Written By সম্পাদক
নির্বাচন আসছে, টুম্পাকে তার বয়ফ্রেন্ড বিগ্রেডে নিয়ে যাবে, এটা জানা ছিল না, কিন্তু এখন জানা গেছে যে টুম্পাকে কেবল নিয়েই যাবে না, টুম্পাকে নিয়েই তার বয়ফ্রেন্ড বিগ্রেডে চেন ফ্ল্যাগ লাগাবে, টুম্পাকে ঘুড়ির মত উড়িয়ে দিলেও, লাটাইটা ধরে থাকবে তার বয়ফ্রেন্ড। এসব জানা হল, কিন্তু এটা জানাই ছিল যে, নির্বাচনের মুখে রাজ্যজুড়ে প্রতিশ্রুতির বাণ বইবে, বইছেও। নির্বাচন বলেই তো রাজ্য সরকার পেট্রল ডিজেলের শুল্ক ১ টাকা করে কমিয়ে দিল, অবশ্যই মানুষের লাভ, তা গণতন্ত্রে সরকার সারা বছরজুড়ে মানুষের জন্য কাজ করবে, নির্বাচনের আগেও কিছু বেশি কাজ করবে, ক্ষতি কী? আমার আপনার পকেটে যদি কিছু আসে, তাহলে ক্ষতি কী? এখন যদি দেখা দেখি কেন্দ্রীয় সরকার ২ টাকা শুল্ক কমিয়ে দিত, এক ধাক্কায় গ্যাসের দাম ৩০/৪০ টাকা কমিয়ে দিত, কী ভালই না হত। কিন্তু কমায়নি, কমানোর কোনও লক্ষণ ও নেই, গ্যাস বেলুনের মত সে সবের দাম ঊর্ধমুখী। তাহলে মোদীজি করছেন টা কী? উদ্বোধন করছেন, ওই বিগ্রেড চলো বা চেন ফ্ল্যাগে মাঠ সাজানোর মতনই নির্বাচনের আগে বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন হয়, সে সব নানান প্রকল্পের শিলান্যাস হয়, সে সব শিলালিপি পড়ে থাকে, বছর ঘরে, আবার নির্বাচন হয়, আবার শিলান্যাস হয়। এমনি নেতাদের তো ছেড়েই দিন, কাজ করেন এমন নাম ডাক আছে, সেই নীতীশ কুমার একটা প্রকল্পের তিনবার উদ্বোধন করেছেন, এমন উদাহরণও আছে। তো মোদীজির ব্যাপারটাকে কিন্তু তার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না, একদম নয়, উনি অত কাঁচা কাজ করছেন না। শিলান্যাস হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তারা টাকাও বরাদ্দ হয়ে যাচ্ছে, প্রকল্পের কাজ শুরু হচ্ছে। তাহলে ভক্তোঁদের, বিজেপির দলবদলুদের মনে হতেই পারে বা বেশ তো, অ্যাদ্দিন পরে আমি পথে এসেছি। দেকেচো, ইনিও লাল নীল গেরুয়া, মোদীজি প্রকল্পের উদ্বোধনই কেবল করছেন না, তার জন্য অর্থ বরাদ্দও করছেন, প্রকল্প হবে, হোক না নির্বাচনের আগে, মানুষ এর তো লাভ হবে! ওইখানে আখের গুড়ে কাঁচের গুঁড়ো, গ্যামাক্সিন। মোদীজি ইজ মোদীজি, থাকিলে ডোবাখানা, হবেই কচুরিপানা, বাঘে হরিণে খানা একসাথে খাবে না, স্বভাব তো কক্ষনো যাবে না, আ মরি স্বভাব তো কক্ষনো যাবে না। আসুন, এই উদ্বোধন আর তার পেছনের গল্প নিয়ে কিছু কথা বলা যাক, যাকে বলে চোলি কে পিছে ক্যায়া হ্যায়, জেনে নেওয়া যাক!
নির্বাচন তো কেবল বাংলায় নয়, নির্বাচন হবে চারটে রাজ্যে। আবশ্য নির্বাচনই যে কেন হবে তাও বোঝা শক্ত, কারণ বিজেপি তো কেবল নির্বাচনে জেতে না, নির্বাচনে না জিতলেও ঘোড়া গোরু কেনা বেচা করে সরকার তৈরি করায় তেনারা সাক্ষাৎ বিশ্বকর্মা, এখন পন্ডিচেরি নিয়ে পড়েছেন, আবদার ওটাও চাই, ভেঙেও দিলেন পন্ডিচেরি বিধানসভা। কিনে নিল কিছু গোরু ঘোড়া, যেমন আপাতত কিনছে এরাজ্যে, দল ভাঙিয়ে লোক জড় করায় বিজেপির দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তো যে কথা বলছিলাম, নির্বাচন হবে চারটে রাজ্যে, কেরল, তামিলনাড়ু, অসম আর আমাদের বাংলায়। তাই নির্বাচনের আগে ঘোষণা, প্রতিশ্রুতি এবং প্রকল্পের উদ্বোধন চার রাজ্য জুড়েই চলছে। আর মাথায় রাখুন, অসম ছাড়া বাকি তিনটে রাজ্যতে বর্তমান বিধানসভাতে তারা নগণ্য, কোনও শক্তিই নয়, তারা নেহাতই এলেবেলে, কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে এমন প্রচার হচ্ছে যেন তিনটে রাজ্যতেই বিজেপি সাংঘাতিক কিছু করে ফেলবে, অসম জুড়ে এনআরসি বিরোধী বিক্ষোভের কথা মিডিয়া ভুলে গেছে, মুখ্যমন্ত্রীর ছাদ টপকে জান বাঁচানোর কথা ভুলে গেছে, যে বিক্ষোভ দেখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে তাঁর সফর বাতিল করেন, সেই ঘটনা সংবাদ মাধ্যম ভুলে গেছে, এবং মনে করছে যে মানুষও সব ভুলে গেছে, জানেই না যে রাতের সব তারা রয়েছে দিনের আলোর গভীরে, এনআরসি’র প্রথম চোট তো পড়েছিল অসমে, কেবল মুসলমান মানুষ নয়, হিন্দু মানুষজনের ওপর পড়েছিল বড় কোপটা। নির্বাচন আসছে, তার বহু আগেই আসম গেয়েছিল, সব কুছ ইয়াদ রক্ষা যায়গা! চার রাজ্যেই মোদীজির প্রকল্প উদ্বোধনের ছড়াছড়ি। সম্ভবত, পৃথিবীর কোনও প্রধানমন্ত্রী ৭২ ঘন্টার মধ্যে এত প্রকল্পের উদ্বোধন করেননি, মোদীজি করলেন!
আসুন, প্রথমে কেরলের প্রকল্পের দিকে তাকানো যাক। কেরলে তিনি উদ্বোধন করলেন, পেট্রো কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, কাদের? বিপিসিএলের? ভারত পেট্রোলিয়াম কোম্পানি লিমিটেড, পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং, পিএসইউ। সেপ্টেম্বরে বিক্রি হবে, যে সব পিএসইউ বিক্রি হবে তার তালিকার মধ্যে, সবথেকে ওপরে আছে এই বিপিসিএল, তো মোদীজি জানেন যে এই রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বিক্রি হয়ে যাবে, এরপরেও সেখানে আমার আপনার ট্যাক্সের টাকা, ঢালা হচ্ছে কেন? কারণ যিনি নতুন মালিকানায় বসবে, তার সুবিধে হবে, এই নতুন মালিক আদানি না আম্বানি তা তো ঠিক করবে এই সরকার, এই প্রশাসন। কি সুন্দর ছক, তিনি আমাদের পয়সায় প্রকল্প উদ্বোধন করলেন, তারপর সেপ্টেম্বরে সেটাকে বেচে দেওয়া হবে। আসুন পরের প্রজেক্টে যাই, পরের প্রজেক্ট আরও সরেস, কোচিন পোর্ট ট্রাস্টে ইন্টারন্যাশন্যাল ক্রুইজ টার্মিনাল তৈরি হবে, মোদীজি উদ্বোধন করলেন, আমি নিশ্চিত যে আম্বানি, আদানি ইত্যাদি মোদীজির বন্ধুরা এরই মধ্যে বড়বড় লাইনার ক্রুইজ কিনে রেখেছেন, এবার তার ব্যবসাটা ওখান থেকে শুরু হবে, মোদীজি ইনফ্রাস্ট্রাকচার করে দিলেন, ওনারা কামাবেন, দেশের যে ৫/৭ % মানুষ কোটি টাকা খরচ করে ক্রুইজে চড়তে পারবেন, তাঁরা চড়বেন। আনন্দকে আনন্দ, ব্যবসাকে ব্যবসা। আর মাথায় রাখুন একের পর এক সি পোর্ট বেচে দেওয়া হচ্ছে, ঠিক এই মুহূর্তে মোদী সখা গৌতম আদানির হাতে কতগুলো সি পোর্ট বা জল জাহাজ বন্দর আছে? ১১ টা । গৌতম আদানির যে কোম্পানি এই বন্দর কিনেছেন, চালাচ্ছেন, সেটা কতদিনের পুরোনো? ২৬ এপ্রিল ২০১৬ তে এই কোম্পানির পথ চলা শুরু, এবং এই চার বছরের মধ্যে দেশের ১১ টা বন্দর ওনাদের হাতে চলে গেছে, বাকিগুলোও যে যাবে, সে কথা বলা বাহুল্য, যাবার আগে সেখানে আমার আপনার পয়সা লাগানো হচ্ছে, তারপর এ পোর্ট চলবে না, ধুঁকবে, সময় সুযোগ দেখে আদানিরা কিনে নেবেন, তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে? ওই যে সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, আদানি ব্যবসার অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে লিখেছিলেন, তাঁর নামে এখন গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি হয়েছে, স্বাভাবিক। তার মানে নির্বাচনে আগে মোদীজির প্রকল্প উদ্বোধন হল, রাজ্যের মানুষ জানলেন যে বিরাট কাজ হচ্ছে, এদিকে তা বেচে দেবার প্রক্রিয়াও জারি আছে। সব মিলিয়ে এক দারুণ প্যাকেজ! ৩২০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের উদ্বোধনে যাচ্ছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, ৩২০ কিলোওয়াট। আমাদের টালিগঞ্জে অনেকসময় একটা বড় সিনেমার স্যুটিংয়ে, ৬৪ কিলোওয়াটের ৪ টে জেনারেটর আনা হয়, মানে কতটা বিদ্যুৎ নিশ্চই বুঝতে পারছেন, কিন্তু বিরাট জমি দখল হয়ে গেছে সেখানে, পরে বেচে দিলে লাভ কিন্তু ওই জমি থেকে উঠে আসবে, হিসেব পাক্কা।
তামিলনাড়ুতে আবার সেই কাভেরি বেসিন রিফাইনারি, আম্বানির চোখ সেদিকে কতদিন ধরে পড়ে আছে, আপাতত আমাদের টাকা ওইখানে লাগানো হবে, ফসল কাটবে কে? সে আর বলতে? আপনারা প্রত্যেকেই বুঝে গেছেন, লুঠমার চলছে।
তামিলনাড়ু আর এই বাংলায় দুটো মেট্রো রেলের রুট বাড়ানো হল, তামিলনাড়ুতে ৯ কিলোমিটার, আর আমাদের এই কলকাতায় নোয়াপাড়া দক্ষিণেশ্বর, ৪.১ কিলোমিটার। রেলমন্ত্রী নন, উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী নিজে, সরকারি খরচায় নির্বাচনী প্রচার। করছেন করবেন। কিন্তু সমস্যা হল অন্য যায়গায়, এই সরকারের অর্থমন্ত্রী কী বলছেন? এই সরকার কী বলছেন? রেল চালানো সরকারের কাজ নয়, তাই ধীরে ধীরে এই রেল চালানোর ভার, তুলে দেওয়া হবে বেসরকারি সংস্থার হাতে। তুলে দেওয়া শুরুও হয়ে গেছে, তাহলে মোদীজি যেটা উদ্বোধন করলেন, সেটার টাকা কি কোনও ব্যবসায়ী দিয়েছেন? না দেননি, আমার আপনার পয়সায় তৈরি হচ্ছে এই রেলপথ, ওই তামিলনাড়ুতেই প্রধানমন্ত্রী ২৫ কিলোমিটার রেলপথের কাজ উদ্বোধন করলেন, ভালো মজা, তাই না? আমরা টাকা ঢালবো, আমাদের টাকা নিয়ে রেলপথ তৈরি হবে, তারপর সেই রেল চালিয়ে টাকা তুলবে বেসরকারি কোনও এক কোম্পানি, আগেই বলেছি, মোদীজি নিজেকে চালাক ব্যবসায়ী বলেই মনে করেন! তিনি কেবল বন্ধু বান্ধবদের ব্যবসা করার ক্ষেত্রটা তৈরি করে দিচ্ছেন, বাকিটা আম্বানি, আদানি, শরাফ, চোকসিরা দেখে নেবে, মজার কথা হল এই চার রাজ্যে যে কটা প্রকল্প মোদীজি উদ্বোধন করলেন তার সিংহ ভাগ হল, রেল, রিফাইনারি আর বন্দরের ইনফাস্ট্রাকচার, যে রেল রিফাইনারি আর বন্দর একে একে বেচে দেওয়া হবে, দেশের মুখের মানুষের হাসি নয়, মোদীজি দেখতে পাচ্ছেন পরিস্কার, ওই ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের, ওই পুঁজিপতিদের লোভে চকচক মুখচোখ, তারা হাসছে। পেছনের এই সত্য মানুষের জানা দরকার, জানা দরকার কিভাবে মানুষ ঠকাচ্ছে মোদী সরকার।