Written By আশিস চট্টোপাধ্যায়
প্রথম ১৫ দিনেই রাজনীতি আর অর্থনীতিতে যা যা ঘটল, তার একটা মন্তব্য-বিহীন তালিকা দেওয়া এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য । মন্তব্য করা হচ্ছে না, কারণ ঘটনাগুলির প্রকৃত ফলাফল বুঝতে কিছুটা সময় লাগতে পারে । তবে কোনদিকে যেতে পারে এসব ঘটনার গতিপ্রকৃতি, তা মোটের ওপর আন্দাজ করা কঠিন নয় । আমরা জানি, ২৩ মে ২০১৯ ভোটগণনা হয়েছে, ইভিএম-এর সংখ্যা-তথ্য বলেছে, বিপুল ভোটে জিতেছে বিজেপি ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স । ৩১ মে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী । কিন্তু তার আগে থেকেই খবর আসতে শুরু করেছে — বড় বড় খবর ।
ভারতের রফতানির ওপর শুল্ক চাপাল মার্কিন দেশ
মোদিবাবু আমেরিকার না কি অতি গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু । এতটাই যে, প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাকে ‘বারাক’ বলে সম্বোধন করতেন মোদিজি । ওবামা সাহেবের পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি হবার পরে তাঁকেও ডোনাল্ড বলে ডাকেন কি না, তা জানা যায়নি এখনও । কিন্তু দ্বিতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঠিক পরের দিন, ১ জুন ২০১৯ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে দিল, ভারত সে দেশে রফতানি করার ক্ষেত্রে যে শুল্কের সুবিধা পেত, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হল । সিদ্ধান্তটি লাগু হয়েছে ৫ জুন থেকে । জানা যাচ্ছে, এর ফলে ভারতের ৬০০ কোটি ডলার মূল্যের রফতানির ওপর প্রভাব পড়বে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি শুল্ক চাপিয়ে ভারতের পণ্য তাদের বাজারে ছাড়ে, তাহলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন
হয়ে পড়বে ভারতের পক্ষে । এর ফলে ভারতে উৎপাদন কমে যেতে পারে, বন্ধ হতে পারে কলকারখানা । নতুন করে বেকার হতে পারেন বহু মানুষ । শুল্ক বসানোর বিষয়টির পোশাকি নাম জেনারালাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্সেস বা ইংরেজি আদ্যক্ষর অনুযায়ী জিএসপি । এই ব্যবস্থা অনুযায়ী ভারত যেসব পণ্য ওদেশে রফতানি করে, তার ওপরে শুল্ক কম বসানো হয় বা কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই বসানো হয় না । এই জিএসপি বন্ধ করার হুমকি মার্কিন যক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল চলতি বছরের মার্চেই । কিন্তু, সম্ভবত ভারতের গোপন অনুরোধেই, নির্বাচন চলার সময়ে ঘোষণাটি করেনি । ভোট মিটতেই মার্কিন দেশ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দেয় । মিনমিন করে ভারত প্রতিবাদ করলেও তাতে কান দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । কেবল জিএসপি-ই নয়, আরও কয়েকটা ক্ষেত্রে ভারতের বিরুদ্ধে আর্থিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে মার্কিন দেশ ।
দেশের জিডিপি সবথেকে নীচে
ভোটের পরেই জাতীয় অর্থনীতির চেহারার করুণ ছবিটা দেখা যাচ্ছে । ভোটের আগে এসব তথ্য চেপে রাখা হয়েছিল। জানা যাচ্ছে, ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের শেষ ত্রৈমাসিকে, অর্থাৎ ২০১৯ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়পর্বে জাতীয় অর্থনীতি বেড়েছে মাত্র ৫.৮ শতাংশ হারে । এই সংখ্যাটা এক বছর আগে ছিল ৬.৬ শতাংশ, এবং দু’বছর আগে ছিল ৮.৮ শতাংশ । ৫.৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি গত ৫ বছরে সবথেকে কম, যার ফলে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের বৃদ্ধি ৬.৮ শতাংশে দাঁড়াতে পারে, যা ৫ বছরে সর্বনিম্ন ।
বেকারত্বের হার অর্ধশতকে সর্বাধিক
এ বিষয়েও তথ্য ভোটের আগেই জানা গিয়েছিল, কিন্তু সরকার তথ্য চেপে রাখে । ভোটের পরই জানা যায়. ভারতে কর্মহীনতার হার এখন ৭.৬ শতাংশ, যা দু’বছর আগেও ছিল ৪ শতাংশ । অর্থাৎ দু’বছরে কর্মহীনতা দ্বিগুণ হয়েছে ।
পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ছে
মোদী সরকার ২ গদিতে বসার আগেই, শেষ দফার ভোট সাঙ্গ হবার সঙ্গে সঙ্গেই, ২০ মে ২০১৯ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়াতে শুরু করেছে । ডিজেলের দাম বাড়ার জন্য মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়তে পারে, এমনই মত অর্থনীতিকদের অনেকের ।
বাড়ছে রান্নার গ্যাসের দাম
এই গ্যাসের পোশাকি নাম লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি। এই গ্যাস মূলত রান্নার কাজে ব্যবহৃত হলেও আরও কিছু কিছু কাজে লাগে । ভোটের অব্যবহিত পর থেকেই এলপিজি-র দাম বাড়াচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলি । মে মাসে কলকাতায় গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ছিল ৭৩৮ টাকা ৫০ পয়সা । জুন মাসে তা বেড়ে হয়েছে ৭৬৩ টাকা ৫০ পয়সা । পাশের রাজ্য বিহারের পাটনায় এই দাম যথাক্রমে ৮০৫ টাকা ৫০ পয়সা ও ৮৩০ টাকা ৫০ পয়সা । ভারতের সব শহরে গ্যাসের দাম অল্প সময়ের মধ্যে চড়চড় করে বাড়ছে ।
ডাল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে
ডালের দাম দ্রুতগতিতে বাড়ছে । বাড়ছে চাল সহ নানা রোজকার দরকারি জিনিসের দামও । জিনিসের দাম যে বাড়ছে, তা মেনে নিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও । এর সঙ্গে যোগ করতে হবে পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি । সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে ।
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রেলের ৫টি ছাপাখানা
রেল কোম্পানির অনেক ছাপাখান ছিল আগে । এই ছাপাখানাগুলিতে টিকিট, ফর্ম সহ রেলের নানা প্রয়োজনীয় জিনিস ছাপা হত । গত বছরগুলিতে একে একে এই কারখানাগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । কাজ দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে । বাকি ছিল ৫টি কারখানা । সেগুলিও এবার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল । সামনের বছর এগুলি বন্ধ করে দেওয়া হবে । সরাসরি রেলের কর্মচারীদের রেলেরই অন্য জায়গায় চাকরি দেওয়া হবে কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়, তবে প্রত্যক্ষ কর্মচারী যারা নন , কিন্তু এই কারখানাগুলির ওপরে নির্ভর করে যাদের জীবিকা নির্বাহ হয়, সেরকম হাজার হাজার মানুষের জীবিকার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে । প্রসঙ্গত, এই ৫টি
কারখানার ১টি এই রাজ্যের হাওড়ায় অবস্থিত ।
সুদ কমাল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক
৪ জুন ২০১৯ । পরপর তৃতীয় বারের জন্য সুদ কমাল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক । এর ফলে যারা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেন, তাঁদের সুদের হার পড়তে পারে । উল্টোদিকা যারা জমা টাকার ওপর সুদে জীবন নির্বাহ করেন, সেইসব ব্যক্তিদের, বিশেষ করে প্রবীণ নাগরিকদের সুদের উপার্জন কমবে । এমনকী স্বল্প সঞ্চয়ের সুদও কমানো হবে বলে শোনা যাচ্ছে । জুন মাসের শেষে স্বল্প সঞ্চয়ের সুদের হার নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক হওয়ার কথা । তালিকা এখানেই শেষ নয় । তবে, প্রবন্ধের আয়তন আরও বাড়ানো সম্ভব নয় । তাই এটা নিশ্চয়ই বলা যায়, নতুন ভারত শুরু হয়ে গেছে ।