Written By শুভাশিস মৈত্র
ক’দিন আগে অন্য কাজে কলেজস্ট্রিট গিয়ে গাংচিল-এ পেয়ে গেলাম বিপ্লবী বারীন ঘোষের অটোবায়োগ্রাফি। সংকলক জয়ন্তী মুখোপাধ্যায়। কলেজে থাকতে পড়েছিলাম উপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাসিতর আত্মকথা। তার পর শ্রীঅরবিন্দর কারা কাহিনী। বছর ষোলো আগে হাতে আসে নলিনীকান্ত সরকারের আত্মজীবনী, আসা যাওয়ার মাঝখানে প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। এবার বারীন ঘোষ। মনে হল যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। উপেন এবং বারীন দুজনেই আন্দামানে যাবজ্জীবন খেটে এসেছেন। তার পরেও তাঁদের লেখায় যে পরিমাণ হাসি, ঠাট্টা, মস্করা, নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ দেখি, বিস্ময় জাগে। নলিনীকান্তর লেখায় আছে, তিনি যখন বহরমপুর থেকে রাজবাড়ির লাইব্রেরিয়ানের চাকরি ছেড়ে সাহিত্য এবং সাংবাদিকতা করবেন বলে বারীনের ডাকে কলকাতায় এলেন তখনও বারীন ঘোষের ‘বিজলী’ পত্রিকা বেরোয়নি। উপেনের ‘নারায়ণ’ চলছে। বিপ্লবী বারীনকে এক জাতীয়তাবাদী বড়লোক টাকা দিয়েছেন পত্রিকা বের করার জন্য। বারীন নতুন বাড়ি ভাড়া করেছেন। ‘কমিউন’ করে সবাই মিলে থাকবেন বলে। নলিনীর কথায়, ‘আপার সার্কুলার রোড (বর্তমানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড) থেকে দেশবন্ধু পার্কের অভিমুখে যেতেই একেবারে নাকের ডগার উপর পড়ে বাড়িটি। ডাইনে-বাঁয়ে দু’দিকে চলে গেছে দু’টি পথঃ মোহনলাল স্ট্রিট আর শ্যামলাল স্ট্রিট। দুই পথের সংযোগস্থলে বাড়িটি। ৪-এ, মোহনলাল স্ট্রিট। তিন তলার তিনটে ফ্ল্যাটই আমাদের অধিকারে’।
একদিন উপেন নলিনীকে ডেকে বললেন, শুনেছি চাকরি ছেড়ে এসেছ, কিন্তু আমাদের সঙ্গে থাকতে হলে ইন্টারভিউয়ে পাশ করতে হবে। নলিনী বললেন, বেশ নিন ইন্টারভিউ। উপেন বললেন, তোমাদের বংশে কেউ পাগল আছে? নলিনী আমতা আমতা করে বললেন, না সেরকম ঠিক নয়, তবে আমার মাতামহ পাগল ছিলেন। বাকিটা নলিনীর লেখা থেকে। ‘আমার উত্তর শোনা মাত্র উপেন্দ্রনাথের সে কী উল্লাস। উচ্চস্বরে হাঁক ছাড়লেন, ও বারীন, খুঁজে খুঁজে খাসা লোক জোগাড় করেছ তো! নলিনী বলছে, তার দাদামশাই পাগল ছিলেন। বারীনদা পাশের ঘর থেকে হাসলেন। উপেন্দ্রনাথ আমাকে বললেন, তোমার পার্মানেন্ট পোস্ট। একেবারে আমাদের এক গোত্রের লোক তুমি। আমরা এখানে যারা আছি, প্রত্যেকেরই বংশে কেউ না কেউ পাগল ছিল।
এই কথার সমর্থন মেলে বারীন্দ্রকুমার ঘোষের আত্মজীবনী ‘বোমার যুগের কাহিনী’ বইয়ে।
জয়ন্তী মুখোপাধ্যায় পুদিচেরিতে থেকে শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের মহাফেজখানা থেকে পুরোনো বিজলী পত্রিকার সংখ্যাগুলো ঘেঁটে বারীন ঘোষের এই আত্মজীবনী আমাদের উপহার দিয়েছেন, তাঁকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ। যেটা নিয়ে সংশয় হচ্ছে, জয়ন্তী লিখেছেন, ‘১৯২০-১৯৩২ সালের মধ্যে ‘বিজলী’ পত্রিকা দুটি পর্যায়ে প্রকাশিত হয়। প্রথমে পণ্ডিচেরি ও পরে কলকাতা থেকে। বিপ্লবী-দার্শনিক অরবিন্দ ঘোষের পর শ্রীঅরবিন্দের ছোট ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এই পত্রিকা সম্পাদনা করতেন’।
কিন্তু নলিনীকান্ত সরকার আসা যাওয়ার মাঝখানে ২য় খণ্ডে লিখছেন (পৃষ্ঠা-৮), ‘ডিমাই চার পেজি সাইজের ৮ পৃষ্ঠার কাগজ ‘বিজলী’। প্রতি সংখ্যার নগদ মূল্য দু’পয়সা। বার্ষিক মূল্য দু’টাকা। ১৯নং বলরাম দে স্ট্রিটের মেটকাফ প্রেস থেকে ছাপা। সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর- তিনই আমি’। অর্থাৎ প্রথম সম্পাদক নলিনী, এবং বিজলী প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকেই। নলিনী লিখছেন, এক বছর পর, বিজলী দ্বিতীয় বর্ষে পড়লে, তার প্রথম সংখ্যা থেকে সম্পাদক হন বারীন ঘোষ। তাহলে কোনটা ঠিক?
*বোমারযুগের কাহিনী/ বারীন্দ্রকুমার ঘোষ/ সংকলক জয়ন্তী মুখোপাধ্যায়/ গাংচিল