Written By সম্পাদক
এই নির্বাচনে, বিজেপি বিরোধী দলগুলোর একটা কমন শ্লোগান হতেই পারে যে, নির্বাচনের জন্য বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিন, বা নির্বাচন ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিন, প্রত্যেক বিজেপি বিরোধী দলের এটা কর্তব্য হওয়া উচিত, মানুষকে এটা বোঝানো যে, বিজেপি থাকলে নির্বাচন খতরে মে হ্যায়, বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে, এই নির্বাচনের ব্যবস্থাটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। ধরুন টাইপ রাইটার, আর নেই। কারণ টাইপ রাইটারের জায়গায় কমপিউটার এসে গেছে, যে ক’জন ধর্মতলায় বসে থাকতেন, বা আলিপুর কোর্টে বসে থাকতেন টাইপ রাইটার নিয়ে, তাঁরাও আজ আর নেই। ধরুন সেই ল্যান্ড ফোন, মোবাইল ফোন এসে ল্যান্ড ফোনকে বিপন্ন করে তুলেছে, জরুরি খবর আসতো টেলিগ্রামে, পিওন এসে টেলিগ্রাম বললেই বুকটা ধক করে উঠতো, মোবাইল আসার পর টেলিগ্রাম উধাও, মোড়ে মোড়ে ফোন বুথ নেই। এরকম হয়, একটা বিকল্প জনপ্রিয় হয়ে গেলে, আগেরটা উবে যায়। ঠিক সেই রকমভাবেই নির্বাচন ব্যবস্থার বিকল্প এসে গেছে, এবার নির্বাচনটা তুলে দিলেই হয়, মানে নির্বাচনের যদি কোনও দরকারই না থাকে, তাহলে মিছিমিছি এই টাকা পয়সা খরচ করে কী হবে? আর যদি মনে হয়, নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ, অন্যতম শর্ত, তাহলে বিজেপিকে মুছে ফেলতে হবে, বিজেপি দল গণতন্ত্র বিরোধী।
আসুন দেখা যাক, বিজেপির এই সাত বছর বা বলা ভাল তিন মাস কম সাত বছরে নির্বাচন ব্যবস্থার গুষ্টির পিন্ডি, কিভাবে চটকানো হয়েছে।
নির্বাচনের প্রয়োজন নেই, বিজেপি নির্বাচনের পরে গোরু ঘোড়া, থুড়ি এমএলএ কিনে সরকার ফেলে দিচ্ছে, বদলাচ্ছে, নিজেরা সরকারে বসছে। রীতিনীতি, নৈতিকতার কোনও বালাই নেই, বিরোধীদের রাখবো না। তেমন বিরোধী, যারা মিলেমিশে চলবে, যারা কেন্দ্রে বিজেপি সরকারকে ঘাটাবে না, তাদের ছাড় দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু কংগ্রেস বা বিজেপির বিরুদ্ধে সোচ্চার কোনও শক্তির সরকারকে, যে কোনও মূল্যে উৎখাত করা হবে, এটা বিজেপির সিদ্ধান্ত।
সবশেষের খবর, পন্ডিচেরির কংগ্রেস সরকার পড়ে গেলো। ২০১৬ তে নির্বাচিত হয়েছিল কংগ্রেস সরকার, ৩০ জনের বিধান সভায় তাদের বিধায়ক ছিল ১৫ জন, সমর্থনে ছিল ২ জন ডিএমকে, ১ জন নির্দল, মাহে থেকে নির্বাচিত সদস্য। এআইডিএমকেএমএলএ ছিল ৪ জন, আর কংগ্রেস ভেঙে নতুন দল এনআর কংগ্রেস পেয়েছিল ৮ টা আসন। বিজেপি? শূন্য। সরকার ফেলল কারা? মানে কাদের ভোটে সরকার পড়ে গেলো? কয়েকজন কংগ্রেস বিধায়ক সমর্থন তুলে নিলেন, নির্দল বিধায়কও সমর্থন তুলে নিল। কিন্তু তাতেও সরকার পড়তো না, আসরে নামলো ৪ জন মনোনীত বিধায়ক। হ্যাঁ এই তিন জন মনোনীত বিধায়কই বিজেপির, তাঁদের ভোটাধিকার আছে, তাঁরা মাঠে নামলেন, আগামী নির্বাচনের ঘোষণার মুখে সরকার পড়ে গেলো, নির্বাচিত সরকার পড়ে গেলো। পন্ডিচেরি বা পুদুচেরিতে বিজেপি নেই, কিন্তু রীতি হল রাজ্যপাল বা লেফটান্যান্ট গভর্নর তিন জন গণ্যমান্যকে নির্বাচিত করবেন, তা যে রাজ্যে একজন নির্বাচিত বিধায়ক নেই, সেই রাজ্যেই তিনজন মনোনীত বিজেপি বিধায়ক পাওয়া গেলো, এবং তাঁরাই মানুষের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিলেন, একেই বলে বিজেপির গণতন্ত্র।
আগেই বলেছি, বিজেপি আর তিনমাস পরে সাতবছর পূর্ণ করবে, নরেন্দ্র মোদীর সাত বছর পূর্ণ হবে, এরই মধ্যে তারা ৯ টা নির্বাচিত সরকার ভেঙেছে, কোথাও কোথাও নিজেরা ক্ষমতায় এসেছে। অর্থাৎ নির্বাচনে কে জিতলো কে হারলো, এখন আর তাতে কিছু এসে যায় না, বিজেপি চাইলে সরকার ভেঙে দিতে পারে, অন্তত ভাঙার চেষ্টা তো চালাতেই পারে। আর মজার কথা হল গোপনে নয়, তারা প্রকাশ্যেই এই খেলা খেলতে পারে, বুক ঠুকে এই খেলায় নামতে পারে। এক বিজেপি নেতা, ব্যক্তিগত আলোচনায় বলছিলেন, কত পাবো? ১১০? বেশ তো বাকি ৪০ টা কিনতে কত সময় লাগবে? কতজন তৃণমূল থেকে বেরিয়ে এল? অনেকে আছে যারা থেকে গেলো, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, তারা তখন কাজে লাগবে। মানে বিজেপি কিন্তু এই অপশনটার কথা ভেবে রেখেছে, এবং আমিও নিশ্চিত যে বিজেপি একশ পার করলেই, সর্বশক্তি নিয়ে এই ভাঙার খেলায় নামবে, কারণ এটা তাদের রাজনৈতিক দর্শন।
আগে দেখে নেওয়া যাক কোন কোন মন্ত্রীসভা বিজেপি ভাঙল, কেমন ভাবে ভাঙল? প্রথমেই আসবে কাশ্মীরের নির্বাচিত সরকার, যে সরকারের তারা ছিল শরিক, বিজেপি পিডিপি মিলে সরকার তৈরি করেছিল, বিজেপি বেরিয়ে এল। পিডিপি, ন্যাশনাল কনফারেন্স আলাপ আলোচনা শুরু হল, অনায়াসে সরকার তৈরি করা যায়, মধ্যে শুধু ইগো, আর কোনও বাধাই নেই। অমিত শাহ সাত সকালে জানিয়ে দিলেন কেবল সরকারই ভাঙা হয়নি, রাজ্যটাকেও ভাঙা হয়ে গেছে। কী কাণ্ড ভাবুন, দু’দিন আগে যে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার চালাচ্ছিল, তারাই বলল পিডিপি দেশদ্রোহী, কেবল পিডিপি কেন? রাজ্যের প্রতিটি বিরোধী দলের নেতাদের জেলে পুরে, সরকার ভেঙে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে দিল, মানুষের ভোটে নির্বাচিত সরকার ভাঙা হল। আসুন বিহারে, বিজেপির সঙ্গে ঝামেলা হল, নীতীশ কুমার, লালু, কংগ্রেস জোট হল। বিরাট জয়। লালুর বেশি বিধায়ক, নীতীশের কম, তবুও মুখ্যমন্ত্রী তবুও নীতীশ। মেনে নিলেন লালুও। কিন্তু চাপে ছিলেন, একদিন শ্বাসকষ্ট হল, বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীত্বের গাজর অফার করল, নীতীশ গিললেন, কিসের নির্বাচন? কিসের আবার মানুষের রায়? লালু জেডিইউ সরকার ভেঙে জেডিইউ বিজেপি সরকার হয়ে গেলো। মধ্যপ্রদেশ, মানুষের রায়ে হারল বিজেপি। বিএসপি আর কয়েকজন বিরোধী বিধায়কের সমর্থন নিয়ে, তৈরি হল কমলনাথের নেতৃত্বে, বিজেপি মাঠে নামলো, পেয়েও গেলো এক বিভীষণকে, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া শ্বাসকষ্টে ভুগতে লাগলেন, শ্বাসকষ্ট সারানোর জন্য সিন্ধিয়ার সমর্থক বিধায়করা, বিজেপির ব্যবস্থাপনায় রিসর্টে চলে গেলো, অতিমারীর মধ্যেই বিধানসভা বসলো, কংগ্রেসের সরকার ভেঙে বিজেপির সরকার তৈরি হল।
সিকিমে বিজেপির কিছুই ছিল না, দল ভাঙানো হল, আঞ্চলিক দল থেকে বিজেপিতে এসে গেলো এমএলএ, বিজেপির সরকার তৈরি হয়ে গেলো, মানুষ ভোট দেয়নি তো কী? বিজেপি সরকার চায়, মানুষের ভোট পেলে ভালো, না পেলেও চলবে।
আসুন অরুণাচলপ্রদেশে, কংগ্রেসের ৪২ জন বিধায়ক, ৬০ জনের বিধানসভায়, ভালো গরিষ্ঠতা। ২১ জনকে ভাঙা হল, হ্যাঁ ২১ জন। রাজ্যপাল একমাস পরের নির্বাচনকে এগিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন, কোর্ট কাছারি হল, এরমধ্যে ২০ জন বিদ্রোহী এমএলএ আর ১১ জন বিজেপি এমএলএ, ২ জন নির্দল আর ডেপুটি স্পিকার বিধানসভার বাইরে বিধানসভা বসিয়ে দিল, সেখানে তারা আনুষ্ঠানিক ভাবে স্পিকারকে সরানোর প্রস্তাব নিল, হ্যাঁ বিধান সভার বাইরে বসে, ভাবুন ভাবুন, ভাবা প্রাকটিস করুন, আবার কোর্ট কাছারি, এমন কি হাই কোর্ট এই কাজকে সমর্থন করলো, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই কাজের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল, এই সময়ে তখনকার রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, রাজ্যপাল রাজখোয়াকে সরানোর জন্য বলেছিলেন, যা বিজেপি সরকার শোনেনি, এরপর নতুন কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী প্রেমা খান্ডুর শ্বাসকষ্ট হল, তিনি ৩২ জন বিধায়ক নিয়ে বিজেপিতে এলেন, এবং বিজেপির সরকার তৈরি হল, নীতি নৈতিকতা গেছে গড়ের মাঠে ঘাস কাটতে, বিজেপির শ্লোগান, যে কোনও মূল্যে গদি চাই। মণিপুরে ৬০ জনের বিধানসভায় কংগ্রেস ২৮ টা আসনে জিতেছিল, বিজেপি ২১ টা আসন পেয়েছিল, সরকার তৈরি করার ডাক পাবার জন্য বসে রইল কংগ্রেস, দাবি জানালো। রাজ্যপালের কাছে দাবি জানালো বিজেপিও, রাজ্যপাল বিজেপিকে ডাকলেন, বাকিদের শ্বাসকষ্ট হল, তাদের সমর্থনে সরকার বিজেপির, বিজেপির গণতন্ত্র, রাজ্যপাল ছিলেন একদা কংগ্রেস, পরে বিজেপিতে যোগ দেওয়া নাজমা হেপাতুল্লা। রাজ্যপাল বানানোর প্রতিদান, বিজেপির সরকার।
কর্নাটকে নির্বাচন, বিজেপি পূর্ণ বহুমতের কিছুটা পেছনে, সরকার তৈরি করার চেষ্টা করলো, এখানে উল্টোদিকে থাকা দেবেগৌড়ার জনতা দল আর কংগ্রেস কে না ডেকে রাজ্যপাল সব চেয়ে বেশি বিধায়ক যাদের আছে তাদের ডাকলেন, যেটা মণিপুরে হল না। বিজেপি আস্থাভোটের যথেষ্ট ঘোড়া যোগাড় করতে পারলেন না, জনতা দল আর কংগ্রেসের সরকার তৈরি হল, কিছুদিনের মধ্যেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ, বিজেপি ক্ষমতায়। সরকার বিজেপির।
কুমারস্বামীর সরকার ভেঙে ইয়েদুরিয়াপ্পার সরকার তৈরি হল, বিজেপির সরকার!
উত্তরাখন্ড, হরিশ রাওতের নেতৃত্বে কংগ্রেসের সরকার, আবার সেই কেনা বেচা শুরু, রাওত বললেন বেশ বিধানসভা বসুক। রাজ্যপাল তার আগেই সরকার ভাঙার প্রস্তাব দিলেন, কোর্টের রায়ে বিধানসভা বসলো, হরিশ রাওত জিতলেন। কিন্তু আরও ক’দিন পরে অনেকের শ্বাসকষ্ট হল, কংগ্রেসের সরকার ভাঙা হল।
আরও দুটো রাজ্যে চেষ্টা হয়েছিল, নির্লজ্জ চেষ্টা মহারাষ্ট্রে, সেই একই ভাবে দল ভেঙে, রাজ্যপালকে দিয়ে ভোর সাতটায় শপথ গ্রহণ করিয়েও টেঁকানো যায়নি বিজেপি সরকারকে, মহারাষ্ট্র হাত থেকে বেরিয়ে গেছে, এখনও নজর নেই তেমনও নয়। আর রাজস্থানে। শচীন পাইলট, রাজেশ পাইলটের পুত্রকে প্রায় ম্যানেজ করা হয়েই গিয়েছিল, কিন্তু ঝানু অশোক গেহলট খেলাটা আটকে দিয়েছিলেন, শচিন পাইলটও ফিরে গেছেন কংগ্রেসে, কতদিনের জন্য? জানা নেই।
মোদ্দা কথা হল, বিজেপি আদালত, নিয়ম কানুনের তোয়াক্কাও করে না, তার সবকটা রাজ্য চাই, কংগ্রেসের রাজ্য তো চাইই চাই, বিরোধীদের মধ্যে যারা সরব, তাদেরও সরকার গড়তে দেওয়া যাবে না, এটা তাদের ঘোষিত লক্ষ্য।
তাহলে দরকারটা কি নির্বাচনের? সবটাই যদি নেতা কিনে বেচেই করা যায়? আর যদি নির্বাচন ব্যবস্থাটাকে রাখতে হয়, তাহলে তার সবচেয়ে বড় শত্রু বিজেপিকে চিহ্নিত করতে হবে, নির্বাচন ব্যবস্থাকে বজায় রাখতে, বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিন।