Written By অনিরুদ্ধ সরকার
কলেজ স্ট্রিটে নববর্ষ পালন ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও বিবরণ পাওয়া যায় না৷ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা যায়, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হাত ধরেই এর সূচনা। আসলে, বইপাড়ার সূচনা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে৷ ১৮৪৭ সাল নাগাদ সংস্কৃত কলেজের সহকর্মী মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি সংস্কৃত প্রেস নামে এক বইছাপার প্রেস স্থাপন করেন৷ সেই প্রেসের বই বিক্রির দোকান করেন সংস্কৃত কলেজের কাছাকাছি৷ বিদ্যাসাগরেরই উত্সাহে রামতনু লাহিড়ীর ছেলে শরৎকুমার লাহিড়ী ১৮৮৩ সালে ‘এস কে লাহিড়ী অ্যান্ড কোম্পানি ’ নামে একটি বইয়ের দোকান খোলেন৷ একই সময় গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরি ’ নামে একটা ডাক্তারি বইপত্র বিক্রির দোকান খোলেন৷ ‘দাশগুন্ত অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে বইয়ের দোকানটিও সেসময় খোলা হয়েছিল৷ কলেজ স্ট্রিট এলাকায় সম্ভবত প্রথম বইয়ের দোকান খোলে ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি ’৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় দোকানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর ধীরেধীরে কলেজ স্ট্রিটে হয়ে ওঠে এশিয়ার বৃহত্তম বই বাজার। আর তখন থেকেই বড়পাড়ায় নববর্ষ মানেই সাজো সাজো রব। শোনা যায়, ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে একবার ‘সংবাদ প্রভাকর’- পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেন৷ শুধু তাই নয়, ‘নববর্ষ’ উপলক্ষে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এক মহাভোজসভার আয়োজন করেছিলেন আর তাতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত দিকপালেরা নিমন্ত্রিত ছিলেন৷ইতিহাস বলছে, এটাই নাকি কলেজ স্ট্রিট এলাকায় বাঙালির প্রথম ধূমধাম ঘটা করে নববর্ষ পালন৷
অতীত ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, নববর্ষ মানেই ফুলের গন্ধে ম-ম করত কলেজ স্ট্রিট। দিন পনেরো আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত তোড়জোড়। আর ছিল খাওয়াদাওয়ার এলাহি আয়োজন। রীতিমত ঠাকুর আনিয়ে পাবলিকেশন হাউসগুলিতে রান্না চলত। অনেকে আবার কারিগর ডেকে মিষ্টি বানাতেন। শোনা যায়, লেখকেরা নানান ধরনের লেখা নিয়ে প্রকাশনা সংস্থার দফতরগুলিতে ঘুরে বেড়াতেন। প্রকাশকরা পছন্দের পাণ্ডুলিপি কিনে নিতেন। কোনও-কোনও লেখকের সঙ্গে লেখা নিয়ে চুক্তি হত। নববর্ষ মানেই প্রথম নাম আনন্দ পাবলিশার্সের। যেখানে এক ঝাঁক তারকাখচিত লেখক। আর তাঁদের নানান ঘটনা আড্ডার গল্প, যা আজ ইতিহাস।আনন্দ পাবলিশার্সের পুরোনো পৃষ্ঠা ঘাঁটতে ঘাঁটতে মিলল তেমনই নানান ঘটনা। নববর্ষের দিন কলেজ স্ট্রিটে ভিড় জমাতেন লেখকরা। প্রবীনদের পাশাপাশি নব্য লেখকরাও ভিড় জমাতেন এদিন। নবীনপ্রবীনে আলাপচারিতা জমে উঠত বৈঠক। ভাবনার বিনিময় হত। সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় দামি গাড়ি চড়ে আসতেন, সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে উপস্থিত হতেন আনন্দের বৈঠকী আড্ডায়। সাহিত্যিক তারাশঙ্করও আসতেন গাড়ি নিয়ে।একবার ১লা বৈশাখ প্রকাশপেল পন্ডিত রবিশঙ্করের ‘রাগ অনুরাগ’ বইটি। রবিশঙ্কর তখন খ্যাতির শীর্ষে। সারা দিন পন্ডিত রবিশঙ্কর ঘুরে বেড়ালেন কলেজ স্ট্রিট।যাওয়ার আগে বলে গেলেন, “নতুন বইয়ের গন্ধ আর একরাশ আনন্দ নিয়ে ফিরছি। আবার আসব।” শুধু লেখকই নয় ১লা বৈশাখ প্রচ্ছদশিল্পী, প্রুফরিডার, বাইন্ডার, বই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত সকলের দেখা মেলে নববর্ষের দিন।ডিজিট্যাল বই-এর যুগে কলেজ স্ট্রিট বদলেছে, বই পড়ার থেকে... বই কেনার থেকে... বই দেখার লোক বেড়েছে... বেড়েছে বই লেখার লোকের সংখ্যা। কিন্তু স ত্যি কথা, নববর্ষে বই পাড়ার আড্ডার সেই ট্রাডিশন কিন্তু আজও এক।১লা বৈশাখ মানেই বইপাড়া......।