Written By অনিরুদ্ধ সরকার
রাজস্থান ভ্রমণের পঞ্চম পর্বে আজ একটু প্রেম ভালোবাসার কথা।
এসে পড়েছি পৃথ্বীরাজ সংযুক্তার দেশে। প্রেমের দেশ আজমেঢ়। আজমেঢ়ের ইতিহাস জুড়ে শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ নয়। যুদ্ধের মাঝে আছে একটুকরো ভালোবাসার চাঁদ, যার আলোয় শুধু আজমেঢ়ই নয় পুরো রাজপুতানা আলোকিত। যে আজমেঢ়ে একের পর এক রাজাদের বীরত্ব আর দম্ভের কাহিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেই আজমেঢ়েই জন্ম নিয়েছে না শেষ হওয়া প্রেমের উপাখ্যান। পৃথ্বীরাজ সংযুক্তার প্রেম রাজপুতনার ঐতিহ্য-গৌরব। আর এই আজমেঢ়েই দু’হাতে প্রেম বিলিয়েছেন মৈনুদ্দিন চিস্তির মত মহান সাধক।
তাই সব মিলিয়ে আজমেঢ় জুড়ে কোথাও কোনো ধর্মীয় সংকীর্ণতা নেই আছে শুধু প্রেম, বিশ্বাস আর সম্প্রীতির বাণী। যা ভারতীয় সংস্কৃতির সনাতন ঐতিহ্য, ‘দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে।’
আজমেঢ়ের ঐতিহাসিক ইমারৎ দেখতে দেখতে পায়ে পায়ে প্রথমেই মৈনুদ্দিন চিস্তির দরগায়। মাথা ঠেকালাম। মাথা ঠেকাতে গেলে আপনি কোন ধর্মের সেটা এখানে দেখা হয় না, তার হিসেবও রাখা হয় না। ‘মৈনুদ্দিন চিস্তি’ যার নামে দরগা, তিনি সনাতন ভারতের মানুষ না হয়েও হয়ে গেছেন ভারতের। আসলে দেশ-কালের চেয়েও মানুষের কর্ম এবং মেল বন্ধণের বাণী অনেক বড় হয়েছে এদেশে । মৈনুদ্দিন চিস্তি হজরত মহম্মদের বাণী প্রচার করতে এসেছিলেন ভারতে। আর এখানেই থেকে যান পাকাপাকিভাবে। সম্রাট আকবর যখন একটি পুত্র সন্তানের আশায় দরগা মন্দির ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, তখন এই মৈনুদ্দিন চিস্তির কৃপায় আকবরের একটি পুত্র সন্তান জন্মায়। মৈনুদ্দিন চিস্তির নাম এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে বিদেশে। কিন্তু সম্রাট আকবরের পুত্রসন্তান প্রাপ্তির পর মৈনুদ্দিন চিস্তি হয়ে ওঠেন জীবন্ত কিংবদন্তী। গড়ে ওঠে দরগা। আর তারপর! একের পর এক মোঘল সম্রাটের কৃপা দৃষ্টিতে দরগা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখানকার বুলন্দ দরোয়াজাটি ২৩ মিটার উঁচু। এখানে মুসলিমরা ধূমধাম করে ‘উরস উৎসব’ পালন করেন। সৌধের মাঝামাঝি মৈনুদ্দিন চিস্তির সমাধিবেদী। মাথা ঠেকান সবর্মের মানুষ।
সেখান থেকে বের হয়েই ‘আড়াই দিন কা ঝোপড়া’। এই ‘আড়াই দিন কা ঝোপড়া’ নিয়ে নানান কাহিনি। কেউ বলেন এটি নাকি এক সময় হিন্দু শিক্ষাক্ষেত্র ছিল। মুসলিমরা ভেঙে এই মসজিদ বানান। আবার কেউ বলেন মহম্মদ ঘোরি আজমের দখল করার পর মন্দির ভেঙে আড়াই দিনে এর নির্মাণ করেন আর সেকারণেই এর নাম হয় ‘আড়াই দিন কা ঝোপড়া’ । তবে ঐতিহাসিকদের মতে, এখানে থাকে মন্দিরটি ভাঙতে আড়াই দিন সময় লেগেছিল, তাই নামকরণ হয়েছে, ‘আড়াই দিন কা ঝোপড়া’। পাঁচসারি স্তম্ভের গায়ে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি। অসাধারণ তার কারুকাজ।
এবার হাতে সময় নিয়ে চললাম, তারাগড় দূর্গের দিকে। ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা যায়, এই দূর্গের নির্মাতা অজয়পাল চৌহান। শুধু তাই নয় , এই দূর্গেই এসেছিলেন ব্রিটিশ দূত স্যার টমাস রো। আর এই দূর্গেই জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে এদেশে বাণিজ্য করার অনুমতি চেয়েছিলেন ব্রিটিশ দূত। ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষী এই দূর্গ।
পায়ে পায়ে ‘সোনিজী কা নাসিয়া’, ‘নাসিয়া’ মানে ‘মন্দির’। আসলে এটি একটি জৈন মন্দির । মন্দিরে সোনার গিলটি করা একটি কাহিনি চিত্র রয়েছে, অসাধারণ তার সৌন্দর্য। আর রয়েছে জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভদেবের মন্দির।
আজমেঢ়ের খ্যাতি এখানকার ‘আনাসাগর’ লেকটির জন্য। চৌহান রাজ আনাজী দু’ই পাহাড়ের মাঝে লুনি নদীতে বাঁধ দেন, আনাজীর নামেই লেকের নামকরণ হয় ‘আনাসাগর লেক’। আর এই সাগর ঘিরেই পৃথ্বীরাজ সংযুক্তার ভালোবাসার কাহিনি গড়ে ওঠে। এই লেকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সাজাহান মাঝেমধ্যেই এখানে আসতেন। সাজাহান আনাসাগরে কয়েকটি ঘাট বানিয়েছিলেন।
আনাসাগর ছাড়াও আজমেঢ়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি বড় জলাশয়, রয়েছে মেয়ো কলেজ। হাতে সময় নিয়ে দেখে ফেলুন রাঠোর রাজাদের রাজধানী কিষাণগড়। এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভ করবেন। এখানকার ফুল মহলটিও বেশ আকর্ষনীয়। বিভিন্ন দেশীবিদেশী ফুলের সম্ভার রয়েছ এখানে।
কিভাবে যাবেন
বিমানঃ কাছের বিমান বন্দর জয়পুর। ১৩২ কিমি দূরে আজমেঢ়।
ট্রেনঃ শিয়ালদহ আজমেঢ় এক্সপ্রেস, অনন্যা এক্সপ্রেস ছাড়াও রয়েছে একাধিক সাপ্তাহিক এক্সপ্রেস ট্রেন।
সড়কপথঃ রাজস্থানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রয়েছে একাধিক বাস। মিলবে প্রাইভেট ও শেয়ার কার।
কোথায় থাকবেন
আজমেঢ়ে একাধিক হোটেল, হাভেলি, লজ রয়েছে। ভাড়া ১০০০ টাকা থেকে ৫০০০টাকার মধ্যে।