Written By সম্পাদক
বাদুড় পা ওপরে মাথা নীচে করে গাছে ঝোলে, ওভাবেই ঘুমোয়, উলটো পৃথিবীটা তাদের কাছে সোজা মনে হয়, ওরা দেখে আকাশ ওদের পায়ের তলায়, মাথার ওপরে পৃথিবী। এক উলটো রাজার দেশের রাজারও পৃথিবী, দেশ, সমাজ নিয়ে ধারণা এক্কেবারেই এইরকম। তাদের দেশে তারা বাদ দিয়ে সব্বাই দেশদ্রোহী, সব্বাই তাদের বিরুদ্ধে, রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কেবল তারাই মানুষের জন্য কাজ করছে, বাকি সবাই তাদের কাজ করতে দিচ্ছে না। এদিকে মানুষ উলটো কথা বলছে, মানুষের অভিজ্ঞতা উলটো, তথ্য ওনারা যা বলছেন, তার সঙ্গে মিলছে না, তাতে কী? ওনারা বাদুড়, উলটো হয়ে গাছের ডালে ঝুলছেন, পায়ের তলায় আকাশ দেখছে আর মাথার ওপরে পৃথিবী, উলটো রাজার দেশ।
দিল্লির, হ্যাঁ খোদ দিল্লির বুকে যেখানে উলটো রাজার বাস, সেখানে ৫ টা মিউনিসিপালিটি আসনে ভোট হয়ে গেলো, ৪ টা আপ, ১ টা কংগ্রেস, আগে একটা ছিল বিজেপির, এবারে সেটাও হাতছাড়া হয়েছে। মানে উলটো রাজার পাড়ার বাসিন্দারাও জানেন, রাজা অপদার্থ। তো সেই রাজার দলবল আসছেন বাংলায়, রোজ আসছেন। এক্কেবারে কার্পেট বম্বিং, এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়ছেন না, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ৩০ জনের বিশাল জনসভায় দেড় ঘন্টা ভাষণ দিয়ে বোঝাচ্ছেন, দেশ এগিয়ে চলেছে, অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে, দুনিয়ার দেশ আমাদের সমীহ করছে, আমরা নাকি ৫ ট্রিলিয়ন ইকোনমিতে ঢুকবো ঢুকবো, কেবল হিন্দু খতরে মে হ্যায়, আর সিয়াচীন মে জওয়ান লড় রঁহে হ্যায়। কি কাণ্ড ভাবুন, অর্থনীতি রকেট গতিতে যখন এগোচ্ছে, ঠিক তখন নাকি হিন্দু খতরে মে হ্যায়! খোঁজ নিয়ে দেখুন দুটো তথ্যই ডাহা মিথ্যে, উলটো হয়ে ঝোলা বাদুড়ের গল্প, সে অর্থনীতির শেষ পাওয়া তথ্য কিছুটা জানাই, জিডিপির গল্প, গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট। সেটা কী? খুব ছোট্ট করে বলতে গেলে, একটা সময়ের মধ্যে সারা দেশে যে সম্পদ তৈরি হয়, কৃষকরা যে ফসল ফলায়, শ্রমিকরা যে জিনিষপত্র উৎপাদন করে, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য যে পরিষেবা, এই সব কিছুকে যোগ করলে জিডিপি পাওয়া যায়, মানে দেশের মোট সম্পদের একটা হিসেব পাওয়া যায়, আরও একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি, ধরুন আপনার বাড়ি, আপনার রোজগার, ঘরে আপনার স্ত্রী পুত্র তাদের কাজকর্ম ইত্যাদিকে যদি মূল্য দিয়ে নির্ধারণ করা যায়, সেটা হবে আপনার মোট সম্পদ, কেবল বাড়িটাই নয়, আপনার পরিষেবা, ব্যাঙ্কের টাকা, স্ত্রী পুত্র কন্যার পরিষেবা সব যোগ হবে, এটাকেই যদি দেশের প্রেক্ষিতে দেখেন, সেটাই হল মোদ্দা কথায় জিডিপি। তার মানে জিডিপি যত বাড়বে, দেশ তত এগোচ্ছে বলে ধরে নেওয়া হবে, আয়ের অসাম্য, বিতরণে অসাম্য ইত্যাদি থাকলেও জিডিপি বাড়লে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তো নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এলেন, ২০১৪। তখনও কংগ্রেসের পরিকল্পনাগুলোই চলছে, সে বছর জিডিপি ৭.৪১%, পরের বছর বাজেটের আগেই জানা গেলো, ২০১৫ র জিডিপি বেড়েছে, হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড, দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি, বেড়ে হল ৮%। বছর গড়াল, আবার জিডিপি বাড়ল, এবার বেড়ে দাঁড়াল ৮.২৬%, মোদীজি হাসছেন, ওদিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুই জমজ ভাই, বিকাশ আর কল্যাণ। বণিক সভার মিটিংয়ে দলের নেতা প্রকাশ জাভড়েকর বললেন, দেশ অগ্রগতির পথে, অরুণ জেটলি, তখনও বেঁচে, অর্থমন্ত্রী, বললেন মোদীজি আর বিজেপির গভর্নেন্স দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, সে সব উচ্ছ্বাস রাখা আছে কাগজের পাতায় পাতায়। এরপর ২০১৭ জিডিপি নামল, নেমে ৭.০৪%। নানান অজুহাত দিতে শুরু করলো উলটো হয়ে ঝুলে থাকা বাদুড়েরা, বৃষ্টি কম, বিদেশী মুদ্রার ঘাটতি, দায়ী মনমোহন সিংহের সরকার, এর পরের বছর দেখিয়ে দেব, এরই মধ্যে ডিমনিটাইজেশন হয়ে গেছে, অর্থনীতিকে ছারখার করে দিয়েছে। ২০১৮ তে সেই জিডিপি আবার নামলো, এবার ৬.১২%। সেই প্রকাশ জাভড়েকর এবার বললেন, ওসব জিডিপি ইত্যাদি পুরনো কনসেপ্ট, এখন ওসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে, দেশ এগোচ্ছে। ২০১৯ এ জিডিপি গিয়ে দাঁড়াল ৪.১৮%, মাথায় রাখুন তখনও করোনা আসেনি, উলটো ঝোলা বাদুড়রা এ নিয়ে আর একটা কথাও বলছেন না, তাদের পায়ের তলায় আকাশ, মাথার ওপরে পৃথিবী। এরপরের কথা আর বলার নয়, করোনা এসেছে, প্রত্যেক দেশের জিডিপি কমেছে, কিন্তু আমাদের দেশের রেকর্ড প্রায় কারোরই নেই, এমন কি আমাদের পড়শি পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল বা শ্রীলঙ্কাতেও এভাবে জিডিপির পতন হয়নি, জিডিপি কমে মাইনাস ২৩.৪%। সেই প্রধানমন্ত্রী, সেই প্রধানমন্ত্রীর হুদো হুদো মন্ত্রী সান্ত্রীরা, সেই শাসক দল বিজেপি এ রাজ্যে এসে শ্লোগান দিয়েছেন, সোনার বাংলা গড়ে দেবো।
এই সময়ের মধ্যে দেশে বেকারত্বের হার কী? আসুন সেটাও দেখে নেওয়া যাক, কারণ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রতিবছর ১ কোটি লোকের চাকরি হবে, আসুন দেখে নেওয়া যাক বাস্তবটা কী?
২ আগস্ট ২০১৭, সরকারি পরিসংখ্যান বলছে বেকারত্বের হার ৩.০২%, ৪ আগস্ট ২০১৮ ৫.৫৩%, ৭ আগস্ট ২০১৯ ৭.৬৩% আর ২ আগস্ট ২০২০ ৭.৭২%। মানে বেকারত্ব বাড়ছে, কে বলছে? সরকারি তথ্য, রাহুল গান্ধী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন। অর্থমন্ত্রী বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার এসেছে।
এসেছেই তো, অন্যদিকের অর্থনীতিতে বিরাট জোয়ার, যখন আমাদের দেশের জিডিপি মাইনাস ২৩.৪%, করোনা লকডাউনের ফলে বিপর্যস্ত প্রত্যেক মানুষ, ঠিক সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী সখা মুকেশ আম্বানি ঘন্টা পিছু আয় করেছেন মাত্র ৯০ কোটি টাকা। হ্যাঁ, ৯ এর পিঠে আট টা শূন্য। আর কেবল উনিই নয়, দেশের অর্থনীতি যখন তলানিতে, ঠিক তখন এই দেশের ৪০ জন শিল্পপতি ঢুকে পড়লেন বিলিওনিয়ারস ক্লাবে, ভারতীয় বিলিওনিয়ারস সদস্য বেড়ে দাঁড়ালো ১১৭ জন, মানে দারিদ্র বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিলিওনিয়ারস এর সংখ্যা, সবকা সাথ সবকা বিকাশ। সম্পদ বাড়ানোর তালিকাতে যারা আছেন তাদের শীর্ষে আছেন প্রধানমন্ত্রীর দুই সখা, আদানি আর আম্বানি, মুকেশ আম্বানি এই অতিমারীর বছরে সম্পদ বাড়িয়েছেন ২৪ শতাংশ, মাথায় রাখুন, দেশের জিডিপি কমেছে ২৩.৪%, তিনি এখন বিশ্বের ৭ নম্বর ধনী মানুষ, বৈধ সম্পদ ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, আমাদের দেশের শিক্ষা খাতে মোট যত ব্যয় হয়, তার থেকে বেশি, সবকা সাথ সবকা বিকাশ। আদানি, গৌতম আদানি অনেক পরে দৌড় শুরু করে অনেকটাই এগিয়েছেন, সম্পদ ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৬ তে কোম্পানি তৈরি করে এই সাড়ে চার বছরে, সে কোম্পানি দেশের ৯ টা বন্দরের মালিক, তাঁর ভাই বিনোদ আদানির সম্পদ বেড়েছে ১৩৮%। এইচ সি এল এর কর্ণধার শিব নাদারের একবছরে সম্পত্তি বেড়েছে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, জেডকলারের বাইজু রবীন্দ্রনের সম্পদ বেড়েছে ২৭৪%, চিন্তাও করা যায় না। মাহিন্দ্রা গ্রুপের কর্ণধার, আনন্দ মাহিন্দ্রার সম্পদ বেড়েছে ১০০ শতাংশ,
তাহলে দাঁড়াল টা কী? ২০১৪ তে ক্ষমতায় এসে সাত বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী কাদের সেবা করলেন? কাদের বিকাশ ঘটালেন? কারা উপকৃত হল? মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পপতির উন্নতি, বিরাট উন্নতিকে সবকা সাথ সবকা বিকাশ বলা যায়? বলেন যারা উলটো হয়ে ঝোলেন, সেই বাদুড় ঝোলা বিজেপি নেতারা এবার বাংলার বিকাশ করতে প্রতিদিন এরাজ্যে টহল দিচ্ছেন, তারা বাংলাকে নাকি সুনার বাংলা বানিয়ে ছাড়বেন, ঠিক যেরকম সুনার ভারত তৈরি হয়ে গেছে সেই মডেলে।
মামাবাড়িতে, আমার মামাবাড়িতে এক বিরাট বটগাছে থাকতো প্রচুর বাদুড়, জায়গাটা তাদের জন্য নোংরা হয়ে যেত মাঝেমধ্যেই, এদিকে দাদুর হুকুমে তাদের মারা চলবে না, কেষ্টর জীব। তো আমার দাদুকে দেখেছি, গাছের তলায় প্রচুর খড়কুটো যোগাড় করে আগুন লাগিয়ে দিতেন, প্রচুর ধোঁওয়া হত, সেই বিরাট বটগাছের ডালে ডালে ঝুলতে থাকা বাদুড়্গুলো উড়ে চলে যেতো। আজ আমাদের সেই বাদুড় তাড়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে, বাদুড়ঝোলা হয়ে থাকা বিজেপি মন্ত্রী সান্ত্রী নেতাদের প্রত্যেকটা মিথ্যেকে মানুষের সামনে বলতে হবে, চিৎকার করেই বলতে হবে যে সবকা সাথ সবকা বিকাশ নয় এই দল, প্রধানমন্ত্রী আসলে আম্বানি, আদানি ফড়ে জোচ্চর কর্পোরেটদের উন্নতি চায়, সেটাই তাদের লক্ষ্য।