Written By সম্পাদক
ছোটবেলায় অঙ্ক করতে গিয়ে যে সমস্যা সামনে এসে দাঁড়াতো, তা হল ফরমুলা মুখস্ত করা, একটু বড় হয়ে দেখলাম চারিদিকে অজস্র ফরমুলা। কেবল অঙ্ক নয়, ফিজিক্স কেমিস্ট্রি এমনকি ভূগোলেও ফরমুলা, তারপর আরও বড় হয়ে দেখলাম পৃথিবী ফরমুলাময়, এমনকি সমাজ বিজ্ঞানেও ফরমুলা আছে। এই ফরমুলাটা কী? ফরমুলা, বাংলায় আমরা বলি সূত্র, তা আসলে বহু অঙ্কের, বহু বিষয়ের, বহু তথ্যের সমাধানে আসার এক সরল পথ। অর্থাৎ প্রত্যেকবার আলাদা আলাদাভাবে অঙ্কটা না করে, তাকে একটা ফরমুলায় ফেললে তার সহজ সমাধান পাওয়া যাবে, ফরমুলা হল সেই এরোপ্লেন, যাতে চেপে হুস করে সমাধানে যাওয়া যায়।
সে ফরমুলা, আগেই বলেছি, অঙ্কতেও আছে, সমাজ বিজ্ঞানেও আছে। ফরমুলা গণ্ডগোল হলেই কেলো, ফরমুলাতে গণ্ডগোল হয়? হয় বৈকি, দেখুন না।
এসব ছাড়ুন, আসুন মূল আলোচনায় আসি। সমাজ বিজ্ঞানেও ফরমুলা আছে, একটা রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক কিনা, তা মাপার ব্যবস্থা আছে। ধরুন ১০ টা বিষয়ের এক তালিকা আছে, যা আছে না নেই, এটুকু জানলেই বলে দেওয়া যায়, দেশটা কতটা গণতান্ত্রিক। দেশে সার্বজনীন ভোটাধিকার আছে কি না? দেশে সংবাদ মাধ্যম স্বাধীন কি না? দেশের শাসকরা মানুষের কাছে জবাবদিহি করেন কি না? মানুষের সভা সমাবেশ, বিরোধিতা করার অধিকার আছে কি না? এরকম আরও বেশ কয়েকটা বিষয়ের এক তালিকা হল সেই ফরমুলা যা মিলিয়ে নিলেই বোঝা যায় যে আলোচনার দেশটাতে গণতন্ত্র আছে? না নেই? নাকি থাকলেও তা খন্ডিত।
তো সেরকম একটা ফরমুলা আছে, যা দিয়ে বোঝা যায় যে একটা রাজনৈতিক দল, আসলে ধর্মীয় মৌলবাদী কি না? বোঝা যায় যে এই দলটার রাজনীতি করার মূল উদ্দেশ্য এক বিশেষ ধর্মকে কেন্দ্র করে মানুষ জনকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক কল্পিত স্বর্গ বা জন্নত বা হেভেনের দিকে রওনা দেওয়া। বোঝা যায় যে এই দলটির নেতা আসলে ধর্মের বিভেদকে কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়।
আসুন সেই ফরমুলা দিয়েই আরএসএস বিজেপি’র বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করি।
প্রথম সূত্র দলটি একটি বিশেষ ধর্মীয় সমুদায়ের হয়েই কথা বলবে, নাম যাই হোক না কেন? এক বিশেষ ধর্মীয় সমুদায়ের মানুষজনই ঐ দলের নেতৃত্বে থাকবে।
এবার মিলিয়ে দেখা যাক। আরএসএস বা রাষ্ট্রিয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা ভারতীয় জনতা পার্টির নামে কোথাও হিন্দুত্ব নেই, নামে বলা নেই যে দলটি হিন্দুত্ববাদী, কিন্তু নেতৃত্বে হিন্দুরা, হিন্দুত্ববাদীরা। বিজেপিতে তবু দু চার জন মুসলমান পাওয়া গেলেও যেতে পারে, আরএসএসএ তাও নেই। তাঁরা নিখাদ হিন্দু। তাঁরা চালনা করেন, তাঁদের হাত ধরেই দেশ চালান নরেন্দ্র মোদী। তাই আরএসএস এক হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন, বিজেপি এক হিন্দুত্ববাদী দল।
দ্বিতীয় সূত্র হল তাঁরা অন্য ধর্মকে ঘৃণা করবেন, অন্য ধর্মের মানুষজনদের ঘৃণা করবেন।
তাকিয়ে দেখুন, নরেন্দ্র মোদী, যিনি নাকি এ দলের একচ্ছত্র নেতা, তিনি মনে করেন মুসলমান মানেই লুঙ্গি আর মাথায় ফেজওলা মানুষ। আরএসএস দফতর থেকে বিজেপি আইটি সেল থেকে প্রতিদিন ঘৃণা উগরে দেওয়া হচ্ছে কেবল মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়, এমনকি সেই উদার গণতান্ত্রিক মানুষদের বিরুদ্ধেও, যাঁরা মুসলমানদের পক্ষে দুটো কথা বলছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও। আইটি সেল থেকে স্বরা ভাস্করকে বলা হচ্ছে খান হয়ে যান, মুসলমান চলে যান, আমাদের রাজ্যের বিজেপি ছানাপোনা নেতারা মমতাকে বেগম মমতা বলে সম্বোধন করছেন। মানে মুসলমান হওয়াতো ছেড়েই দিন, হিন্দু মানুষ জনকেও তাঁরা হিন্দু ধর্মের আওতা থেকে বার করে দিতে চান। এই সূত্র মেনেই আরএসএস এক হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন, বিজেপি এক হিন্দুত্ববাদী দল।
তৃতীয় সূত্র হল ধর্মস্থল, উপাসনাস্থলকে ব্যবহার করা। বিজেপির দিকে তাকিয়ে দেখুন, প্রত্যেকটা উপাসনা স্থলকে ব্যবহার করার কি দারুণ চেষ্টা। কলকাতায় এলেন তো কালিঘাট চলো, দক্ষিণেশ্বর চলো, বীরভূমে তারাপিঠ চলো, কঙ্কালিতলা চলো। মোদ্দা কথা হল উপাসনাস্থলে গিয়ে নিজেদের আইডেনটিটি, হিন্দু অস্তিত্বকে জাগিয়ে তোলা। হিন্দু ধার্মিক আবহ তৈরি করা, যা দিয়ে তাঁরা নিজেদের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে থাকেন। এর আগে এরকম নির্লজ্জভাবে পুজোর বেদীকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা হয়নি। তাই আরএসএস এক হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন, বিজেপি এক হিন্দুত্ববাদী দল।
চতুর্থ সূত্র হল, ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে তোলা, ধর্মীয় উন্মাদনার জন্ম দেওয়া। আরএসএস বিজেপির এ তাবৎ সবথেকে বড় নয়, একমাত্র দেশব্যাপী আন্দোলন হল রামমন্দিরের আন্দোলন, দেশ জুড়ে রথযাত্রা, মিছিল মিটিং সমাবেশ। তাদের রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে আছে ওই রামজন্মভূমি আন্দোলন, তাকে ঘিরে দেশজুড়ে হিংসা, গণ উন্মাদনার কথা আমরা জানি, রথ যেখান দিয়ে গেছে, সেখানে পড়েছে মানুষের লাশ, যেখান থেকে ইট এসেছে, সেখানেই রচিত হয়েছে হিংসার ষড়যন্ত্র, ইতিহাস তাই বলছে। আর এইখানেই শেষ নয়, এই ধর্মীয় আন্দোলনের অন্য ক্ষেত্রও তারা তৈরি রেখেছে, এই যাত্রায় কোথাও বাধা আসলেই তারা কাশী মথুরা নিয়ে মাঠে নামবেন, একথা বলাই বাহুল্য। তাই আরএসএস এক হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন, বিজেপি এক হিন্দুত্ববাদী দল।
পঞ্চম সূত্র হল,ধর্মের কুসংস্কারকে জিইয়ে রাখা, ক্রমশ এক মধ্যযুগীয় ইতিহাসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া। বিজেপি নেতাদের কথাগুলোতে কান দিলে বিজ্ঞানের ক্লাস ফোরের ছাত্রও হাসবে। দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ওই যে গণেশের মাথা কাটা হবার পরেই, সেই মাথার জায়গায় একটা হাতির মাথা জুড়ে দেওয়া হয়, এটা ছিল আমাদের দেশের প্রাচীনতম প্ল্যাস্টিক সার্জারির উদাহরণ। এ রাজ্যের দিলীপ ঘোষ একদিন বললেন, দেশি গোরুর দুধ হলদেটে হয় আসলে সেটা সোনা, দেশি গোরুর কুঁজে সোনা থাকে। হ্যাঁ বললেন। ধর্মের যাবতীয় কুসংস্কার নিয়ে দেশটাকে মধ্যযুগে ফেরত পাঠাতে চায় বিজেপি। তাই আরএসএস এক হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন, বিজেপি এক হিন্দুত্ববাদী দল।
ষষ্ঠ সুত্র হল, চরম নারী বিরোধিতা, নারী মানে হল পুরুষদের সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, হ্যাঁ আরএসএস চিফ, আরএসএস প্রধান এই কথা বলেছেন, মোহন ভাগবত কেবল এটুকুই বলেননি, বলেছিলেন নারীরা সংসার ধর্ম করবে, সন্তানকে মানুষ করবে এটাই তো তাদের কাজ। পুরুষরা রোজগার করবে, সংসার প্রতিপালন করবে, নারী গৃহকর্মের দায়িত্ব নেবে, এটা ক’দিন আগেই মোহন ভাগবত বলেছেন। নারী অধিকার শুনলে এই মৌলবাদীদের কানে গরম শিশে পড়ার মত প্রতিক্রিয়া হয়। এবং যে নারীরা কাজ করেন, বিশেষ করে গান বাজনা সিনেমা করেন, তারা যে অত্যন্ত নোংরা তা নিয়ে এঁদের কোনও সন্দেহই নেই। তাই আরএসএস এক হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন, বিজেপি এক হিন্দুত্ববাদী দল।
সপ্তম সূত্র হল, ক্ষমতায় আসার আগে এবং ক্ষমতায় আসার পরে তাদের চরিত্র পালটে যায়। এই মৌলবাদীরা মুখোস পরে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে, মনে করে দেখুন ২০১৪ তে নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী প্রচার। প্রত্যেকটা মিটিংয়ে তিনি বলছেন কংগ্রেসী দুর্নীতির কথা, মন্ত্রী সান্ত্রীদের দুর্নীতির কথা, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কালো টাকা ফেরত আনার, বলছেন স্বাধীনতার পর থেকে দেশের বিকাশ আটকে রেখেছে কংগ্রেস, আমাদের ভোট দিন আমরা কালো টাকা ফিরিয়ে আনবো। গোধরা হিংসার এই কলঙ্কিত নায়ক একবারের জন্যও হিন্দু মুসলমান, রামমন্দির প্রসঙ্গ নিয়ে একটা কথাও বলেননি। এবার দেখুন ২০১৯, বিজেপি একাই ৩০৩। রামমন্দির, তিন তালাক, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়া, মানে সব অর্থে এক সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের দিকে দেশ কে ঠেলে দেওয়া। এটাই ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির এক চরিত্র, তারা মুখোস পরে থাকে, সময় মত মুখোস খুলে লাফিয়ে পড়ে শিকার ধরতে। তাই আরএসএস এক হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন, বিজেপি এক হিন্দুত্ববাদী দল।
অষ্টম এবং শেষ সূত্র হল, মৌলবাদী রাজনৈতিক দল এর উত্থান এমনি এমনি হয় না, তাকে তুলে ধরতে সাহায্য করে অন্য দল, তারা অন্য এক দলের হাত ধরে হঠাৎই উঠে আসে, মানুষের সামনে এক মসীহার রূপ ধরে অবতীর্ণ হয় বলা যায়। যারা তাকে তুলে ধরে তাদের অনেক সময় ধারণাও থাকে না, ভবিষ্যতে এই মৌলবাদী দল কোন আকার ধারণ করবে। ভারতে আরএসএস জনসংঘ, বিজেপি কোথায় ছিল? জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর হাত ধরেই এরা মাঠে নেমেছে। তারও পরে এমন কি বামপন্থীরাও তাদের সমর্থন করেছে। এরপর রামজন্মভূমী আন্দোলন, দেখতে হয়নি। শেষ পেরেক কংগ্রেসের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে কেন্দ্রে বাম কংগ্রেস আলাদা হয়ে যাওয়া। বিজেপি হু হু করে এগিয়ে এল শূন্য স্থান দখল করতে। জানা ছিল রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের, জানা ছিল যারা পড়েছেন আরএসএসের ঘোষনাপত্র সেই ১৯৫২ তে। কিন্তু মানুষ জানল, এই ক বছর আগে, এক হিন্দু মৌলবাদের উত্থান চোখে দেখা যাচ্ছে এখন। তাই আরএসএস এক হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন, বিজেপি এক হিন্দুত্ববাদী দল।
এমনিতে মৌলবাদেরই অনেক সমস্যা আছে, আমি যা বলছি তাই ঠিক, আমার কথার বিরুদ্ধে কোনও কথা হতে পারে না, এগুলো এক মৌলবাদের অংশ, কিন্তু তা যদি হয় ধর্মীয় মৌলবাদ, তাহলে হয়ে ওঠে আরও ভয়ঙ্কর, সমাজের যা কিছু ভালো তাকে উঁই পোকার মত কুরে কুরে খেয়ে নেয়, একটা খোকলা কাঠামো পড়ে থাকে মাত্র। ধর্মীয় মৌলবাদ মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির বিরোধী, ক্রমশঃ পেছনে ঠেলে নিয়ে যায় সমাজকে। যেমন এই বিজেপি আমাদের দেশ আর সমাজকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে ষোড়শ শতাব্দী কি তারও পেছনে, এক মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তারা। এই মৌলবাদকে পরাস্ত করতে হবে।