Written By অনিরুদ্ধ সরকার
রাজা ভূপিন্দর সিং ও তার স্বপ্নের চেইল শহর
হিমাচলের রাজার সঙ্গে ব্রিটিশ সেনাপতির মেয়ের প্রেম বেশ জমে উঠেছে। ভ্যালেন্টাইন ডে’টা তারা কাটাবেন হিমাচলের পাহাড়ি ঢালে, উদার আকাশের নিচে। হাজারো কথা, হাজারো গল্প, গোপনে দেখাশোনা সবই চলছিল বেশ। এদিকে কানাঘুসো-ফিসফাস থেকে সারা সিমলা শহরময় চাউর হয়ে গেল সে কথা। মেয়ের এই প্রেমপর্বের কথা কানে গেল ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফ লর্ড কিচেনার-এরও। ব্রিটিশ কমান্ডার সব শুনে পাতিয়ালার মহারাজ ভূপিন্দর সিং-কে চিরদিনের জন্য নির্বাসিত করলেন। অপমানিত রাজা প্রতিশোধ নিলেন অন্য পথে। খুঁজে বের করলেন এমন একটি পাহাড়ি জায়গা যার অবস্থান ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত সামার ক্যাপিটাল সিমলার দিগন্তরেখায়, অথচ তার চেয়েও বেশ খানিকটা উঁচুতে। পাতিয়ালার মহারাজা পাহাড়ের মাথায় খুঁজে পান ছোট্ট গ্রাম চেইলকে এবং ঠিক করেন এখানেই তিনি তৈরি করবেন তাঁর গ্রীষ্মকালীন আবাস। চারদিকে দেবদারুর ঘন জঙ্গল। জায়গাটি সিমলা থেকে সামান্য উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় এখান থেকে শীতের সিমলাকে খুব সুন্দর দেখায়। আজ তাঁর সব সৃষ্টিই গবেষণার বিষয়। প্রাসাদে সুসজ্জিত আসবাবপত্র। কটেজ আর কুঁড়েঘরগুলি আজও যেন সেই একইরকম সুন্দর! ঘন জঙ্গল, ফলের বাগানে ঘেরা এই অঞ্চলটি যেন ‘লাভার্স হিল’। হিমেল হাওয়া জড়ানো পাহাড় ঘেরা শিমলার অনবদ্য পিকচার পোস্টকার্ড
এভাবেই সিমলা থেকে ৪৫ কিমি দূরে ৭,০৪৫ ফুট উঁচু চেইল-এ ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠল পাতিয়ালা মহারাজের গ্রীষ্মকালীন আবাস। ২ বছর বাদে ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশদেরকে আরও একবার টেক্কা দিয়ে ৭,২১৮ ফুট উঁচুতে ক্রিকেটপ্রেমী ভূপিন্দর সিং বানালেন বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্রিকেট পিচ ও পোলো খেলার মাঠ। বিলাসী সম্রাট ভূপিন্দরের তীব্র আসক্তি ছিল নারীদের প্রতি। কেউ বলেন তার ৫ জন কেউ বা বলেন তার ১০ জন স্ত্রী ছিল। আর সন্তান ছিল ৮৮ জন। আর ছিল বিশাল হারেম। তিনিই প্রথম ভারতবাসী যিনি কিনেছিলেন আস্ত একটা এয়ারলাইন্স। মালিক হয়েছিলেন ব্রিটিশ ওই উড়ান সংস্থার। ১৯২৬ সালে এক ট্রাঙ্ক ভর্তি মণি মাণিক্য তিনি পঠিয়েছিলেন ফরাসি অলঙ্কার নির্মাতা কার্তিয়ের-কে। পেটিকায় অন্য দামী পাথরের সঙ্গে ছিল বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম হিরে। সেসব দিয়ে তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত পাতিয়ালা নেকলেস। তখনই এর দাম ছিল ২৫ মিলিয়ন ডলার। বিলাসিতায় মহারাজের কোনো কার্পণ্য ছিল না। মহারাজার শখ ছিল আকাশচুম্বী। পাতিয়ালার মতিবাগ রাজপ্রাসাদে ভূপিন্দর সিংয়ের জন্ম। আইচিসন কলেজে পড়াশোনা সম্পন্ন করেছেন। ৯ বছর বয়সে স্বীয় পিতা মহারাজা রাজিন্দর সিংয়ের দেহাবসানের ফলে ৯ নভেম্বর, ১৯০০ তারিখে পাতিয়ালার মহারাজার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত হন। নাবালক থাকায় আঠারো বছর বয়স হবার পূর্ব-পর্যন্ত রাজপ্রতিনিধিত্বকারী সংঘ তার পরিবর্তে দায়িত্ব পরিচালনা করে। ১ অক্টোবর, ১৯০৯ তারিখে আংশিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। পরে ৩ নভেম্বর, ১৯১০ তারিখে ভারতের ভাইসরয় পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা ভার প্রদান করেন। পাতিয়ালার মহারাজা ভূপিন্দর সিং ব্রিটিশ ভারতের পাতিয়ালার মতিবাগ রাজপ্রাসাদে ১৮৯১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০০ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সাবালক হওয়ার পরে তাঁকে দেওয়া হয় ব্রিটিশ শাসনের অধীনে পাতিয়ালা স্টেটের পূর্ণ শাসন ভার। পাতিয়ালার মহারাজা নামেই পরিচিতি পান। তবে অমিতব্যয়িতা ও ক্রিকেটের প্রতি একনিষ্ঠতাই অধিক পরিচিতি এনে দিয়েছে তাঁকে। কেননা তিনি ছিলেন প্রথম-শ্রেণির ভারতীয় ক্রিকেটার।
কর্মজীবনে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও ইতালিতে জেনারেল স্টাফ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সম্মান সূচক লেফটেন্যান্ট কর্নেলের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৮ সালে সম্মান সূচক মেজর জেনারেল ও ১৯৩১ সালে সম্মান সূচক লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উপনীত হন। ১৯২৫ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। ভারতীয় প্রিন্সেস চেম্বারে ১৯২৬ থেকে ১৯৩৮ সময়কালে ১০ বছর চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইম্পেরিয়াল ওয়্যার কাউন্সিল এ তিনি ছিলেন ভারতীয় প্রতিনিধি। শিখদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন গোল টেবিল বৈঠকে। রনজি ট্রফির জন্যেও বহু কাজ করেছেন। নিজে তত্কালীন ভারতীয় ক্রিকেট দলে খেলেওছেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ পাতিয়ালার। তাঁর আমলে পাতিয়ালায় চলত মনোরেলও।
সিমলার চেইলে ম্যাল নেই, প্রচুর দোকানও নেই, কিন্তু নির্জনতা বিলাসীদের জন্য আছে অফুরন্ত অবসর, অলস বয়ে চলা সময়। ভিড়জমাট সিমলা থেকে মুক্তি পেতে পরিযায়ী পাখীর মতো দলে দলে পর্যটক গ্রীষ্মে এখানে পা রাখেন। তবে শীতে সে তুলনায় প্রায় ফাঁকাই থাকে নিঝুম চেইল। ঘুমন্ত এক স্বপ্নালু রাজকুমারীর মতো তখন সে। পানধাওয়া, রাজগড় ও সিধটিব্বা– চেইল-এর বিক্ষিপ্ত পাহাড় তিনটি তুষারের আলিঙ্গনে ধবধবে সাদা। নরম বরফে ঢেকে আছে শহরের রাস্তা। হিমেল চাঁদনি রাতে জ্যোৎস্না যখন গলানো রূপো হয়ে ঝড়ে পড়ে, হোটেলের ঘরে বসে সে দৃশ্যে নিজস্ব ভুবন গড়েন নববিবাহিত দম্পতিরা। পাহাড় তিনটিতেই আছে গুরুদোয়ারা সাহিব, সিধবাবার মন্দির, ক্রিকেট মাঠ, সামার প্যালেস-সহ বেশ কিছু দ্রষ্টব্য। সিমলা তো বটেই রাতের আলোকিত কসৌলিও অসাধারণ চেইল থেকে। চির, পাইন, দেবদারু, রডোডেনড্রন আর ওক গাছে ছাওয়া এই লিটল মাউন্টেনস হেভেন-এ পাখিও মেলে বিস্তর। শহরে ঢোকার মুখে রেঞ্জ অফিস। সেখান থেকে অনুমতি নিয়ে দেখে নিন লেপার্ড, বন্য শুয়োর, গয়াল, সম্বর, হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার-সহ নানা পশুপাখি সমৃদ্ধ ছোট্ট অভয়ারণ্য, যা একদা ছিল রাজাদের মৃগয়াভূমি। ভারত স্বাধীন হওয়ার অনেকদিন পর পর্যন্ত রাজার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ৭৫ একর জমি-সহ ছোট্ট এই পাহাড়ি শহরটিকে হিমাচল পর্যটন দফতর অধিগ্রহণ করে ১৯৭২ সালে। চেইল থেকে কয়েকটি ট্রেকিং রুট রয়েছে। ‘দ্য মাউন্টেন অফ দ্য সিলভার ব্যাঙ্গেলস’ অথবা বরফাবৃত চোর চাঁদনি পর্বতশৃঙ্গ এখান থেকে অসম্ভব সুন্দর ভাবে ধরা দেয়।
হিমাচল প্রদেশের রাজধানী শহর ‘পাহাড়ের রানি’ সিমলা যাওয়ার পথে প্রায় ৯৬ কিলোমিটার যাত্রা পথে ১০৩টি টানেল পেরোনোর রোমাঞ্চ তো আছেই, সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে মিলবে সারা পথের অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য। সিমলা শহরটি আপার, মিডল ও লোয়ার—তিনটি স্তরে সাজানো। আপার মলের প্রাণকেন্দ্র স্কান্ডাল পয়েন্টে অবস্থিত পুরোনো ধাঁচে গড়া একটা হোটেলে উঠলাম। পরদিন সকালে জানালা খুললেই পাবেন এক অপূর্ব দৃশ্য—উন্মুক্ত আকাশ, শান্ত স্তব্ধতা। ব্রিটিশ আমলের ইউরোপীয় স্থাপত্যে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকাগুলো নজর কাড়বে। ব্রিটিশ সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানীতে অভিজাত লন, ব্যাডমিন্টন ও টেনিস কোর্ট, বিলিয়ার্ড, চিলড্রেন পার্ক কী নেই? যাঁরা কোলাহল থেকে বেরিয়ে একটু নিরিবিলিতে সময় কাটাতে চান তাঁদের কাছে চেইল একদম আদর্শ জায়গা। মাছ ধরা বা ট্রেকিংয়ের পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ক্রিকেট ও পোলোর মাঠ রয়েছে এখানেই। ঠান্ডাকে উপভোগ করতে করতে মহারাজা ভূপিন্দরের বিলাসী জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে পড়ুন চেইল সফরে।
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে কালকা। কালকা থেকে টয়ট্রেনে যেতে পারেন সিমলা। তবে চণ্ডীগড় থেকে সিমলার দূরত্ব ৯০ কিমি। যাঁরা বিমানে যাবেন তারা দিল্লি থেকে ট্রেনে অথবা গাড়িতে চলুন সিমলা।
কোথায় থাকবেন
সিমলায় থাকার জন্য রয়েছে হিমাচল পর্যটন দফতরের হোটেল দি হলিডে হোম এছাড়া পাবেন একাধিক হোটেল, রিসর্ট।