Written By অনিরুদ্ধ সরকার
রেকর্ড কোম্পানির দরজায় দরজায় ঘুরছেন হন্যে হয়ে একটা গান রেকর্ডের জন্য কিন্তু কেউ কিছুতেই সুযোগ দেবে না । জলসায় গাইতে দেবার আশ্বাস পেয়ে ঠায় ৪ ঘণ্টা বসে আছেন । অথচ আয়োজকরা বললেন, ‘দূর মশাই, আপনার গান কে শুনবে ? দেখছেন না, পঙ্কজ মল্লিক এসে গেছেন ! ওঁর গান শুনে বাড়ি চলে যান ।’ এত অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন, কিন্তু গান ছাড়েননি । তিনি আর কেউ নন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ।
একসময় ভেবেছিলেন, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সাহিত্যিক হবেন । বেশ ভাল ছোটোগল্প লিখতেন । তার কয়েকটি প্রকাশও পেয়েছিল, ‘দেশ’ পত্রিকায় । তিনি যে গল্প লিখেছেন, সেই তথ্য খুব কম লোকই জানেন । ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৩৭ এবং ১৯৮৮ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গল্প লিখেছিলেন । ১৯৩৭ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন ‘একটি দিন’ নামের একটি গল্প । ‘শতাব্দীর আর্তনাদ’ লিখেছেন তার অনেক পরে ১৯৮৮ নাগাদ । তখন সাহিত্যিক হবার স্বপ্নে তিনি মশগুল । স্কুলের সহপাঠী সুভাষ মুখোপাধ্যায় ততদিনে নামজাদা কবি । হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন খুব বন্ধুবৎসল । কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এক জায়গায় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘হেমন্ত বহুদিন বাজার করে একটা ব্যাগ আমার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যেত । এ তো কিছু নয় । আমার তখন রোজগার বলতে কিছুই ছিল না । লেখাপত্তর বেরোলে কিছু টাকাপয়সা আসত এই যা । তাতে কী আর কিছু হয় ! একদিন হেমন্ত এসে বলল, চল, গাড়িতে ওঠ । তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব ।’ তা ওর কথামত গাড়িতে উঠলাম । গাড়ি এসে থামল সম্ভবত মিশন রো’র কাছে । একটা ঘরে নিয়ে এল । ঘরে ঢুকেই মনে হল একটা সুন্দর অফিস । আমি বললাম, কি রে নতুন অফিস করলি নাকি ! হেমন্ত বলল, তোর পছন্দ হয়েছে? আমি বললাম, বেশ হয়েছে । হেমন্ত বলল, এটা তোর জন্যে । এখান থেকে তুই নতুন পত্রিকা বার করবি । আর এই ঘরটা তোর । সম্পাদকের জন্যে তো আলাদা একটা ঘর লাগবেই । আমি সাকুল্যে চার-পাঁচদিন গিয়েছিলাম ওই অফিসে । ভাবনা-চিন্তাও হল অনেক । আমার দ্বারা কি বাঁধাধরা কাজ হয়? হলও না । এটা হেমন্তও জানত । তবুও আমার যাতে ভাল হয় সেইজন্য এত খরচ করেছিল । এই যে আমি অফিস গেলাম না, পত্রিকা করলাম না, এ নিয়ে একটা কথাও ও আমাকে কোনওদিন বলেনি । হেমন্ত আমার জন্য অনেক কিছু করেছিল । ওর মতো বন্ধু পাওয়া মানে অনেক কিছু পাওয়া ।’
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম হিন্দি ছবি ছিল ‘বিশ সাল বাদ’ । ৬০-৬১ সালের ঘটনা । শোনা যায়, ছবিটি নাকি তৈরি হয়েছিল ‘ডালডা’র সবচেয়ে বড় বড় ডাব্বায় জমানো টাকা দিয়ে! তা প্রায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা! এই সময়ের ঠিক আগে ছ’মাস গান গাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন লতা মঙ্গেশকর । লতাজীর গলায় কিছু একটা অসুবিধের জন্য গান গাইতে পারছিলেন না তিনি । ঠিক এমন সময়ই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে প্রস্তাব দিলেন তাঁর ছবিতে গান গাওয়ার জন্য । লতাজি এলেন এবং গানও গাইলেন । এদিকে হেমন্ত সম্মান দক্ষিণা দিতে গেলে লতাজী হেমন্তের দেওয়া খাম ফিরিয়ে দেন । শোনা যায়, লতা মঙ্গেশকর এবং আশা ভোঁসলে দুজনেই কোনও দিন গানের জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অর্থ নেননি ।
সুরের যাদুকর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯২০র ১৬ জুন বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন । তিন ভাই আর এক বোনের সঙ্গে হেমন্তের ছোটোবেলা কাটে । ছোটভাই অমল মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু বাংলা ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেছিলেন এবং কিছু গানও গেয়েছিলেন । বড় ভাই তারাজ্যোতি ভালো ছোটগল্প লিখতেন । দেব সাহিত্য কুটিরের এক পূজা বার্ষিকীতে ‘ঠোঙা বাবা’ নামে যে গল্পটি লিখেছিলেন তারাজ্যোতি, সেটি খুব জনপ্রিয় হয় ।
তবে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আর সাহিত্যিক হওয়া হয়নি । বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের অনেক আশা হেমন্তকে নিয়ে । ছেলে পড়াশুনোয় ভালই কিন্তু গোলটা বাধল ঠিক ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার তিন মাস আগে । স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল হেমন্তকে কেন ? তার মূলেও কিন্তু ওই গান ! টিফিন টাইমে অন্যরা সব খায়-দায়। হেমন্ত তখন বন্ধুদের নিয়ে টেবিল বাজিয়ে গান গায় । পঙ্কজ মল্লিক, শচীন দেববর্মনের রেকর্ডের গান । তাতে স্কুল জুড়ে এমন হৈ-হট্টগোল বাধতে লাগল যে হেডমাস্টার ডেকে বললেন— ‘ তোমার নাম কেটে দেওয়া হয়েছে । যাও, এবার গান গেয়ে বেড়াও ।’ ফাইনাল পরীক্ষার বাকি মাত্র তিন মাস ! কালিদাসবাবু স্কুলে গিয়ে প্রায় হাতে-পায়ে ধরে সে-যাত্রায় ছেলেকে রক্ষা করেন । এরপরও হেমন্ত কিন্তু ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিকে পাশ করার পর বাবার ইচ্ছেয় ভর্তি হয়েছিলেন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে । এদিকে গান ততদিনে তাঁকে পেয়ে বসেছে ! বন্ধু সুভাষ অসিতবরণকে ধরে রেডিওতে অডিশনের ব্যবস্থা করে ফেললেন । অভিনেতা অসিতবরণ তখন রেডিওতে তবলা বাজান । অডিশনে পাশ করার তিন মাস পর প্রোগ্রামের চিঠি এল । গান শুনে পাহাড়ী সান্যাল বললেন, ‘বাহ্, চর্চা করলে ভাল গাইয়ে হবে ।’ পঙ্কজ মল্লিক একদিন আকাশবাণীতে হেমন্তকে দেখে বললেন, ‘তুমি তো দেখছি আমাদের ভাত মারবে !’
হুগলি মহসীন কলেজের একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে গেছেন হেমন্ত সঙ্গে ছিলেন উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় । গানের আসরের শেষে সবার সম্মান দক্ষিণা দেওয়ার পালা । আয়োজক ছাত্রেরা একটি খাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হাতে দেয় । হেমন্ত খামটি খুলে দেখলেন না । গাড়িটা কিছুদূর যাবার পর সবাইকে টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে খামটা খুলে দেখেন, মাত্র দু-তিনটে দশ টাকার নোট ! সঙ্গে একটা চিরকুটে ছাত্ররা লিখেছে, ‘এর বেশি কিছুতেই আমরা জোগাড় করতে পারলাম না । দয়া করে আমাদের ক্ষমা করে দেবেন ।’ উৎপলা সেন তো রেগে আগুন । বললেন, ‘এক্ষুনি গাড়ি ঘুরিয়ে কলেজে চলুন হেমন্তদা । এভাবে ঠকাবে আমাদের ?’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিশ্চুপ । সামনে একটা ছোট্ট দোকানে আলুর চপ ভাজা হচ্ছিল । উৎপলাকে একটা কথাও না বলে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হেমন্ত বললেন, ‘চল, ভারি সুন্দর আলুর চপ ভাজছে । ওই দশটাকাগুলোর সদব্যবহার করে ব্যাপারটা সেলিব্রেট করি ।’ উৎপলার দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে বললেন, ‘ছাড় না, ছাত্ররাই তো করেছে । ওরা কোথা থেকে অতো টাকা পাবে বল তো ?’ এই ছিলেন হেমন্ত । হয়ত তাই শতবর্ষ পরেও হেমন্তের সঙ্গীতই নয়, ব্যক্তি হেমন্তকেও কুর্ণিশ জানাতে ইচ্ছে করে ।