়ে লাগার মত বিষয় নেই, অন্তত এই পর্যন্ত।
কিন্তু এরপর এই হোয়াটস অ্যাপ কথোপকথন থেকে যা পাওয়া গেলো, তা শুনলে হাড় হিম হয়ে যাবে, বোঝা যাবে এই সরকার শাসক দলের দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ আসলে এক ভড়ং, আসলে এক নৌটঙ্কি, যার আড়ালে তারা তাদের শাসন চালিয়ে যেতে চায়, তারা দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে গদিতে বসে থাকতে চায়, এটাই তাদের লক্ষ্য।
এই কথপোকথনে উঠে এসেছে সেই কথা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯ দেশবাসী চমকে গিয়েছিল, ভয় পেয়েছিল, দুঃখ পেয়েছিল পুলওয়ামার ঘটনায়। ৪০ জন জওয়ান মারা যান, সে ঘটনায় কারা দায়ী তা আজও সামনে আসেনি, কিভাবে এই বিস্ফোরণ ওই হাই সিকিউরিটি জোনে ঘটানো হল, তার কোনও উত্তর নেই আজও, জানা নেই কোন কোন মাথারা ছিল এর পেছনে। গোয়েন্দারা কোনও খবরই কেন পেলেন না, এসব নিয়ে কোনও কথাই হল না, দু বছর কেটে গেছে, সরকার এ নিয়ে একটা কথাও বলছে না। কিন্তু এটা জানা যে ২৬ ফেব্রুয়ারি সার্জিকাল স্ট্রাইক হয়েছিল, তার সফলতা নিয়ে হাজার একটা প্রশ্ন থাকলেও, সাধারণ মানুষ এই সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে উল্লসিত ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে এয়ার মার্শাল কুমার জানিয়েছিলেন, যে এই সার্জিকাল স্ট্রাইকের সবথেকে বড় ব্যাপার ছিল এর গোপনীয়তা, কেউ বোঝার আগেই আমরা আক্রমণ করেছি, বড় ক্ষয়ক্ষতি এড়াবার সময়ই পায়নি পাকিস্তান। কে বলছেন? একজন এয়ার মার্শাল, এয়ার মার্শাল কুমার, তাঁর অবসর নেবার আগে পার্টি করার নামে হাজির ছিলেন সেই মিটিংয়ে, এবং তাঁর ভাষায় ৩/৪ জন ছাড়া কেউ জানতো না এই আক্রমণের কথা, এমন কি এয়ারফোর্সের অন্য উইং বা উচ্চপদস্থ লোকজনও জানতেন না, কিন্তু অর্ণব জানতো। ১৪ তারিখ সে বার্ক কর্তাকে জানাচ্ছে, যে তারা ২০ মিনিট আগে এই পুলওয়ামা অ্যাটাকের খবর দেখাতে পেরেছে, এই আক্রমণের ফলে যে মোদী নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে, তার লাভ হবে, অবশ্যই রাজনৈতিক লাভের কথাই অর্ণব বলছেন, ঘটনার অব্যবহিত পরেই জঙ্গি জাতীয়তাবাদী অর্ণব উল্লসিত, এই আক্রমণের ফলে তার প্রভুর লাভ হবে, পলিটিক্যাল গেইন। তিনি বলছেন, দিস অ্যাটাক, উই হ্যাভ ওন লাইক ক্রেজি, এই আক্রমণের ফলে আমাদের জয় সুনিশ্চিত, কখন বলছেন? ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৫ টা ৪৩ এ। মানে পুলওয়ামার সেই রাস্তাতে তখনও রক্ত, আহতরা হাসপাতালে কাতরাচ্ছে, মৃতদের সবার বাড়িতে খবর পৌঁছয়নি, ঠিক তখন দেশের নাকি এক নম্বর চ্যানেলের, নাকি বিখ্যাত সাংবাদিক, অর্ণব গোস্বামী উল্লসিত, তাঁর প্রভুর পক্ষে মানুষের সমর্থনের ঢল নামবে, লাশের রাজনীতি। উলটো করে ঝুলিয়ে পেটানোটা আইন সম্মত নয়, তবে এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে নিয়মের ব্যতিক্রম তো থাকতেই পারে। এখানেই শেষ নয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ওই অর্ণব লিখছে, বিরাট বড় কিছু একটা হতে চলেছে, বার্ক কর্তা পার্থ লিখছে, দাউদকে গ্রেফতার করা হচ্ছে নাকি? অর্ণবের জবাব, না না পাকিস্তানে হবে, বড় কিছু একটা করা হবে। পার্থ লিখছে, ভাল, খুব ভাল, এই সময়ে আমাদের বড় নেতার জন্য এটা খুব ভালো, নির্বাচন সুইপ করবে, স্ট্রাইক নাকি আরও বড় অপারেশন? মানে পরিস্কার প্রশ্ন, আর্মি স্ট্রাইক করবে নাকি যুদ্ধ? কবে প্রশ্ন করা হচ্ছে? অপারেশন বালাকোটের তিন দিন আগে অপারেশনের কথা কে বলছে? অর্ণব গোস্বামী। বলছে, Bigger than a normal strike, and also on the same time something major on Kashmir, On Pakistan the government is confident of striking in a way that people will be elated. Exact word used. সাধারণ আক্রমণের থেকে বড়, আর তার সঙ্গেই কাশ্মীরে বড় একটা কিছু। পাকিস্তানে যা হবে তাতে মানুষ খুব খুশি হবে। ঠিক যা বলেছে তাই বললাম।
মানে অর্ণব বলছে এই খবর তাকে যিনি দিয়েছেন, সেই কথাগুলোই তিনি বলছেন। এর তিন তিন দিন পর বালাকোট সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হল। শ্রীনগরে নাকি পুলওয়ামার জন্য দায়ী এক জঙ্গিকে ঘিরে ধরে এনকাউন্টারে মারা হল। যা যা অর্ণব ২৩ তারিখে বলেছিল, তাই তাই হল।
দেশ চলে গেছে রাসপুটিনদের হাতে, দালালদের হাতে, শিল্পী, গায়ক, অভিনেতা, লেখক, কবি, সাংবাদিক বিক্রি হচ্ছে কিলো দরে, সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষ নিজের স্বার্থ দেখে হামাগুড়ি দিয়ে পার করছেন বেড়া।
আর ওধারে দেখুন, মাথা তুলে লড়াই করছে কৃষকরা, আমাদের অন্নদাতারা। আপনি কোনদিকে? এখনই পক্ষ নিতে হবে, সময় বয়ে যায়।
কোন দিক সাথী কোন দিক তুই? কোন দিক বেছে নিবি বল?