Written By সম্পাদক
সেকেন্ড হ্যান্ড নেতা-বাজার। এবারের পশ্চিমবঙ্গে ভোটের মুখে বিজেপির শুকনো ডালে যে হারে প্রায় প্রতিদিন হাত-ফেরতা বা সেকেন্ড হ্যান্ড নেতাদের থোকা থোকা ফুল ফুটে উঠছে, তখন, এই বড়দের ভোটে রবীন্দ্রনাথের ছোটদের লেখা মনে পড়ে যাচ্ছে-‘কাল ছিল ডাল খালি, আজ ফুলে যায় ভ’রে’।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস বা এডিআর-এর তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে, বিধায়ক, সাংসদ সব মিলিয়ে সারা দেশে মোট ৪৪৩ জন সদস্য দল বদলেছেন। দলত্যাগীদের ৪৫ শতংশই যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নামও। ভোটের মুখে সদলে তৃণমূল কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধিরা বিজেপির খাতায় নাম লিখিয়েছেন এই রাজ্যে। এডিআরের রিপোর্ট বলছে, দলত্যাগীদের এফিডেভিট থেকে জানা যাচ্ছে, দল বদলের পর তাদের সম্পত্তির পরিমাণ হঠাৎ করে গড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩৯ শতাংশ হারে। এই নিয়ে অবশ্য এখনও কেউ কোনও তদন্ত দাবি করেনি। তদন্ত হলে হয়তো আরও চমকপ্রদ সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। দলবদল মূলত দু’ধরনের হয়। ভোটের আগে। আর ভোটের পর সংখ্যার ঘাটতি মেটাতে। পশ্চিমবঙ্গে এবারে ভোট ঘোষণার আগে এবং পরে যে দল বদলের হিড়িক দেখা গেল, তা এই রাজ্যের নির্বাচনী ইতিহাসে একটা রেকর্ড। এর প্রতিফলন দেখা গেল বিজেপির প্রার্থী তালিকায়। বিজেপির মোট প্রার্থীর এক তৃতীয়াংশের বেশি প্রার্থী হলেন তৃণমূল এবং অন্যান্য দল ঘুরে আসা প্রার্থী। বঙ্গ রাজনীতিতে এরকম অতীতে কখনও ঘটেনি। এর ফলে এক অদ্ভুত সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। যে সমস্যাও বাঙালি এর আগে দেখেনি।
ধরুন আপনার বাগানের গাছে খুব সুন্দর ফুল ফুটেছে। আপনি এত দিন জানতেন সেই ফুলের নাম চন্দ্রমল্লিকা। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনলেন, সেই ফুলের নাম বদলে হয়েছে কলাবতী। এরকম একটা দুটো হলে তাও না-হয় কথা ছিল। কিন্তু ধরুন যদি শ’য়ে শ’য়ে হতে থাকে? এবারের বাংলার ভোটে এটাই হল সব থেকে বড় ধাঁধা। এর ফলে অনেক হাস্যকর ঘটনাও এবারের নির্বাচনের সাক্ষী থাকল। যেমন ধরুন সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। সেখানকার ৯০ ছুঁই-ছুঁই তৃণমূল বিধায়ক এবারের তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় যেই না দেখেছেন তাঁর নাম নেই, অমনি ধাঁ করে তিনি পদ্মমঞ্চে উঠে পড়েছেন, আর উঠেই চেঁচাতে শুরু করেছেন, ঝ্যায়শ্রীরাম, আগে যা যা বলেছি, শুনেছি, দেখেছি সব ভুল বলেছি, ভুল শুনেছি, ভুল দেখেছি। সিঙ্গুর-ভুল, মা ভুল, মাটি ভুল, মানুষ ভুল...., দল ছেড়ে, এই সব বলে-টলে তিনি যেই না সিঙ্গুরে গেরুয়াপ্রার্থী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন, অমনি পুরোনো পদ্মপন্থীরা তাঁকে এই মারে কি সেই মারে। পুরোনো পদ্ম আর সদ্য চোখফোটা পদ্মের লড়াই বেশ কয়েক দিন ধরেই ছিল রাজ্য জুড়ে। এই ক’দিন আগেও তাঁদের ভাঙচুর, লাঠালাঠি খবর দেখা যেত কাগজ খুললেই।
নমো-র আমলে, নামা আর শেষ হচ্ছে না। আমরা বেশ নিচের দিকেই ছিলাম বিশ্বের দুর্নীতি-সূচকে। সর্বশেষ করাপশন ইনডেক্সে নমো যুগে আমরা আরও কয়েক ধাপ নেমে গিয়েছি। হিন্দুত্ববাদীরা তা শুনে বলেছিলেন, আরে মশাই একটু ধৈর্য ধরুন, রামরাজ্য এল বলে। ওয়ার্লড হাঙ্গার ইনডেক্স বা ক্ষুধার সূচকেও নমো-আমলে আমরা বেশ কয়েক ধাপ নীচে নেমে গেলাম। আমাদের বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশ আমাদের থেকে এগিয়ে গেল। তা শুনে হিন্দুত্বাদীরা বললেন, একটু ধৈর্য ধরুন, কৃষিতে বৃদ্ধি দ্বিগুণ হল বলে। এই কথা বলে তারা প্রায় গায়ের জোরে কৃষিবিল পাশ করিয়ে দেশে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করলেন যে মাসের পর মাস সেই বিল প্রত্যাহারের দাবিতে পথে রাত কাটাচ্ছেন হাজার হাজার কৃষক। ফ্রিডম হাউসের রিপোর্টেও গণতন্ত্রের সূচকে আমরা নমোযুগে বলা যায় পা পিছলে বেশ কয়েক ধাপ নেমে গেলাম। ফ্রিডম হাউসের রিপোর্টে বলা হল, ভারত নমোযুগে গণতান্ত্রিক দেশ থেকে আংশিক মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়েছে। তা শুনে হিন্দুত্ববাদীরা বললেন, কী যে বলেন! হয়তো একটু ইউএপিএ-টিউএপিএ বেশি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু যতটা বলা হচ্ছে তেমনটা কিছু না।
এর পর নমো যুগে আবার ধাক্কা। একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের রিপোর্টে ভারতকে বলল নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক দেশ। ইলেক্টোরাল অটোক্র্যাসি। সুইডেনের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট বা ভ্যারাইটিস অফ ডেমোক্র্যাসি ইনস্টিটিউট পৃথিবীর দেশে দেশে গণতন্ত্রের গভীরতা নিয়ে গবেষণা করে যারা প্রতি বছর রিপোর্ট তৈরি করে। আর এই প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ রিপোর্টে নরেন্দ্র মোদীর শাসনে থাকা ভারতকে ইলেক্টোরাল অটোক্র্যাসি বলে চিহ্নিত করেছে। তাদের লিবারেল ডেমোক্র্যাসির সূচকে ২৩ ধাপ নেমে এই জায়গায় পৌঁছেছে ভারত। গত ১০ বছরে পৃথিবীতে এমন গভীর অবনমনের কোনও নজির নেই। নিরপেক্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের যথেষ্ট খ্যাতি আছে। ২০২টি দেশের প্রায় ৩ কোটি তথ্য পর্যালোচনা করে তারা এই রিপোর্ট তৈরি করেছে। অনেক কারণের মধ্যে ভারতের এই অবনমনের প্রধান কারণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। তা শুনে হিন্দুত্ববাদীরা বললেন, আমাদের সবকা সাথ সবকা বিকাশ দেখে ওরা হিংসায় জ্বলছে, আর এই সব হাবিজাবি বদনাম ছড়াচ্ছে। আমাদের বিদেশের কারও সার্টিফিকেটের দরকার নেই। আর, ফ্রিডম হাউজের রিপোর্টটির ব্যাপারে ভারতে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ভারতের প্রতিষ্ঠানসমূহ মজবুত এবং তার গণতান্ত্রিক রীতিনীতিও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত’। এবং যারা তাদের মৌলিক বিষয়গুলোই ঠিক করতে পারেনি তাদের কাছ থেকে ভারতের কোন সদুপদেশ নেবার দরকার নেই। ভাল কথা বিদেশিদের থেকে কিছু শিখতে হবে না। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, তাহলে ৩৭০ প্রত্যাহারের পর ভূস্বর্গ স্বাভাবিক দেখানোর জন্য কেন বিদেশিদের নিয়ে এসে জম্মু-কাশ্মীরে ঘোরানো হয়? তার কিন্তু কোনও জবাব নেই।
এর পর এল সুখের সূচক। নমো আমলে সেখানেও আমরা নামতে শুরু করেছি। নমোর শাসনকালে আমাদের যে নামা-ইতিহাস, সেখানে ফের ছক্কা মেরেছে মোদী প্রশাসন। নরেন্দ্র মোদী জমানায় দেখা যাচ্ছে মন একেবারেই ভালো নেই আমজনতার। রাজনৈতিক নেতারা যাই বলুন, দেশবাসী আদৌ নিজেদের সুখী বলে মনে করছেন না। এসব কোনও বিরোধী দলের অভিযোগ নয়, রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্কের সমীক্ষায় উঠে এসেছে এই তথ্য। আমরা সদ্য পেরিয়ে এলাম ইন্টারন্যাশনাল ডে অব হ্যাপিনেস অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক সুখ-দিবস। তাতেই সামনে এসেছে সেই সমীক্ষার ফলাফল—ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০২১। সদ্য প্রকাশিত সেই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ১৪৯টি দেশের তালিকায় ১৩৯ নম্বরে রয়েছে ভারত। দুই প্রতিবেশী পাকিস্তান (১০৫), বাংলাদেশ (১০১) তালিকায় অনেকটাই ওপরে রয়েছে। আরেক পড়শি দেশ চীনও রয়েছে প্রথম একশোর মধ্যে। তাদের র্যা ঙ্ক ৮৪। ২০১১-১২ সালে, মনমোহন সিং জমানায় ভারতের অবস্থান ছিল ১১১। সমীক্ষা চালানো মোট ১৪৯টি দেশের মধ্যে সুখ-তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে ফিনল্যান্ড। এই নিয়ে টানা চারবার সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষস্থান ধরে রাখল তারা। প্রথম দশের বাকিরা হল—ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ, নিউজিল্যান্ড। কীভাবে করা হয়েছে এই সমীক্ষা? সংস্থাটি জানিয়েছে, ভারতে মূলত দু’ভাবে সাধারণ মানুষের মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে। টেলিফোনে এবং সামনাসামনি কথা বলে রিপোর্ট তৈরি করেছেন সমীক্ষক সংস্থার কর্মীরা। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের মানুষ সবচেয়ে বেশি দুঃখী। তালিকায় সবার শেষে রয়েছে তারা। অন্যদিকে, বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ হলেও প্রথম দশে স্থান পায়নি আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেশ রয়েছে তালিকার ১৯তম স্থানে। দেশ যখন দুর্নীতি সূচকে, ক্ষুধা সূচকে, গণতন্ত্র সূচকে, সুখের সূচকে ক্রমাগত নীচে নামছে তখনই নরেন্দ্র মোদী বাংলায় এসে শনাচ্ছেন সোনার বাংলা গড়ার কথা। আপনি একবার বিজেপির ম্যনিফেস্টোটা মন দিয়ে যদি পড়েন তো দেখবেন, মনে হচ্ছে যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিলাম ডাকা হচ্ছে। ক প্রকল্পে মমতার সরকার ১০টাকা দেয়, আমরা দেব ১০০, খ প্রকল্পে ওরা ৫টাকা খরচ করে আমরা দেব ৫০০। গ প্রকল্পে ওরা ৩০ টাকা দেয়, আমরা দেব ২০০০ করে। এমনি সব প্রতিশ্রুতি। নতুন চিন্তা ভাবনার প্রকাশ নেই। টাকার গরমের প্রকাশটাই বেশি। এত টাকা কোথা থেকে আসবে? তোমরা এসব কাজ ত্রিপুরায়, উত্তরপ্রদেশে, মধ্যপ্রদেশে করছ না কেন? তার কোনও সদুত্তর আবশ্য নেই হিন্দুত্ববাদী নেতাদের মুখে।