Written By সম্পাদক
বিপ্লব, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ স্ক্রিপ্টেড হয় না। মানে আগে থেকে লিখে রাখা এক চিত্রনাট্যের মত হয়ে ওঠে না, তা হঠাৎই চমক নিয়ে আসে, বীরত্বের গাথা কিম্বা বিশ্বাসঘাতকতা হয়ে ওঠে যে কোনও মুহূর্তে। যে কোনও মুহূর্তে এক বিদ্রোহ সুনামি হয়ে আছড়ে পড়ে, তার গতি প্রকৃতির একটা আঁচ পাওয়া যায় বটে কিন্তু নির্ধারণ করা যায় না। পৃথিবীর কোনও ইতিহাসেই তা সম্ভব হয়নি। এক ফরাসি বিপ্লব দিক পাল্টেছে নয় নয় করে ১৩ বার। প্রত্যেকবার তার চেহারা ছিল নতুন, নতুন ছিল তার ভাষা। বিদ্রোহ বিপ্লব কারোর ইচ্ছে খুশি মতন চলে না, তা এক সমষ্টির উৎসব। জয় পরাজয়, সফলতা ব্যর্থতা মিলিয়ে মিশিয়ে মানুষের উৎসব। এর মধ্যে কোনও ষড়যন্ত্র নেই, কোনও রাখ রাখ ঢাক গুড় গুড় নেই, মানুষ দৌড়ে আসছে, দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান, রাজা চিৎ হয়ে পড়ল না পড়ে চিৎ হয়ে গেলো, তা নিয়ে কারোর মাথাব্যাথা থাকে না।
৬০ দিন ধরে কৃষকরা বসেছিলেন, সিংঘু বর্ডার, টিকরি বর্ডার, চিল্লা বর্ডার, লাখে লাখে কৃষক, উত্তর ভারতের কড়া ঠান্ডায় তাঁরা বসেছিলেন তো পিকনিক করতে নয়, সরকারের আনা ফতোয়া ফেরত নিতে হবে, তিনটে কৃষি আইন ফেরত নিতে হবে, মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের আইনী নিশ্চয়তা দিতে হবে, এই দাবি নিয়ে। ১০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন, ওই তাঁদের, আমাদের অন্নদাতাদের কারোর ভাই, কারোর বাবা, কারোর ছেলে। তাঁরা সরেনি, তারা নড়েনি। ১১ টা বৈঠক হয়েছে, প্রত্যেকবার তাঁদের নেতারা বলে এসেছেন তিনটে কৃষক আইন এমন কি স্থগিত করাটাও তাঁরা মেনে নেবেন না, তিনটে আইনকে বাতিল করতে হবে। পরিবর্তন নয়, পরিমার্জন নয়, স্থগিত নয়, বাতিল, বাতিল করতে হবে। কৃষকদের ম্যানেজ করা চেষ্টা হয়েছে, পারেনি। খালিস্থানি, দেশদ্রোহী বলা হয়েছে, ধোপে টেকেনি। তাঁরা ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবসে ট্রাক্টর নিয়ে দিল্লি যাবার কথা বলেছে, তাঁরা বলেছে আমাদের স্বদেশ, আমাদের সাধারণতন্ত্র, গণতন্ত্র ফেরত দাও। গতকালের ট্রাক্টর মার্চ তো কৃষি বিল ফেরত নেবার জন্য নয়, সে তো পুরো আন্দোলনের দাবি, গতকালের শ্লোগান ছিল রিক্লেইম আওয়ার রিপাবলিক, আমাদের সাধারণতন্ত্র আমাদের ফেরত দাও।
কতজন এসেছিলেন, পুলিশের হিসেব, আমাদের নয়, পুলিশ বলছে আড়াই লক্ষের বেশি ট্রাক্টর ছিল, ১০ লক্ষের মতন কৃষক ছিল। দিল্লি পুলিশ অনুমতি দিয়েছে আউটার রিং রোডের মধ্যেই থাকতে হবে, এদিকে আউটার রিং রোড মাত্র ৪৩/৪৫ কিলোমিটার। দু ফিট দূরত্বে একটা করে ট্রাক্টর রাখলে ট্রাক্টর র্যালি শুরুর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই র্যালির রাস্তা শেষ হয়ে যাবার কথা। তবুও র্যালি হয়েছে। ১০ লক্ষ মানুষ দিল্লি গেছেন, ট্রাক্টর গেছে। ঘটনা যেখানে ঘটেনি, সেখানকার শান্তিপূর্ণ ছবি দেখালে টিভি চ্যানেলের টিআরপি আসবে না, অতএব যেখানে টিয়ার গ্যাস চললো, যেখানে কৃষকরা ব্যারিকেড ভাঙলেন, যেখানে নিহাংরা ঘোড়া ছোটালো, যেখানে কৃষকরা মার খেলেন বা যেখানে পুলিশরা ছুটে পালালো, সেই ছবি সারা দিন ধরে দেখানো হল। ৯০ % শান্তিপূর্ণ ট্রাক্টর র্যালি শেষ করে তাঁদের ডেরায় পৌঁছল। ১০% ট্রাক্টর, কৃষক ব্যারিকেড ভেঙে ঢুকলেন আইটিওর কাছে, এমন কি লালকেল্লায়। সেখানে ঢুকে পড়লেন কৃষকরা,লালকেল্লার প্রধান গম্বুজে নয়, কিন্তু তলায় যেখানে ১৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন, সেখানে তোলা হল নিশান সাহিব। অর্থাৎ মাত্র ১০ % বেনিয়মকে নিয়ে, বিচ্যুতিকে নিয়ে সারাদিন মিডিয়া কথা বলে গেলো। বলা হল এরা লালকেল্লা দখল করতে এসেছিল, এরা লালকেল্লায় খালিস্থানি ঝান্ডা ওঠাতে এসেছিল, এরা আসলে দেশের সংবিধান বা গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবান নয়। আহা গোদি মিডিয়া পেল তাদের খোরাক, তারা সারাদিন তাই প্রচার করলো। এমন কি অর্ণব, যে নাকি জওয়ান মরলে ভোটের গিনতি করে, ঘুষ দিয়ে চ্যানেলের টিআরপি বাড়ায়, ক্ষমতার অলিন্দের এক নির্লজ্জ দালাল রাসপুটিন, সেও চিৎকার করছে দেখেছেন, দেখেছেন, এরা দেশদ্রোহী।
প্রথমত গতকাল ৯০ % ট্রাক্টর র্যালির মানুষজন, কৃষক, তাঁদের ঘরের মহিলা, বৃদ্ধ এমন কি শিশুরাও নিয়ম মেনে ট্রাক্টর র্যালি করেছে, সন্ধ্যায় ডেরায় ফিরেছে, ১০ শতাংশ এই গন্ডোগোল করেছে, বা তাতে সামিল হয়েছে। এরা কারা? পঞ্জাবের এক সংগঠন আছে কিসান মজদুর সংঘর্ষ সমিতি, এদের নেতা সতনাম সিং পান্নু, এনারা ২৫ তারিখ সন্ধ্যেতেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ভিডিও জারি করেছিলেন, আমরা দিল্লি পুলিশের স্ট্রিকচার মানবো না, আমরা রিং রোডেই যাবো। তাঁরা এটা পুলিশকে জানিয়েছিল, প্রকাশ্য সভায় বলেছিল, দেখুন, (https://youtu.be/6dAdVNe_rq8 5.05 থেকে ৫.৪৬ ), তাঁরা বলেছিল যে সংযুক্ত কিসান মোর্চা যা করে করবে, আমরা আমাদের মত করবো।
এই সংগঠনের লোকজন কোথায় ছিলেন? সিংঘু বর্ডারে ব্যারিকেডের এক ধারে পুলিশ অন্য ধারে সংযুক্ত কিসান মোর্চার ট্রাক্টর, তাঁবু। এই সংগঠনের ট্রাক্টর এবং লোকজন বসেছিলেন ব্যারিকেড পার করে পুলিশের দিকে, পুলিশ কেন তাঁদের বসতে দিল? জানা নেই। কিন্তু যখন ট্রাক্টর র্যালি শুরু হল, তখন এরাই প্রথম যাত্রা শুরু করল, কেবল করলো তাই নয়, খেয়াল করে দেখুন এঁরা সকাল ৮ টাতেই র্যালি শুরু করে দিল, সময় ছিল ১২ টা। পুলিশের অস্থায়ী ব্যারিকেড খোলার কথা ১২ টায় তার আগেই ব্যারিকেড ভেঙে চুরমার, বিভ্রান্তি পেছনের লোকজনেরও, এদিকে খবর সবাই দেখছে, উত্তেজনা ছড়ালো সর্বত্র। পুলিশ সব কিছু জানার পরেও এদের আটকালো না কেন? আগেই আটকালো না কেন? সেই সত্যিটা বাইরে এলে আসল ষড়যন্ত্র আর তাদের মাথাদের চিহ্নিত করা যাবে।
এরপরে লালকেল্লা। সেখানে দীপ সিং সিধু নামে এক নায়ক গায়ক ১৫ আগস্ট যেখানে প্রধানমন্ত্রী পতাকা তোলেন সেখানে একটা পতাকা তুলে দেয়। দীপ সিং সিধুর বিষয়ে পরে আসছি, আগে বলি পতাকা তোলার সঙ্গে সঙ্গেই মিডিয়াতে হুক্কা হুয়া, খালিস্থানি পতাকা তোলা হয়েছে, তাও আবার লালকেল্লায়। মূর্খ গোদী মিডিয়ার জানা নেই যে পতাকাটা হল নিসান সাহিব, যে কোনও গুরদ্বারার সামনে চলে যান, হলুদ রংয়ের তেকোণা পতাকা চোখে পড়বে, ভেতরে একটা চক্রের দুপাশে প্রথমে কৃপাণ আর তারও বাইরে দোধারা খড়গ। দোধারা খড়গ হল ন্যায় দন্ড আর নৈতিক, আত্মিক মূল্যবোধের প্রতীক, যার দুটো ধারই ধারালো, তারপর দুটো কৃপাণ, যা নাকি আত্মিক স্বাধীনতা আর রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতীক। শিখ ধর্মের অন্যতম অঙ্গ হল এই নিসান সাহিব। তো নিসান সাহিব কেন? লালকেল্লায় নিসান সাহিবই বা কেন? সত্যিই থাকা উচিত নয়, এক সেকুলার সরকারের অনুষ্ঠানে, সরকারি ভবনে ধর্মকে জোড়া হবে কেন? এ প্রশ্ন আমরা যারা সেকুলার তারা তুলতেই পারি, তুলছিও। কিন্তু বিজেপি সরকার এ প্রশ্ন কী করতে পারে? এ বছরের ২৬ জানুয়ারির প্যারেডে উত্তর প্রদেশের ট্যাবলোটা দেখুন, রামমন্দিরের, তাদের মুখে এ কথা মানায়? ওই শঠ প্রবঞ্চকরা আমাদের সেকুলারিজম বোঝাবে? তবে আর একটা তথ্য আপনাদের জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না। ১৯৭৯, আজ থেকে ৪২ বছর আগের ঘটনা, ২৬ শে জানুয়ারির প্যারেডে শিখ রেজিমেন্ট হাঁটছিলেন, বিজয় চক থেকে লালকেল্লা। রাস্তায় রাজপথ, কে জি মার্গ, কনট প্লেস, মিন্টো ব্রিজ, রামলীলা গ্রাউন্ড, চৌরি বাজার, কিনারি বাজার, শিশগঞ্জ গুরদ্বারা সাহিব, চাঁদনি চক হয়ে শিখ রেজিমেন্ট পৌঁছবে লালকেল্লা। সেদিন শিখ রেজিমেন্ট এর সামনে ব্রিগেডিয়ার ইন্দ্রজিৎ সিং গাখাল। যেখানে রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যেখানে জাতীয় পতাকা তোলার পর এক একটা রেজিমেন্ট আসবে আর তাঁদের দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার কমান্ড দেবেন ডাইনে দেখ, তাঁর তরোয়ালটাকে ডান ধারে নামাবেন, সৈন্যরা ডানধারে স্যালুট দেবে, তারপর চলে যাবে। এটাই রীতি। কিন্তু সেদিন ব্রিগেডিয়ার গাখাল প্রথমবার কমান্ড দিলেন রাষ্ট্রিয় পতাকার সামনে এসে, সৈন্যরা স্যালুট সিল, দ্বিতীয়বার গাখাল কমান্ড দিলেন শিশগঞ্জ গুরদ্বারার নিসান সাহিবের সামনে। সেই থেকে এখনও ২৬ শে জানুয়ারি শিখ রেজিমেন্ট দুবার স্যালুট দেয়, অন্যদের মত একবার নয়। তাঁরা একবার স্যালুট দেন রাষ্ট্রীয় পতাকাকে, তারপর স্যালুট দেন নিসান সাহিবকে। যেখানে যেখানে শিখ রেজিমেন্টের ডেরা আছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় পতাকার নীচেই থাকে নিসান সাহিব। গতকালও লালকেল্লার প্রধান গম্বুজে উড়ছিল জাতীয় পতাকা, নীচে ছিল নিসান সাহিব। সেই নিসান সাহিব তুললো কে? ২০১৯ এ গুরুদাসপুরের সাংসদ সানি দেওলের ডান হাত দীপ সিং সিধু, সব্বাই জানে, অজস্র ছবি আছে। এমন কি ছবি আছে আমাদের প্রধান সেবক নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদীজীর সঙ্গে, না না, ওই সাতে পাঁচে থাকি না দাদার মত টুক করে তোলা সেলফি নয়, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে তাঁর সঙ্গে বসে তোলা সেলফি। তার মানে এজেন্ট প্রোভোকেটরদের, গোলমাল পাকানেওলাদের তৈরি করেই মাঠে নেমেছিলেন মোদীজি, মোটাভাই, কেবল ধরা পড়ে গেছেন এই যা।
বিজেপি আরএসএস, বিজেপির আই টি সেল ইত্যাদি এবং তাদের হুক্কা হুয়া বাহিনী গোদী মিডিয়া প্রশ্ন তুলছেন ওয়াদা খেলাফির। সংযুক্ত কিসান মোর্চা আর দিল্লি পুলিশের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল যে তাঁরা আউটার রিং রোডেই শান্তিপূর্ণভাবে ট্রাক্টর র্যালি করে ফিরে যাবে। তাঁরা সেই চুক্তি না মেনে নাকি জঘন্য অপরাধ করেছেন। কারা বলছে এ কথা? দেশের মানুষ কি ভুলো ভোলানাথ? সব্বাই কি সব ভুলে গেছে? এই সেই আরএসএস বিজেপি যারা আদালতে এফিডেবিট করে জানিয়েছিল, তারা বাবরি মসজিদের কোনওরকম ক্ষতি না করে কেবল পুজো করেই ফিরে যাবে, কী করেছিল তারা? কতটা পরিকল্পনা করে, ষড়যন্ত্র করে দেশের আদালতের কাছে মিথ্যে বলে ধ্বংস করেছিল এক শতাব্দী প্রাচীন ইমারত। তাদের মুখে ওয়াদা খেলাফির কথা? সাপের মুখে অমৃতের কথা? ভূতের মুখে রামনামের কথা? একটা বর্বর মধ্যযুগীয় দল, যাদের সংবিধান, জাতীয় পতাকা, জাতীয় ঐতিহ্য কোনওটার ওপর বিন্দু মাত্র ভরসা নেই, সামান্যতম সুযোগে যা তারা নিলামে তুলতে পারে, তারা বলছে ওয়াদা খেলাফির কথা। মানুষ বিচার করবে। বিপ্লব বিদ্রোহের স্ক্রিপ্ট কেউ লিখে দেবে না, তার নিজস্ব গতি আছে, তার গতিতেই সে চলবে।
জানিয়ে দিই, কৃষকনেতারা বসে আবার জানিয়েছেন লোকসভার বাজেট অধিবেশনের দিন কৃষকরা এবার যাবেন সংসদ ভবনের সামনে, দাবি তিনটে কৃষি আইন বাতিল করতে হবে, এম এস পি র লিগ্যাল গ্যারান্টি দিতে হবে। মোদীজি দিন গুনুন, পয়লা ফেব্রুয়ারি কৃষকরা কড়া নাড়তে আসছে। প্রমাণিত সত্য, ট্রাক্টর কেবল চাষের কাজে লাগে না, ট্রাক্টর দেশ মেরামতির জন্যও খুউউউব দরকার।